You dont have javascript enabled! Please enable it!
কুমিল্লা বিমানবন্দরের রেইড
ময়নামতি সেনানিবাস থেকে ৮-৯ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত কুমিল্লা বিমানবন্দর। মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের সময় থেকে এবং ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের অতর্কিত হামলার পর থেকে সেনানিবাসের পচনশীল দ্রব্যাদি (মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি) বেসামরিক বাঙালি সরবরাহকারী সেনানিবাসে সব সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানিরা বাধ্য হয়ে ঢাকা থেকে কৌটাজাত খাদ্য। বিমানে করে কুমিল্লা আনতে বাধ্য হয়। এ কারণে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে কড়া প্রতিরক্ষা স্থাপন করে। মুক্তিযােদ্ধারা এ বিমানবন্দর এবং বিমানবন্দরের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত শত্রুর ওপর উপর্যুপরি রেইড করে তাদের নাজেহাল ও হয়রানি করেন।
৮-৯ এপ্রিলে মুক্তিযােদ্ধারা একটি ১০৬ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল (আরআর) জিপসহ বিমানবন্দরের ৭০০-৮০০ গজ কাছে নিয়ে যান। তারা আরআর থেকে ৫০-৬০টি গােলা বিমানবন্দরে নিক্ষেপ করেন। শত্রুর হতাহতের কোনাে খবর সংগ্রহ করা যায়নি। তবে এতে শত্রুর প্রভূত ক্ষতিসাধন। হয় বলে অনুমান করা হয়। এ অপারেশনে লেফটেন্যান্ট রেজা, হাবিলদার সিরাজ, সিপাহি কুতুব, আব্দুল মালেক, এমপিএ সেলিম, আফজাল খান, পাখি, বাবুলসহ প্রায় ২০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।
সুবৰ্ণপুরের অ্যামবুশ
কুমিল্লা সদর থানায় সুবর্ণপুর অবস্থিত। ১৪ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪টায় । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সেনাদল কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে উজানিশার সেতুর প্রায় দেড় মাইল দূরে সুবর্ণপুরে সমস্ত গাড়ি থামিয়ে প্রথমে ২টি কোম্পানি দুই দিক দিয়ে অগ্রসর হয়। তাদের সঙ্গে ১জন অফিসারও ছিলেন। প্রায় সন্ধ্যার সময় কোম্পানি ২টি বিনা বাধায় টিলার ওপরে উঠে একত্র হয়। ঠিক এ সময় অতর্কিতে ইপিআর বাহিনীর মেশিনগান, এলএমজি ও রাইফেলগুলাে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, এখানে ১৭০জনের মতাে শক্র নিহত হয়। অবশিষ্টরা বিক্ষিপ্তভাবে পালিয়ে অপর পাড়ে পৌছে। পাকিস্তানিরা ইপিআর বাহিনীর ওপর আটিলারির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ করে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। শত্রুদের এ আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ঐ তারিখেই শত্রুদের ওপর একটি বড়াে দল গঙ্গাসাগর হয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। ইপিআর বাহিনীর ১টি দল অগ্রসরমাণ শত্রুদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু শত্রুকে হত্যা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শত্রুদের ব্যাপক আর্টিলারির গােলাতে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। টেলিযােগাযােগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন স্থানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করতে থাকে। কোনাে দিক থেকে কোনাে সাহায্য না পেয়ে নায়েব সুবেদার গােলাম আম্বিয়া তার ২টি প্লাটুন নিয়ে গােলাবৃষ্টির মধ্যে পিছু হটে ১৬ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে আখাউড়া পৌছেন।
জাঙ্গালিয়ার অ্যামবুশ
কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত সদর থানার কুমিল্লা-লাকসাম সড়কে জাঙ্গালিয়া অবস্থিত। কুমিল্লা থেকে এপ্রিল মাসের ১৫-১৬ তারিখে পাকিস্তানিদের বিরাট এক কনভয় প্রায় ৩০টি গাড়িতে তাদের জনবল নিয়ে লাকসামের দিকে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা শক্রসেনাদের এ দলটিকে দুপুর ১২টায় জাঙ্গালিয়ার কাছে অ্যামবুশ করে। এ অ্যামবুশে শত্রুসেনাদের সমূহ ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষ প্রায় ৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। শত্রুরা গাড়ি থেকে নেমে অ্যামবুশ পার্টিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সৈন্যদের সাহসিকতা ও কৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। | এ সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লেফটেন্যান্ট দিদার যথেষ্ট কৌশল ও রণনিপূণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মাহবুব তার সৈন্যদের নিয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে অ্যামবুশ করে বসেছিলেন। যখন শত্রুদের কনভয় তার অ্যামবুশের মাঝে পড়ে যায়, তখন তাদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে ১টা গাড়ি রাস্তা থেকে পড়ে যায়। বাকি গাড়িগুলাে থেকে শক্ররা লাফালাফি করে নীচে নামার চেষ্টা করে। এতে তারা অনেকে হতাহত হয়। যে-সব শক্ত গাড়ি থেকে নামে, তারা রাস্তার ওপারে (পশ্চিম দিকে) গিয়ে একত্র হয় এবং ক্যাপ্টেন মাহবুবের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম রাস্তার পশ্চিম পাশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের নিয়ে তৈরি ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানিদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। শত্রুপক্ষ উভয় দিক থেকে আক্রান্ত হয়। নিজেদের এত হতাহত দেখে তারা মনােবল হারিয়ে ফেলে। তারা ৩-৪টি গাড়ি ধ্বংসাবস্থায় রেখে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধের ফলে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি মেশিনগান, ৬টি হালকা মেশিনগান এবং ৩০টি রাইফেল আহত ও নিহত শত্রুসেনাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে। বিধ্বস্ত যে গাড়িগুলাে শত্রুরা ফেলে গিয়েছিল, তা থেকে কয়েক হাজার অ্যামুনিশন উদ্ধার করা হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!