You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাঘমারা/আলী শহরের যুদ্ধ
লাকসাম থানার অন্তর্গত বাঘমারা/আলী শহর কুমিল্লা শহরের ৬ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। ১৯ এপ্রিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানি এ এলাকায় যুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল। ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লেফটেন্যান্ট-ইমাম-উজজামান এ এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। | ১৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট নিয়ে এ এলাকায় আক্রমণ চালায়। অপ্রতুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী ২ দিন পর্যন্ত তীব্র প্রতিরােধ রচনা করে কিন্তু আক্রমণের তীব্রতার মুখে টিকে থাকতে না পেরে পিছু হটে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ২৭০জন মারা যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরােটা সময়ই বাঘমারায় মুক্তিবাহিনী বিভিন্নভাবে অনেক অভিযান চালায়। তন্মধ্যে বাঘমারা রেলওয়ে সেতু অন্যতম, যা পাকিস্তানিদের পরবর্তী সময় ঢাকাচট্টগ্রামের রেল যােগাযোেগ ব্যবহারে অক্ষম করে দেয়।
ফুলতলী অ্যামবুশ
কুমিল্লা সদর থানার ফুলতলী ও মিয়াবাজারের কাছে মুক্তিবাহিনী ২টি অ্যামবুশ পরিচালনা করে। ২০ এপ্রিল শত্রুদের ২টি গাড়ি রাত সাড়ে ৪টার সময় ফুলতলীতে অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে যায়। অ্যামবুশ পার্টি ১টি গাড়িকে ধ্বংস করে দেয় এবং ১টি গাড়ির ক্ষতিসাধন করে। শেষের গাড়িটির ভেতর অ্যামবুশ পার্টি ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে শত্রুদের ৬জন নিহত হয়।  পরবর্তী সময় মিয়াবাজারেও মুক্তিবাহিনী আরেকটি অ্যামবুশ পরিচালনা করে। এতে শক্রদের ৫জন নিহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ১টি মর্টার দখল করে নেন।
বিবির বাজারের অন্যরকম যুদ্ধ
২১ এপ্রিল পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের বিবির বাজার এরিয়ার পশ্চিম দিকে অতিরিক্ত সৈন্য ও ভারী অস্ত্রসহ শাহাপুর, গাজীপুর ও মাজার এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট রেজা মেজর খালেদ মােশাররফকে শত্রুর অবস্থানগ্রহণ এবং বিবির বাজার প্রতিরক্ষা অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত করেন। তিনি লেফটেন্যান্ট রেজাকে জানান যে, তিনি কয়েকজন বিদেশি যুদ্ধকালীন সাংবাদিককে (War corrospondent) নিয়ে বিবির বাজার প্রতিরক্ষা অবস্থানে আসবেন। তখন যেন লেফটেন্যান্ট রেজা একটি আক্রমণের মহড়ার আয়ােজন করেন (বাস্তব আক্রমণ নয়)। মে মাসের মাঝামাঝি মেজর খালেদ মােশাররফ একজন পুরুষ ও একজন মহিলা সাংবাদিককে নিয়ে বিবির বাজার প্রতিরক্ষায় আসেন। সাংবাদিকেরা তাঁদের Movie Camera, Still Camera ও টেপরেকর্ডারসহ যুদ্ধের দৃশ্য ধারণ করার জন্য প্রস্তুত হন। এ সময় এক মুক্তিযােদ্ধার হাতে ভারতীয় ৯ মি.মি, এসএমজি দেখতে পেয়ে মেজর খালেদ মােশাররফ তাকে বাংলায় বলেন, এ অস্ত্র বদল করে কোনাে চাইনিজ অস্ত্র অথবা .৩০৩ রাইফেল নেয়ার জন্য। তারপর তিনি লেফটেন্যান্ট রেজাকে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।
নির্দেশ পেয়ে প্রতিরক্ষার সব অস্ত্র একসাথে গর্জে ওঠে। সাথে সাথেই গর্জে ওঠে শত্রুর সব অস্ত্র। শত্রু মুষলধারে মর্টারের গােলাবর্ষণ করতে থাকে। শক্রর অবস্থানের দূরত্ব আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে কোথাও ৩০০ গজ, কোথাও ৪০০ গজ দূরত্বে। এ প্রতিরক্ষায় আমাদের যােদ্ধারা এ ধরনের গােলাবর্ষণে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে কিন্তু মুষলধারে এ গােলাবর্ষণ বিদেশি সাংবাদিকদের হকচকিয়ে দেয়। পৃথিবীর বহু যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা দাবিকারী এ যুদ্ধ সাংবাদিক গােলাগুলির তাণ্ডবে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ততক্ষণে তাদের যুদ্ধের ছবি তােলার শখ উবে গেছে নির্ভীক যােদ্ধা মেজর খালেদ মােশাররফ তাদের বােঝাচ্ছেন যে, বাংলাদেশের এ ভূখণ্ড তারা শত্রুর কাছ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এ প্রতিরক্ষার যাবতীয় অস্ত্র পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া। বােঝা গেল, মেজর খালেদ মােশাররফ মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রাথমিক দিনগুলােয় আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের শৌর্য, বীর্য ও সাফল্য বিদেশে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই তিনি এ আক্রমণ নাটক মঞ্চস্থ করেন। তিনি এও বােঝাতে চেয়েছেন যে, মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে ভূমি দখল রাখতে সক্ষম এবং ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সাহায্য ছাড়াই তারা যুদ্ধ করছেন। বিশ্ববাসীর কাছে এ সত্য প্রমাণ করা ছিল অত্যাবশ্যক মেজর খালেদ মােশাররফ তা সাফল্যের সাথেই করেন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!