You dont have javascript enabled! Please enable it!
প্রাথমিক প্রতিরােধ
২৫ মার্চের পূর্বেই কুমিল্লা শহরের রাজনীতিক ও ছাত্র জনতা সামরিক প্রশিক্ষণের আয়ােজন করে। ঢাকার কাছে অবস্থিত হওয়ায় মার্চের উত্তপ্ত ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক প্রভাব কুমিল্লার ওপর পড়ে। ইয়াহিয়ামুজিব সংলাপ অচলাবস্থার সংবাদ যথাসময়ে কুমিল্লায় পৌছে যায়। কুমিল্লা এলাকার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য (এমপিএ) আবদুল মালেক সম্ভাব্য প্রতিরােধযুদ্ধ ও অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের সাথে আলােচনা করেন। সামসুল হক, সিএসপি তখন। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এবং কবিরউদ্দিন, ডিএসপি পুলিশ। দেশ অন্তপ্রাণ এ দুই অসম সাহসী কর্মকর্তা তাদের সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযােগিতার আশ্বাস দেন। পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র দ্বারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। রাজনীতিকেরা। শহরের মডার্ন প্রাইমারি স্কুলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা আফজাল খান আয়ােজনের এবং অ্যাপ্রেনটিস। স্কুলের ক্যাডেট রেজাউল আহমেদ অস্ত্র প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময় কুমিল্লা মহিলা কলেজ, ভিক্টোরিয়া কলেজ ও কুমিল্লা গভর্নমেন্ট। কলেজসহ বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
যুদ্ধ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিল না উদ্যোগী ব্যক্তিদের। কিন্তু দেশপ্রেমের প্রণােদনা এঁদের প্রাণ বিসর্জনের জন্য উদ্দীপ্ত করেছিল। এ সাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে কুমিল্লা শহরে আগত রাস্তায় এবং শাসনগাছা রেলক্রসিংয়ে ব্যারিকেড স্থাপনসহ সাধ্যমতাে সবকিছুই করেন। তাদের ধারণা ছিল না, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে একটি নিয়মিত প্রতিষ্ঠিত বাহিনীর কাছে এসব কোনাে প্রতিবন্ধকতাই নয়।  জেলা প্রশাসক ও ডিএসপি পুলিশকে পাকিস্তানিরা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৯ মার্চ তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে জনৈক বাঙালি অফিসার নিজের নাম উল্লেখ না করে টেলিফোনে কুমিল্লা শহরের এমপি আব্দুল মালেককে জানান যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে রাতে কুমিল্লা শহর আক্রমণ করবে, তারা যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেন। রাজনীতিবিদেরা এ খবর পুলিশ লাইনে পৌছে দেন। পুলিশ সদস্যরা রাইফেল দিয়ে সেনা আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তােলেন  পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। পুলিশ বাহিনী তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে প্রতিরােধের চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের প্রবল গুলির মুখে পুলিশের এ প্রতিরােধ মুহূর্তেই। ভেঙে যায়। পাকিস্তানিরা পুলিশলাইনে হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহরের রামমালা এলাকায় আনসার ক্যাম্পেও আনসারদের তারা হত্যা করে। ২৬ মার্চ সব মৃতদেহ পাকিস্তানিরা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। বস্তুত কোনাে কার্যকর প্রতিরােধ ছাড়াই কুমিল্লা শহরের পতন ঘটে। ২৬ মার্চ কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানিদের প্রবেশের পর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এবং প্রতিবাদী ছাত্র জনতা শহরের ৮-৯ কিলােমিটার উত্তরে কোটেশ্বর গ্রামে সমবেত হয়।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ওয়াহিদুর রহমান কোটেশর প্রাইমারি। স্কুলে সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ক্যাডেট রেজাউর রহমানকে (লেফটেন্যান্ট রেজা নামে সমধিক পরিচিত) দায়িত্ব দেওয়া হয় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) সাথে অস্ত্র ও গােলাবারুদ প্রদানের সাহায্য চাইবার জন্য। ২ এপ্রিল লেফটেন্যান্ট রেজা সীমান্তের ওপারে বিএসএফ-এর সাথে যােগাযােগ করেন। বিএসএফ-এর মেজর চৌহান, মেজর আব্রাহাম, মেজর ভারত ভূষণ, ক্যাপ্টেন আরিফ ও ক্যাপ্টেন চাওলা তাকে সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস দেন। অবশ্য তারা তক্ষুণি অস্ত্র, গােলাবারুদ প্রদানের অক্ষমতা প্রকাশ করেন। তাঁরা জানান যে, তারা এ বিষয়ে তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমােদন নিয়ে শীঘ্রই অস্ত্র ও গােলাবারুদ সাহায্যের ব্যবস্থা করবেন। তারা ত্রিপুরা বিএসএফ-এর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সাথে যােগাযােগ করেন। বিএসএফ পরােক্ষ সমর্থন। দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।  পরবর্তী সময় ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলােয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কর্নেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মােহাম্মদ আব্দুর রব (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মােহাম্মদ রেজা, মেজর কাজী নূরুজ্জামান (অব.), মেজর কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরী, মেজর সাফায়াত জামিল, মেজর নুরুল ইসলাম এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।  মেজর জিয়াউর রহমান ৩ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার এলাকায় হরিণা ও বেলােনিয়ায় অতিরিক্ত সৈন্যের প্রয়ােজনে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তেলিয়াপাড়া ত্যাগ করেন। মেজর জিয়া ৫ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া ফেরত আসেন। এ সম্মেলনের আলােচনা ও সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবগত থাকেন। ভারতীয় বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এ সম্মেলন আয়ােজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
বিবির বাজারের যুদ্ধ
ভূমিকা কুমিল্লা শহরের ৫-৬ কিলােমিটার পূর্বে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার নাম। বিবির বাজার। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশে বিবির বাজার এলাকায় ১ কোম্পানির অধিক সৈন্য দিয়ে বিবির বাজারে। প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলা হয়। কুমিল্লা বিবির বাজার সড়কের উত্তরে প্রায় । সমান্তরালভাবে গােমতী নদী পূর্ব দিক দিয়ে বিবির বাজারের কাছে দক্ষিণে মােড়। নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। গােমতী নদীর এ বাঁক ঘেঁষেই প্রধানত এ প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলা হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরােধের প্রথম। পর্যায়ের প্রতিরক্ষা অবস্থান এটি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর। সদস্য ছাড়াও বহুসংখ্যক ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী এ প্রতিরক্ষায় অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধ করেন। মাত্রাগত কারণে তাই বিবির বাজার যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম, সাফল্যের বিচারেও অনন্য। | বিবির বাজারের এ প্রাথমিক প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে ৭৪’-এ এক সাক্ষাৎকারে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বলেন যে, “সব বিস্তীর্ণ মুক্ত এলাকা আমাদের ছিল, সব এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করার মতাে সৈন্য ছিল না।
সে জন্য যেখানে পাকিস্তানিদের অবতরণের এবং আক্রমণের বেশি সম্ভাবনা, সেই জায়গাগুলােতে ডিফেন্স নেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। এ সময় জানা যায় যে, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্টের জনা পঞ্চাশেক সৈন্য যারা কুমিল্লার দক্ষিণে জাঙ্গালিয়া ইলেকট্রিক। গ্রিড স্টেশনে প্রহরায় ছিল, সেই সৈন্যরাও ২৫ মার্চের পর নিকটবর্তী একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে এবং নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থাতে তাদের কাছে লোেক পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের আরও দক্ষিণে গিয়ে লাকসাম ও কুমিল্লার মাঝখানে লালমাই পাহাড়ের মধ্যপ্রান্তে টেমপল পাহাড় নামক এক । জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ার নির্দেশ দেয়। তাদের ওপর এ নির্দেশ ছিল যে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানিরা লাকসাম, নােয়াখালী কিংবা চাদপুরের দিকে অগ্রসর । হলে তাদের যেন অ্যামবুশ করা এবং বাধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে খবর আসে, আখাউড়া, কসবা, বুড়িচংখােলায় পাকিস্তানি সেনারা। ইপিআর পােস্টগুলােতে বাঙালি ইপিআরদের বিরুদ্ধে এখনও লড়াই করে যাচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে কিছু সৈন্যসহ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে পাঠানাে হয়, যাতে বাঙালি ইপিআরদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে ঐসব পােস্টগুলাে পাঞ্জাবিদের। কবল থেকে মুক্ত করা যায়।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং স্থানীয় জনসাধারণের সম্মিলিত হামলায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের পর পাঞ্জাবিরা ঐসব অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ঐসব খণ্ডযুদ্ধের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার গোমতী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা মুক্ত করতে সমর্থ হয় এবং কুমিল্লা শহরের বিবির বাজার নামক একটা জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলা হয়। ১৪-১৫ এপ্রিল আখাউড়ায় পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে আবার আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে তাদের ২৫জনের মতাে হতাহত হয় এবং পাকিস্তানিরা আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পশ্চাদপসরণ করে। এপ্রিল মাসের শেষে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা থেকে উত্তর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তায় অগ্রসর হয়ে ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স নিয়ে সায়েদাবাদ দখল করে নেয়। পরে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে তারা নিয়মতাবাদ, গঙ্গাসাগর দখল করে নেয়। তখন কুমিল্লার বিবির বাজার এলাকায় যেখানে পাকিস্তানি প্রতিদিন আক্রমণ চালাচ্ছিল, সেখানে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল। ইতােমধ্যে কুমিল্লার বিবির বাজার পজিশনের ওপর পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড আক্রমণ করতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কুমিল্লা শহরের সন্নিকটে দেড় মাইল পূর্ব দিকে অরণ্যপুর শত্রুরা দখল করতে সমর্থ হয়। তখন। ইপিআর-এর ১টি কোম্পানি এবং কিছুসংখ্যক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য দিয়ে বিবির বাজার প্রতিরক্ষাব্যুহ আরও শক্তিশালী করে তােলা হয়। প্রতিরক্ষা। অবস্থানে শত্রু সৈন্যরা বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে। এ অবস্থানটির ওপর শক্রদের লক্ষ্য এ জন্য ছিল যে, প্রতি রাত্রে এখান থেকে ছােটো ছােটো কমান্ডাে পাটি গােমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতাে এবং তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাে।
এখান থেকে অনেক সময় তাদের অবস্থানের ওপর মর্টার হামলাও চালানাে হতাে। এতে প্রায়ই শক্রদের অনেক লােক হতাহত হতাে। অবশেষে একদিন ভােররাতে অতর্কিতে এ পজিশনের ওপর ৩৯তম বালুচ রেজিমেন্ট গােলন্দাজ বাহিনী এবং ট্যাংকের সহায়তায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রথমে শত্রু সৈন্য পূর্ব দিকে আক্রমণ পরিচালনা করে। এ আক্রমণ আমার। সৈনিকেরা নস্যাৎ করে দেয় এবং শত্রুদের অনেক লােক নিহত ও আহত হয়। এরপর শত্রু সৈন্যরা দক্ষিণ দিক থেকে আমাদের পজিশনের ওপরে পেছনে বাম পার্ধে ট্যাংক ও ৩৯তম বালুচ রেজিমেন্টের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ অন্ততপক্ষে ৪-৫ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে শক্রদের। অন্তত ১০০-১৫০জন নিহত বা আহত হয়। কিন্তু ট্যাংক ও গােলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণে এবং পেছন দিক থেকে ঘিরে ফেলার আশঙ্কা থাকায় আমাকে বাধ্য হয়ে এ অবস্থান ছাড়তে হয়। এ যুদ্ধে ইপিআর-এর সৈন্যরা সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান বা স্থান পরিচিতি
বিবির বাজার চৌদ্দগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত কুমিল্লা শহরের আনুমানিক ৫-৬। কিলােমিটার পূর্ব দিকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় বিবির বাজারের অবস্থান। যুদ্ধের পটভূমি বিস্তীর্ণ মুক্ত এলাকা আয়ত্তে রাখা সম্ভব নয় বিধায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যেখানে পাকিস্তানি অবতরণের এবং আক্রমণের বেশি আশঙ্কা সে জায়গাগুলােয় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়া হয়। বিবির বাজার ছিল এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং স্থানীয় জনসাধারণের সম্মিলিত খণ্ডযুদ্ধের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার গােমতী নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা মুক্ত হয় এবং বিবির বাজারে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলা হয়। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঐ স্থানের সামরিক গুরুত্ব বিবির বাজার থেকে প্রতি রাত্রে ছােটো ছােটো কমান্ডাে পাটি গােমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতাে এখান থেকে অনেক সময় তাদের অবস্থানের ওপর মর্টার হামলাও চালানাে হতাে। এতে প্রায়ই পাকিস্তানিদের অনেক লােক হতাহত হতাে। মুক্তিযােদ্ধাদের এ ধরনের চোরাগুপ্তা আক্রমণে ও মর্টারের গােলাবর্ষণে। পাকিস্তানিদের চলাচল ও নৈমিত্তিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।
অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষের ইউনিট ও বাহিনীর বর্ণনা এবং অবস্থান ১. মুক্তিবাহিনী: ২ কোম্পানি (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং স্থানীয় জনসাধারণের সম্মিলিত)। কুমিল্লা-বিবির বাজার সড়কের উত্তরে প্রায় সমান্তরালভাবে গােমতী নদী পূর্ব দিক দিয়ে বিবির। বাজারের কাছে দক্ষিণে মােড় নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে গােমতী নদীর এ বাঁক ঘেঁষেই নদীকে পেছনে রেখে মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ২. পাকিস্তানি: ২ কোম্পানির অধিক ১টি ট্যাংক ট্রপ। পাকিস্তানিরা বিবির বাজার প্রতিরক্ষার পশ্চিমে মাজার এলাকার দুই পার্শ্বে শক্র প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকে যুদ্ধের পরিকল্পনা উভয় বাহিনীর যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ: ১. পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা: বিবির বাজার অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী। কুমিল্লা শহর এলাকার খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনা করতাে। এ তথ্য পাকিস্তানিরা অনুধাবন করে বলে অনুমান করা হয়। কেননা তারা এ প্রতিরক্ষার ওপর তাদের চাপ বাড়িয়ে দেয়।
২. মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা: প্রথমে আবেগের বশীভূত হয়ে এবং জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের (জেসিও) উদ্যোগে বিবির বাজারে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময় এপ্রিলের ৮-৯ তারিখে মেজর খালেদ মােশাররফ অস্ত্র ও জনবলের সমন্বয়সাপেক্ষে এ প্রতিরক্ষা অবস্থান অনুমােদন করেন। এটি ছিল একটি এক সারির প্রতিরক্ষা এবং এখান থেকে বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনা করা হতাে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
সীমান্ত হয়ে কাঠালিয়া নামক স্থানে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। বিএসএফ ক্যাম্প স্থাপনে বিশেষ অবদান রাখে। ক্যাপ্টেন চাওলা, লেফটেন্যান্ট ইন্দ্রজিৎ, সুবেদার মেজর হারদেব সিং বাদশা ইনস্পেকটর বর্মনসহ অনেক অফিসার, জেসিও এবং এনসিও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দুই দলে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথম দলের প্রশিক্ষণের সময়কাল ছিল সংক্ষিপ্ত এবং প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যাও ছিল সীমিত। ৫-৬ এপ্রিলের মধ্যেই এদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করা হয়। এ দলে ছিলেন খােকন, শাহ আলম, শাহজাহান, দেলােয়ার, বাবুল, হাসান, বাহার, শাকিল ও নৃপেন পােদ্দার। এঁদেরকে প্রধানত রাইফেল থেকে এলএমজি ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দলের প্রশিক্ষণ শেষ হয় ৭-৮ মে। এ দলে প্রায় ১৫০জন। প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মােমিন চৌধুরী, মুজিবুল হক, লুর রহমান, খােকন, হাবিব, আউয়াল, আমান, বরজু, সেলিম (১), সেলিম (২), গােলাম হােসেন, দারগ আলী, আইয়ুব আলী, আব্দুল কুদুস, সােবহান, আবদুর রশিদ ও সিরাজ। কাঠালিয়ার এ দুই দলের প্রশিক্ষিত গণযােদ্ধারা প্রায় সবাই বিবির বাজার প্রতিরক্ষায় যােগ দেন। যুদ্ধের বিবরণ পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড আক্রমণে প্রতিরক্ষার বাম দিকের প্লাটুন পশ্চাদপসরণ করে।
বাকি ২ প্লাটুন সাহসের সাথে নিজেদের অবস্থান অক্ষুন্ন রাখে। এ যুদ্ধ দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত চলে। ১১টার দিকে লেফটেন্যান্ট মাহবুব তাঁর ক্যাম্প নির্ভয়পুর থেকে ১ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বিবির বাজারে শক্তি বৃদ্ধি করেন। এর অব্যবহিত পরে মতিনগর ক্যাম্প থেকে লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম আরও ২ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে আসেন। এ শক্তি বৃদ্ধি করা হয় মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশে। শক্তি বৃদ্ধি ও অস্ত্র বৃদ্ধির ফলে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অটুট মনােবলের কারণে সহসাই যুদ্ধের মােড় ঘুরে যায়। লেফটেন্যান্ট মাহবুব তার কোম্পানি নিয়ে দুপুর ১টার দিকে প্রতি-আক্রমণ রচনা করেন। এ প্রতি-আক্রমণে শত্রু অবস্থান দখল না করা গেলেও শত্রুকে প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে বাধ্য করে। যুদ্ধের ফলাফল যুদ্ধের ফলাফল ছিল নিমরূপ: ১. পাকিস্তানি: পাকিস্তানিদের ক্যাপ্টেন যােবায়ের, ক্যাপ্টেন গুলসহ প্রায় ১৫০জন নিহত হয়। শত্রুর বহু অস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিবাহিনী: হাবিলদার জুম্মাখান, ল্যান্স নায়েক আব্দুল কাদের মােল্লা, মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রসহ মােট ৬জন শহিদ হন হাবিলদার ওয়ালী, সিপাহি কুদুস, সিপাহি আইয়ুব আলীসহ ১৪-১৫ জন আহত হন। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ বা সার্বিক মূল্যায়ন এ প্রতিরক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ক্যাডেট রেজা, সুবেদার বিশ্বাস, সুবেদার বশির, হাবিলদার মান্নান, হাবিলদার জুম্মাখান, হাবিলদার ওয়ালী, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার আইয়ুব প্রমুখ। উল্লেখ্য, গণযােদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন গােলাম হােসেন, খােকন, মুজিবুল হক, খােকা, সেলিম, বাবুল, শাহ আলম, শাহজাহান, হাবিব, দেলােয়ার, আফজাল খান প্রমুখ।
উপসংহার
বিবির বাজার থেকে প্রতিদিন একাধিক রেইড/অ্যামবুশসহ বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করা হতাে আমাদের সম্মুখযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে বিবির বাজার একটি কিংবদন্তি। এ যুদ্ধে কেবল শত্রুকেই হতাহত এবং অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করা হয়নি বরং এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা আরও ঋজু ও ঋদ্ধ হয়ে ওঠেন। (বিবির বাজারের যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ৮৫৭ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!