You dont have javascript enabled! Please enable it!
ফুলতলা বাজার রেইড
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানা সদর থেকে ২৬ মাইল পূর্বে ফুলতলা বাজার। অপর দিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ধর্মনগর অবস্থিত। পূর্ব দিকে ১ মাইল পরই ভারত। দক্ষিণ দিকেও মাত্র ৩ মাইল। ফুলতলার দখল বজায় রাখাকে পাকিস্তানি বাহিনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নিয়েছিল। এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি ছাউনি। সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করতাে ৩০জন পাকিস্তানি সেনা। সমাবেশ ঘটিয়েছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্র, প্রচুর গােলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রীর। এখানকার বসর উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় এবং পাশাপাশি এলাকাকে তাদের কুকর্মের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে বেশ কিছুদিন থেকে। অন্যান্য এলাকার মতাে মুক্তিবাহিনী প্রতিরােধ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না, বরং নিকটবর্তী গ্রামগুলােও তাদের হামলার লক্ষ্য হয়ে পড়ে। শারীরিক নির্যাতন করতাে তারা যার তার ওপর। বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত মুক্তিবাহিনী আখ্যায়িত করে যে-কোনাে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে। লুটপাট করতাে গ্রামে, গঞ্জে, বাজারে। টাকাপয়সা থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, মুরগি পর্যন্ত রেহাই পেত না তাদের হাত থেকে। প্রতিটি গ্রাম পাকিস্তানি শত্রুদের আক্রমণের শিকার। তাদের এখানকার অবস্থান পাকাপাকি করার জন্য এবং যাবতীয় দুষ্কর্ম চালানাের জন্য তাদের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে এ দেশীয় সহচরদের। ফলে ক্যাম্প, বাজার, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব বর্তালাে রাজাকারদের ওপর। কোনাে অপারেশন করতে গেলে মুক্তিবাহিনীকে প্রথমেই মােকাবিলা করতে হতাে রাজাকারদের। এ বিবেচনা থেকে এদের পরাস্ত করে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
এ পরিকল্পনার ছিল ২টি অংশ। প্রথমত সরাসরি ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ফুলতলা বাজার থেকে উচ্ছেদ করা, দ্বিতীয়ত রাজাকারদের ধরে নিয়ে যাওয়া। পরিকল্পনা প্রণয়নে ছিলেন মুজাহিদ ও ক্যাপ্টেন আবদুল জলিল মাসুক। এ অপারেশনে প্রায় শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। রাইফেল ও এসএলআর প্রভৃতি প্রচলিত অস্ত্র দিয়েই শুরু হয় তাঁদের অপারেশন। এফএফদের মধ্যে এ অপারেশনের ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােমিত। আসুক, আবদুস সাত্তার, মুকুল দে, কুলেশ চন্দ্র, অরুণ দে প্রমুখও পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাঘনাবাড়ি থেকে মুক্তিবাহিনী ফুলতলা বাজারের প্রায় ১ ফার্লংয়ের মধ্যে এসে আক্রমণ চালায়। কিন্তু পাকিস্তানিদের সহজে হটানাে সম্ভব হয় না। তারাও প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে প্রতিহত করতে থাকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। পরের দিন আবার আক্রমণ। আবার পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ। এভাবে কয়েক দিনব্যাপী আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চলতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীকে উচ্ছেদ করা সম্ভব না হলেও তাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন। করা হয়। এদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা হয় ডিসেম্বরে যৌথ আক্রমণের মাধ্যমে।
ফুলতলা চা-বাগান রেইড
ফুলতলা চা-বাগান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার এক প্রান্তে অবস্থিত। তারপরই ভারতীয় সীমান্ত। এ বাগানে পাকিস্তানি বাহিনী একটি ঘাঁটি তৈরি করে। শক্তি-সামর্থ্য ও সংহত করে যথেষ্ট পরিমাণে। নিরীহ চা শ্রমিকেরা তখন তাদের নির্যাতনে ঘরবাড়ি ছেড়ে পলাতক। বস্তিতে ও কুলি লাইনে থেকে যাওয়া বাদবাকি লােকজনের ওপরও চলে তাদের অমানুষিক অত্যাচার। এ অত্যাচারের কাহিনী ভারতীয় ভূখণ্ডে ১ দিনে পৌছে যায়। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর কর্মকর্তারা এদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করেন। ঠিক করেন আক্রমণের দিনক্ষণ। দিনটি ছিল ১৫ অক্টোবর। ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। সঙ্গে তাদের প্রচলিত হালকা ধরনের অস্ত্র ও প্রচুর গােলাবারুদ। ২৫জনের মুক্তিবাহিনীর ভেতরে ছিল পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানিও তৈরি হলাে। গণবাহিনীর। অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাসুক আহমেদ। আর তার সহকারীরা ছিলেন যথাক্রমে আবদুল মােমিত আসুক, দেবাশীষ মজুমদার (টিপু), আজমল আলী, মােবারক আহমেদ ও গৌরাঙ্গ দেব প্রমুখ। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বাগানে প্রবেশ করেন। চাগাছের মনােমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলােকন করে অগ্রসর হতে থাকেন তারা। এভাবে একসময় পৌছে যান তারা নির্দিষ্ট স্থানে। চূড়ান্ত করা হয় প্রস্তুতি, তারপর রাত ৪টায় তারা আক্রমণ করেন পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। যুদ্ধ চলে পরদিন ১১টা পর্যন্ত। যুদ্ধে কমপক্ষে ২৫জন শত্রু প্রাণ হারায়। আহত হয় অনেকে। মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সাতগাঁও অপারেশন
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে সাতগাঁও অবস্থিত। হবিগঞ্জ জেলার রশিদপুর থেকে মৌলভীবাজার জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত রেললাইনটি সাতগাঁও হয়ে কমলগঞ্জ গিয়েছে। অক্টোবর মাস। মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন দলে দেশের ভেতরে প্রবেশ করছেন। ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রায় বিভিন্ন শক্রর অবস্থানের ওপর মুক্তিযােদ্ধারা আঘাত হানছেন। সময়সুযােগমতাে আক্রমণ করছেন পাকিস্তানি শত্রুদের ওপর এবং দখল করছেন পাকিস্তানিদের একটির পর একটি ঘাঁটি। ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন রাতাছড়া ক্যাম্প থেকে এ ধরনের ২টি দল সাতগাঁও মান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। ২৪জন মুক্তিযােদ্ধার প্রথম দলের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা আবদুল ওহাব চৌধুরী ও রফিক উদ্দিন চৌধুরী (রানা)। প্রতিটি দল ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে সাতগাঁও পৌছে। এখানকার মুক্তিযােদ্ধা গঙ্গেশ বাবুর ছনখলায় আত্মগোপন করে দিন কাটায় তারা। উভয় গ্রুপেরই গন্তব্যস্থল আরও অভ্যন্তরে। প্রথম দলটি আরও ১৫ মাইল ভেতরে হাইল হাওর অতিক্রম করে দিনারপুর চলে আসে। কিন্তু ১ সপ্তাহ দিনারপুরে অতিবাহিত করেও তারা কোনােরকম অপারেশন করতে পারেনি। অন্যদিকে, তাদের অবস্থানের খবরও কিছু কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের নিরাপত্তার প্রতিও হুমকি সৃষ্টি হয়।
দেওয়ান আবদুল ওহাব চৌধুরীর বাড়ি এ এলাকাতেই। তার নিরাপত্তার কোনাে সমস্যা নেই। তাই তিনি এখানেই অবস্থান করতে চান। এদিকে আবদুল মুকিত রানু ফিরে এসে সাতগাঁও অপারেশন করার পক্ষপাতি। অবশেষে তাদের গ্রুপটি ২টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। আবদুল ওহাব কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। মুকিত ও রানু অন্যদের নিয়ে আবার সাতগাঁও রওনা দেন। এর জন্য ১টি নৌকা ভাড়া করে সবাই তাতে চড়ে বসেন। হাইল হাওরের বুক চিরে নৌকায় চেপে অগ্রসর হচ্ছেন মুক্তিযােদ্ধারা। সেই সাথে পরিকল্পনা করছেন সাতগাঁওয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের। এদিকে পাকিস্তানি শত্রুরা নৌকাযােগে মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের সংবাদ অবগত হয়ে যায়। ফলে নৌকা থেকে নামার সাথে সাথেই তারা আক্রান্ত হন। কোনােরকম প্রতিরােধের সুযােগ পাননি তারা। ধরা পড়ে যান সবাই। এখান থেকে তাঁদের সবাইকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় মাইল খানেক দূরে শক্রর ক্যাম্পে। প্রত্যেকের ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায় তারা। আঘাতে আঘাতে মুক্তিযােদ্ধাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। তারপর সেই অবস্থাতেই এখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমঙ্গলে। আবদুল মুকিত, রানু, আবদুস শহিদ সুদর্শনসহ ৮জন মুক্তিযােদ্ধা সেই ক্যাম্পে শহিদ হন। দ্বিতীয় দলটি এ ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেও বারবার ব্যর্থ হয়। অবশেষে তারাও চলে যায় আরও ভেতরে এবং ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ভােগ-বিলাসিতা, আরামপ্রিয়তা এ ধরনের প্রবণতার মূল্য দিতে হয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণ দিয়ে। একজনের ভুল নেতৃত্বের কারণে কঠিন মূল্য দিতে হয় অনেককে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!