You dont have javascript enabled! Please enable it! চাপিতলার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
চাপিতলার যুদ্ধ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান বা স্থান পরিচিতি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক থেকে ১৮ মাইল দূরে কোম্পানিগঞ্জ। কোম্পানিগঞ্জ থেকে কাঁচা রাস্তায় প্রায় ১৩ মাইল দূরে নবীনগর। কোম্পানিগঞ্জ থেকে নবীনগর যেতে মাইল তিনেক পরে রাজা চাপিতলা গ্রাম। যুদ্ধের পটভূমি। নবীনগর যেতে নৌপথ ছাড়া আর কোনাে বিকল্প পথ ছিল না। নবীনগর তাই তখনাে ছিল শত্রুমুক্ত। পরবর্তী সময় নবীনগর দখলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিরা। কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি পাকা করার পরিকল্পনা নিয়ে ইট বিছাচ্ছিল। সড়কটি পাকা করার কাজ বন্ধ করতে ক্যাপ্টেন হায়দারের পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযােদ্ধা কামরুল হাসান ভূইয়া এক কোম্পানির অধিক জনবল নিয়ে চাপিতলায় আরশী নদীর উত্তর পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্থানের গুরুত্ব কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান যাতায়াত পথ (Induction Road) ভারতের মনতলা বা কোণাবন, আখাউড়ার মনিয়ন, আখাউড়ার দক্ষিণে রেল কালভার্টের নিচ দিয়ে উজানীসরের বিল, বিল হয়ে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে তন্তুর সেতুর নীচ দিয়ে অদের খাল। অদের খাল মালাই বাঙ্গোরা বাজারের কাছে কোম্পানিগঞ্জনবীনগর সড়ক বিভক্ত করে রামচন্দ্রপুর এবং পরবর্তী সময় বিভিন্ন স্থান সংযােগ করে। কুমিল্লা ও নােয়াখালীর কিছু অংশ ছাড়া ঢাকা, ফরিদপুর এবং ২ নম্বর সেক্টরের বাকি এলাকাগুলােয় পৌছবার এটাই ছিল প্রধান পথ। কাজেই কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি পাকা করা হলে গুরুত্বপূর্ণ এ যাতায়াত পথটি বন্ধ হয়ে যাবে।
যেহেতু নৌপথ ছাড়া নবীনগর পৌছানাের কোনাে বিকল্প পথ ছিল না, সেহেতু নবীনগর ছিল তখনাে মুক্তাঞ্চল। সড়কটি পাকা হলে নবীনগর থানায় নিশ্চিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ঘটবে। উভয় বাহিনীর অবস্থান যুদ্ধের সময় উভয় বাহিনীর অবস্থান ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ১ কোম্পানির অধিক (নিয়মিত সৈনিক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, ইপিআর, এমওডিসি ও গণযােদ্ধা সমন্বয়ে)। মুক্তিবাহিনীর ১ কোম্পানির অধিক জনবল চাপিতলায় (পেছনে কোনাে সেনাদল না। রেখে) এক সারির প্রতিরক্ষা অবস্থান (Linear Defence) নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী: ১ ব্যাটালিয়ন (ইপিসি একসহ)। কোম্পানিগঞ্জে পাকিস্তানিরা বাংকার খনন করে আনুমানিক ১ কোম্পানি জনবলের সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। যুদ্ধের বর্ণনা। নবীনগর দখলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিরা কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি পাকা করার পরিকল্পনা নিয়ে ইট বিছাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন হায়দার এক সকালে মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে মুক্তিযােদ্ধা কামরুল হাসান ভূঁইয়াকে ডেকে বলেন যে, কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি পাকা করার কাজ বন্ধ করতে হবে। পরবর্তী সময় চূড়ান্ত নির্দেশ দিলেন সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ। | বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণের মুখে কীভাবে দাউদকান্দি-ময়নামতি সড়ক বিস্ফোরক ও মাইন ব্যবহারে অকেজো করে দিতে হবে এবং কবে নাগাদ। চূড়ান্ত আক্রমণ রচনা করা হতে পারে, বললেন তিনি। মুক্তিযােদ্ধা কামরুল তার এক কোম্পানির অধিক জনবল নিয়ে চাপিতলায় এক সারির প্রতিরক্ষা নেন। প্রতিরক্ষার সম্মুখে আরশী নদীর ওপর অবস্থিত ব্রিজটির দুই পার্শের মাটি কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। পাকিস্তানিরা ৭ নভেম্বর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে।
পড়ন্তবেলায় একটি ছেলে দৌড়ে এসে মুক্তিযােদ্ধা কামরুলকে জানায় যে, পশ্চিম দিক থেকে শত্রু আক্রমণ রচনা করছে। শত্রুরা এফইউপি। ছেড়ে অ্যাসল্ট ফরমেশনে প্রচণ্ড ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসে। | অধিনায়ক চিকার করে সর্ব ডানের প্লাটুন অধিনায়ক ইপিআর-এর। হাবিলদারকে বারবার ফায়ার করতে বলেন, কিন্তু কেউ শুনলেন না। অন্ধকার হয়ে আসছিল তখন। অধিনায়ক আদেশ দিলেন কালক্ষেপণ না করে সবাইকে পশ্চাদপসরণ করে উত্তরে বাঙ্গোরা-খামারগাঁও এলাকার পূর্বে প্রস্তুতকৃত বিকল্প প্রতিরক্ষা এলাকায় অবস্থান নিতে। চাপিতলা প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পি-৮০ স্মােক গ্রেনেড ফাটিয়ে ধুম্রজালের আড়ালে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পশ্চাদপসরণে সক্ষম হয়। বিকল্প। প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল দক্ষিণ বঙ্গোরা, খামারগাঁও ও খাপুরা গ্রামের অংশ জুড়ে। রাতের অন্ধকারে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের ফলে শক্র মুক্তিবাহিনীর। প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেনি। শত্রুর সম্ভাব্য আগমন পথে মাইন। দ্বারা বুবি ট্র্যাপ লাগানাে হয়েছিল। দিনের আলাের মতাে ফকফকে জ্যোৎস্না হলেও রাত ৩টার দিকে শত্রু আবার প্রতিরক্ষার ঠিক সামনে থেকে আক্রমণ। করে। শত্রু এফইউপি ছেড়ে ২০০ গজের মতাে এসেছিল, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যকর ফায়ারে টিকতে না পেরে আক্রমণ থামিয়ে ধানক্ষেতে অবস্থান। নিয়েছিল। ধানক্ষেতে বহু নিহত ও আহতদের ফেলে তারা আবার চাপিতলা গ্রামে ফেরত যায়। তৃতীয় আক্রমণ আসে পরদিন (৮ নভেম্বর) সকাল ৯টায়। বিকল্প প্রতিরক্ষা অবস্থানে ডান দিক থেকে অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে শত্রু আক্রমণ করে।
মুক্তিযােদ্ধারা তখন সতর্ক ও তৈরি। দিনের আলােয় রচিত এ আক্রমণ সহজেই ব্যর্থ করা যেত। প্রচুর হতাহত হয় শত্রুর। কিন্তু এতক্ষণে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের গুলি ফুরিয়ে আসে। মুক্তিযােদ্ধারা অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে ফায়ার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলে অযথা গুলি করে গুলি শেষ করে ফেলে। অতিরিক্ত গুলি সংগ্রহ করতে সেক্টর সদর দপ্তর মেলাঘর যেতে হবে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে না ছিল সে সুযােগ, না ছিল সে সময়। শত্রুর অব্যাহত এ আক্রমণের মুখে কামরুল সকলকে আদেশ দেন পশ্চাদপসরণের জন্য। আক্রমণরত শত্রু তখন ৩০০-৪০০ গজ দূরে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। তারা অলৌকিকভাবে সুশৃঙ্খলভাবে পশ্চাদপসরণ করে। যুদ্ধের ফলাফল চাপিতলার যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ২জন অফিসার এবং আনুমানিক ৫৫জন সৈনিক মারা গেছে। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ কিছু রাজাকারের মৃতদেহও ছিল। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ ও সার্বিক মূল্যায়ন চাপিতলা প্রতিরক্ষার রণকৌশলগত দিক ও বৈশিষ্ট্যগুলাে হলাে: ১. প্রতিরক্ষাটি ছিল এক সারির প্রতিরক্ষা (Linear Defence)। কোনাে গভীরতা বা পেছনে কোনাে সেনাদল না রেখেই প্রতিরক্ষা অবস্থান। নেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল একটা মারাত্মক ভুল। প্রতিরক্ষাটি ছিল অত্যন্ত আড়ষ্ট প্রতিরক্ষা (Compact Defence)। ৩. বেতার বা লাইন যােগাযোেগ ব্যবস্থার অভাবে প্রতিরক্ষার ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। শত্রুর আগমন সম্বন্ধে সংবাদ দেওয়ার জন্য পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল ও অনির্ভরশীল। ৫. পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে একপর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও তার জন্য কোনাে কার্যকর ও সুষ্ঠু আদেশ দেওয়া হয়নি। ৬. কাজের বিবেচনা ও তদানুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করা হয়নি। ৭. মূল প্রতিরক্ষার একটি বিকল্প প্রতিরক্ষার অবস্থান তৈরি ছিল, যা ছিল একটি ইতিবাচক দিক। ৮. চাপিতলায় আরশী নদীর ওপর সেতুটি অকেজো করায় শত্রুকে কাঙ্ক্ষিত পথে আনতে সময় লেগেছিল।
উপসংহার
বিভিন্ন স্তরের লােকের সমন্বয়ে নেওয়া এটি একটি বিরল প্রতিরক্ষা। জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক অসাধারণ যুদ্ধ। ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান যাতায়াত পথকে কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়ক বিভক্ত করে পরবর্তী সময় বিভিন্ন স্থান সংযােগ করে। সড়কটি পাকা করার কাজ বন্ধ করতে মুক্তিযােদ্ধা কামরুল হাসান ভূঁইয়া চাপিতলায় প্রতিরক্ষা নেন। কাজেই সামরিক দিক থেকে চাপিতলার যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
(চাপিতলার যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ৮৫৯ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড