You dont have javascript enabled! Please enable it! বড়কামতার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
বড়কামতার যুদ্ধ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান বা স্থান পরিচিতি বড়কামতা কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার অন্তর্গত একটি ছােটো গ্রাম। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ১২ কিলােমিটার পশ্চিমে বর্তমান চান্দিনা থানার কাছে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন স্থানে এ গ্রাম অবস্থিত। বড়কামতা ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। সমগ্র চান্দিনা এলাকা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বড়কামতা নামে অধিক পরিচিত ছিল। গ্রামটি বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন হলেও তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চান্দিনা বাজারের মধ্য দিয়ে ছিল বিধায় রাস্তা থেকে ৮০০ গজ উত্তরে ছিল। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্থানের গুরুত্ব। বড়কামতা গ্রাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী হওয়ায় গ্রামটি পাকিস্তানিদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাছাড়া কুমিল্লা সেনানিবাসের নিকটবর্তী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বড়াে লক্ষ্য ছিল এ গ্রাম। অরবেট বা অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষের ইউনিট মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে এ যুদ্ধে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উল্লেখযােগ্যসংখ্যক সৈনিক ও গ্রামবাসী অংশ নেয়। পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের নিয়মিত টহল বাহিনী এ যুদ্ধে অংশ নেয়। পাকিস্তানিদের অবস্থান বা প্রতিরােধ/প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাকিস্তানিরা সুনির্দিষ্ট কোনাে স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল না। সেনানিবাস থেকে নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে এরা বড়কামতায় আসতাে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। প্রাথমিক প্রতিরােধের সময় মুক্তিবাহিনী ২টি উপদলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিমে অবস্থান নেয়। পরবর্তী সময় পরিকল্পনা নেওয়া হয়, পাকিস্তানিদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা বাজারের ওপর থেকে বড়কামতা গ্রামে প্রবেশের পূর্বেই বাধা দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী বড়কামতা গ্রামের মাঝ দিয়ে বাগমারা হয়ে ছােটনা পর্যন্ত হালকা যানবাহন চলাচলকারী রাস্তাকে মাঝে রেখে দুই পাশে পানের বরজের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন।
আন্দোলনকারী স্থানীয় রাজনৈতিক ছাত্রনেতা বা অন্য সংস্থার নেতার সাথে সমন্বয় বড়কামতা এলাকায় যখন মুক্তিযােদ্ধারা সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন, তখনও মুক্তিবাহিনী সাংগঠনিক পূর্ণতালাভ করেনি। বাগমারা গ্রামের মাে. মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে মনির মাস্টার, যিনি বাংলাবাজার সংলগ্ন বিএ মুসলিম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তিনিই এলাকার যুবকদের সংগঠিত করেন। পরবর্তী সময় এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহে ১৬-১৮ তারিখ ভারতের মতিনগরে। যান এবং মেজর খালেদ মােশাররফের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বড়কামতায় সংঘটিত প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধেই তার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল। তার নেতৃত্বেই এলাকাবাসী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সহায়তায় প্রাথমিক প্রতিরােধ সংগ্রামে অংশ নেয়। রেকি বা পর্যবেক্ষণ ও যুদ্ধের পরিকল্পনা। মতিনগর ক্যাম্পে অবস্থিত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পরিকল্পনা ছিল ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক চলাচলের অযােগ্য করা। তাই ক্রমান্বয়ে পুলঘাটা, ইলিয়টগঞ্জ ও ভাটেরচর ব্রিজ ধ্বংস করা মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। যুদ্ধের প্রস্তুতি মনির মাস্টার মতিনগর ক্যাম্পে গিয়ে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মতিনকে এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। ক্যাপ্টেন মতিন মনির মাস্টারকে পুলঘাটা ব্রিজ ধ্বংসের প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক দেন এবং সংক্ষিপ্ত মৌখিক প্রশিক্ষণ দেন। ১৮-১৯ এপ্রিল মনির মাস্টার ও তার ৫জন সহযােগী ঐ ব্রিজ ধ্বংসের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক মফিজ ও নায়েক তাহেরের সহায়তায় ২২ এপ্রিল পুলঘাটা ব্রিজ ধ্বংস করা হয়। ২৩ এপ্রিল নায়েক তাহের, নায়েক মফিজ, আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার ও মাে. সাইদুর রহমান ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস করেন।
এসব তৎপরতার কারণে পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ১৯-২০ এপ্রিল সকাল ১০টায় ৩-৪টি ৩ টনি ট্রাকে করে পাকিস্তানিরা। চান্দিনা বাজারে আসে ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২০-২১ এপ্রিল সকাল ১০টায় দ্বিতীয়বার পাকিস্তানিরা চান্দিনা বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং বড়কামতার দুর্গাবাড়ি ও জেলেবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। যুদ্ধের বিবরণ ২০-২১ এপ্রিল গ্রামবাসী লাঠিসোটা, বর্শা, বল্লম নিয়ে প্রতিরােধের চেষ্টা করে। গ্রামবাসীর প্রতিরােধের খবর মতিনগরে এসে পৌছালে ২৬-২৭ এপ্রিলে হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে ১১-১২জনের ১টি দল ছােটনা এসে পৌছায়। ২৭২৮ এপ্রিল তারা বাগমারা গ্রামের আমিন উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান নেয়। হাবিলদার গিয়াস ২৮-২৯ এপ্রিল শত্রু কর্তৃক বড়কামতা আক্রমণের সংবাদ পান। তিনি তার দলকে ২টি ভাগে ভাগ করেন, পূর্বদিকে থাকেন নায়েক তাহের ও তার দল। | পূর্বনির্ধারিত খবর অনুযায়ী ২৮-২৯ এপ্রিল সকাল ৮টায় পাকিস্তানিরা ৪৫টি ট্রাকে করে এসে চান্দিনা থানার কাছে পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর থামে এবং দ্রুত বড়কামতা গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে শত্রুদের ওপর ফায়ার করেন। হতবিহ্বল শত্রু ভীত হয়ে যত্রতত্র ফায়ার করা শুরু করে। গুলিবিনিময় চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এ যুদ্ধে পূর্বদিকের দল অধিনায়ক নায়েক তাহের ও সিপাহি কালু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাওয়ায় হাবিলদার গিয়াস দলবল নিয়ে অবস্থান ত্যাগ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ত্যাগ নিশ্চিত হয়ে পাকিস্তানিরা বড়কামতায় প্রবেশ করে এবং ধৈয়রাবাড়ি, করের বাড়িসহ বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে। পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে মুক্তিবাহিনী নিশ্চিত হয় যে, পাকিস্তানিরা অবশ্যই আবার অতিরিক্ত লােক ও শক্তি নিয়ে আক্রমণে আসবে।
হাবিলদার গিয়াস দেরি না করে জনবল ও ভারী অস্ত্র চেয়ে মতিনগরে বার্তা পাঠান। মতিনগর থেকে ১টি এমজি, কিছু গ্রেনেড ও কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল প্রেরণ করা হয়, কিন্তু লােকবল বৃদ্ধি সম্ভব নয় বলে জানানাে হয়। হাবিলদার গিয়াস অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। জনবল ও অস্ত্র বৃদ্ধি পেলেও তা সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত শত্রুদের তুলনায় ছিল নগণ্য। হাবিলদার গিয়াস তাই পাকিস্তানিদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা বাজারের ওপর থেকে বড়কামতা গ্রামে প্রবেশের পূর্বেই বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। বড়কামতা গ্রামের মাঝ দিয়ে বাগমারা হয়ে ছােটনা পর্যন্ত হালকা যান। চলাচলকারী এ রাস্তাকে মাঝে রেখে দুই পাশে ২টি দলকে বসানাে হলাে। প্রতি দলে জনবল ছিল ৭-৮জন। গ্রামবাসী ১২-১৪ দিন পর্যন্ত প্রতিরক্ষা প্রস্তুত করলাে। ১৩-১৪ মে সকাল ১০টায় পাকিস্তানিরা পুলঘাটা ব্রিজের কাছে এসে থামে। সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী গুলি শুরু করে। সংঘর্ষ প্রায় ১ থেকে দেড় ঘণ্টা। স্থায়ী হয়। মুক্তিবাহিনীর কেউ এতে হতাহত হয়নি। পাকিস্তানিদের অনেকেই হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা এ প্রতিরােধের মুখে বড়কামতা গ্রামের অতীন্দ্র চন্দ্র আচার্য ও জনৈক হিন্দু মহিলাকে হত্যা করে দিগ্বিদিক ফায়ার করে সেনানিবাসে
ফিরে যায়। এরপর হাবিলদার গিয়াস ১৬-১৭ মে মতিনগর গিয়ে ১৫ জুন ৪র্থ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৭জনের ১টি দল নিয়ে ফিরে আসেন এবং ২টি দলে। বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ২৫ জুন সকাল ১০টার সময় পাকিস্তানিরা ৪টি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। ১টি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে বড়কামতার পশ্চিমে খালের ভেতর দিয়ে ছােটনা গ্রাম পর্যন্ত পজিশন নেয়। আরেকটি দল গ্রামের পূর্ব দিকে উত্তরে ব্রাহ্মণপাড়া গ্রাম পর্যন্ত রাস্তায় এবং গ্রামের ভেতর পজিশন নেয়।
তৃতীয় দলটি পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে অ্যাসল্ট ফরমেশনে গ্রামের। ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ছােটনা ব্রাহ্মণপাড়া লাইনে এসে উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে অবস্থান নেয়। চতুর্থ দল তৃতীয় দলের কাভারে সমগ্র গ্রাম তল্লাশী চালায়। এদিন ব্যাপক ধরপাকড় ও অত্যাচার নিপীড়নের পর বিকাল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানিরা বড়কামতা ত্যাগ করে। পরবর্তী সময় তারা আর কোনােদিন বড়কামতায় আসেনি। বড়কামতা, বাগমারা, ফাগুণ্ডা এলাকা স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ গুপ্তাশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুদ্ধের ফলাফল বড়কামতার যুদ্ধ অনেক খণ্ডযুদ্ধ ও প্রতিরােধমূলক যুদ্ধের সমষ্টি। এসব যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা অনেক সময় আংশিক সাফল্যলাভ করেছেন। আবার পাকিস্তানিরাও ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায় গ্রামবাসীর ওপর। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ নিম্নরূপ: ১. সঠিক কারণ ও দেশপ্রেম: যুদ্ধের সঠিক কারণ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকাবাসী একত্র হয়েছিল এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল। সুসজ্জিত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সে প্রতিরােধ যত নগন্যই হােক না কেন ইতিহাসের পাতায় এ প্রতিরােধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উদ্যোগ: মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীর এ সম্মিলিত প্রতিরােধে গ্রামবাসীর উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে সাধারণ গ্রামবাসী নিজেদের যা কিছু আছে, তা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ কারণেই কিছু সময়ের জন্য হলেও তারা পাকিস্তানি আক্রমণকে প্রতিরােধ করতে পেরেছিল।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা সমগ্র বড়কামতা ও বাগমারা অঞ্চলের গ্রামবাসীর পাশাপাশি যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন: মনির মাস্টার, নায়েব সুবেদার আফজাল, হাবিলদার গিয়াস, মাে. আব্দুর রব, মাে. সাইদ, নায়েক তাহের, সিপাহি কালু মিয়া, হাবিলদার বাদশা মিয়া, সিপাহি বিল্লাল, সিপাহি তাহের, সিপাহি মাে. খােরশেদ আলম ও আব্দুল বারেক প্রমুখ। উপসংহার। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের সাধারণ জনগণ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল এবং একই সাথে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতােভয় সদস্যরা তাদের যে ধৈর্য প্রদর্শন করেছিল, তা ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ছােটো কলেবর হয়েও বড়কামতার যুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উল্লেখযােগ্য অংশ। (বড়কামতার যুদ্ধের নকশাটি ৮৫৮ পাতায় দেখুন)

 

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড