সােনাছড়া আক্রমণ
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার অন্তর্গত আলীনগর চা-বাগান। এ বাগানেরই একটি সীমান্তবর্তী অংশ সােনাছড়া। কমলগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৮ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বদিকে এ গার্ডেনটির অবস্থান। আলীনগর বাগানে পাকিস্তানিদের একটা ঘাটি ছিল। আলীনগর সীমান্ত পর্যন্ত টহল দলগুলাে। সােনাছড়া দিয়েই যাতায়াত করতাে। তাই এ অঞ্চলে টহলরত পাকিস্তানিদের। ওপর আক্রমণের একটা পরিকল্পনা করা হয়। মূলত এ রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনী গাড়িতে করে টহল দিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুজাহিদ ক্যাপ্টেন মােজাফফরের নেতৃত্বে ৪০জনের একটি দল গঠিত হয়। এ দলে আরও ছিলেন শফিক আহমদ, মহব্বত আলী, বশির উদ্দিন, মজিবুর রহমান, আওরঙ্গজেব, সুরুজ আলী প্রমুখ। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পর পরই দলটি বের হয়ে পড়ল। অপারেশনের উদ্দেশ্যে। তাদের সাথে ছিল রাইফেল, এলএমজি, অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, বিস্ফোরক এবং ২ ইঞ্চি মর্টার। গাইড হিসেবে ছিলেন চা-বাগানের একজন শ্রমিক। ঐ দিন সারারাত হেঁটে তারা ভারতীয় সীমান্তবর্তী মূর্তিছড়া বাগানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি স্কুলে আশ্রয় নেয়। সারাদিন সেখানে থেকে আবার সন্ধ্যার পর শুরু হয় পথচলা। সারারাত ধরে গাইডের প্রদর্শিত পথ ধরে এগিয়ে চলেন মুক্তিযােদ্ধারা। ভোের প্রায় ৩টায় তারা এসে পৌছেন আলীনগরের রাস্তায়, যেখান দিয়ে পাকিস্তানিরা চলাফেরা করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অধিনায়কের নির্দেশিত স্থানে রাস্তায় পোঁতা হয় মাইনগুলাে। পুরাে দলটা রাস্তার ধারে দুটো টিলায় চা-বাগানের মধ্যে মিশে রইল। শুরু হয় অপেক্ষার পালা, প্রায় ৩ ঘণ্টা কেটে যায়।
এ দিকে ভােরের আকাশে উঁকি দেয় সূর্য, অন্ধকার কেটে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। ঠিক তখনই অপেক্ষার পালা শেষ করে দূরে আলী নগরের দিক থেকে পাকিস্তানিদের ১টা জিপ আসতে দেখা যায়। আক্রমণােদ্যত চিতার মতাে সতর্ক হয়ে যান মুক্তিযােদ্ধারা। ধীরে ধীরে জিপটি মাইন পোঁতা স্থানে আসা মাত্রই প্রচণ্ড শব্দে ভােরের স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে বিস্ফোরিত হয় পর পর ২টি মাইন। পুরােপুরি বিধ্বস্ত হয় শত্রুর জিপটি, সাথে গুরুতরভাবে হতাহত হয়। আরােহীরা। জিপটির ঠিক পিছনেই আরেকটি গাড়িতে ছিল আরও কিছু শত্রু সৈন্য। তারা পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে মুক্তিযােদ্ধাদের ফায়ারের। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। একসময় যখন তাঁরা। দেখলেন পাকিস্তানিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিসাধন করতে পেরেছে, তখন আস্তে আস্তে তারা ঐ স্থান ত্যাগ করেন।
হাতমা সেতু ধ্বংস
মৌলভীবাজার জেলার উত্তর-পূর্বে ভারতীয় সীমান্তের কাছে অবস্থিত বড়লেখা স্টেশন থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উত্তর দিকে হাতমা সেতু। এ জায়গায় রেলপথ ও সড়কপথ পাশাপাশি অবস্থিত। উভয় পথে পাকিস্তানি বাহিনী চলাচল করতাে শাহবাজপুর ও সীমান্ত সংলগ্ন চা-বাগানগুলােয়। এ কারণে এ পথের সেতুগুলাে তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রেল ও সড়ক ২টি সেতুই রাজাকাররা সব সময় পাহারা দিত। এ পথে যে-কোনাে একটি সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে শাহবাজপুর এবং পার্শ্ববর্তী চা-বাগানগুলােয় পাকিস্তানি অবস্থানে সকল প্রকার সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তাই মুক্তিবাহিনীর ঐ অঞ্চল মুক্ত করার লক্ষ্যে লাতু-বড়লেখা রেল ও সড়কপথের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হাতমা জায়গাটি বড়লেখা থানা সদর, পুলিশ স্টেশন এবং শত্রুদের এ অঞ্চলের মূল ঘাটিসংলগ্ন বলে ঐ সেতুতে অপারেশন পরিচালনা করলে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা সন্ত্রস্ত হবে। এ বিবেচনায় ধ্বংসের জন্য হাতমাকেই উপযুক্ত সেতু বলে ধরে নেয়া হয়। আর অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় কুকিতল ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর। ১৭ জুলাই কুকিতল ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন শফিকুল হক হাতমা সেতু ধ্বংস করার জন্য রুহুল আহমেদ চৌধুরী বাবু ও আবুল খায়ের চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন হাতমা সেতু অপারেশনে তাঁরা হলেন অধিনায়ক ও সহকারী অধিনায়ক। কুকিতল ক্যাম্প থেকে অপরাহ্নে ৩৪জন মুক্তিযােদ্ধাসহ তারা রওনা হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১টি লরি প্রায় ৪০ কিলােমিটার পথ অতিক্রম করে দলটিকে সীমান্তবর্তী মােকামটিলায় পৌছে দেয়। তাদের সাথে ছিল ৬টি স্টেনগান, ১৪টি .৩০৩ রাইফেল, ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩৮ পাউন্ড।
বিস্ফোরকসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি। পথপ্রদর্শক সিরাজুল ইসলাম সময়মতাে উপস্থিত হন, কিন্তু রাস্তার পুরাে তথ্য তিনি দিতে পারেননি, ফলে ঐ দিন অপারেশন পরিচালনা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের একদিন মােকামটিলায় অবস্থান করতে হয়। পরদিন সহকারী অধিনায়ক আবুল খায়ের চৌধুরী অন্য একজন পথপ্রদর্শক ঠিক করেন। নতুন পথপ্রদর্শক মস্তাকিন আলী চৌধুরীকে নিয়ে অধিনায়ক ও উপ-অধিনায়ক রাস্তায় তথ্য সংগ্রহ করলেন এবং সেই অনুযায়ী অপারেশনের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বিকাল ৩টার দিকে অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন মুক্তিযােদ্ধারা, তবে অসম্ভব সতর্কতার সঙ্গে। পাথুরিয়া পাহাড় অতিক্রম করে সমতল ভূমিতে নামার পরও সন্ধ্যা না হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নেন ডিমাইয়ে। মূল দলকে একটি সাময়িক অবস্থানে রেখে আবুল খায়ের চৌধুরী ও মস্তাকিন আলী চৌধুরী রাস্তা চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করেন। ফিরে গিয়ে মূল দলকে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করেন। এভাবে বেশ কয়েকবার থেমে থেমে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। | হাতমা পুলের কাছে পৌছুতে রাত ১২টা বেজে যায়। সেতু থেকে পূর্বদক্ষিণ দিকে প্রায় ১০০ গজ দূরে একটি বাঁশঝাড় ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী এর নিচে সবার সমবেত হওয়ার কথা। এক এক করে একসময় সবাই সেখানে। সমবেত হন। এ সময় ছাত্রনেতা বেদানন্দ ভট্টাচার্য বিস্ফোরক দ্রব্যভর্তি বাক্স নামানাের সময় জোরে শব্দ হলে সেই শব্দ লক্ষ্য করে সেতু পাহারারত রাজাকাররা গুলি ছুঁড়তে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাবু তাঁদের শান্ত করে পাল্টা গুলি ছুড়তে বারণ করেন। এতে কাজ হয়, রাজাকাররা মনে করে বন্য প্রাণী। শুরু হয় এবার পরিকল্পনামাফিক কাজ।
রেল ও সড়কপথের ২টি সেতুর উভয় পার্শ্বে ৪টি কাট অব পার্টি অবস্থান গ্রহণ করে। রুহুল আহমেদ বাবু ও আবুল খায়েরসহ আরও ৪জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সড়কপথের পুলের দিকে এগিয়ে যান। বাকি সবাই আবদুল মুকিতের নেতৃত্বে বাঁশঝাড়ের নীচে অবস্থান গ্রহণ করেন। সড়ক থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরের অবস্থান থেকে বাবু রাজাকারদের গুলি বন্ধ করতে আহ্বান জানান। তিনি। তাদের আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ঘেরাও করে আছে। রাজাকাররা গুলি বন্ধ করে এবং আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু দিশেহারা রাজাকারদের অসাবধানতাবশত রাইফেল থেকে ১টি। গুলি বের হলে মুকিতের দল ধরে নেয় যে, রাজাকাররা বাবুর গ্রুপের প্রতি গুলি। ছুড়ছে। সুতরাং তারাও সেতু লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। ৪-৫ মিনিট এভাবে গােলাগুলির একপর্যায়ে বাবু গুলি বন্ধের জন্য তাদের কাছে গিয়ে নির্দেশ দিয়ে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে রাজাকাররা পুল ছেড়ে চলে গেছে।
দলনেতা বাবু এবার অপারেশন পরিকল্পনা সংশােধন করেন। রেলপথের পুলে অপারেশন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদেরও সড়কপথের পুলে নিয়ে আসেন। যত কম সময়ে সম্ভব একটি অপারেশন সমাপ্ত করতে চান তিনি। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তাে পাকিস্তানি বাহিনী বড়লেখা থেকে পুলের দিকে অগ্রসর হবে। তাই বাবু, খায়ের, বেদানন্দ ও সুরত আলীসহ মােট ৬জন বাঁশঝাড়ের নিচে রক্ষিত বিস্ফোরক ইত্যাদি বহন করে নিয়ে সেগুলাে পুলে সংযােগ করতে লেগে যান। বাবু সংযােগ করছেন নিচে আর খায়ের ওপরে। এ সময় এক দল পাকিস্তানি সেনা বড়লেখা থেকে অগ্রসর হতে থাকে। আব্দুল মুকিত বিস্ফোরকভর্তি বাক্স রেখে যাওয়ার পথে তাদের মুখােমুখি হলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিজেকে রাজাকার বলে পরিচয় দেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা। অধিনায়কের নাম জানতে চাইলে মুকিত উত্তরে বলেন বাবু। আর রাজাকারদের অধিনায়কের নামও ছিল বাবু। এক কাকতালীয় ব্যাপার। পাকিস্তানি বাহিনী তাই মুকিতের সাথে আর কোনাে কথা না বলে তারা পুলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিস্ফোরক তখনাে সংযােজিত হয়নি। পুলের নিচে অবস্থানরত ৬জনের কাছে ২টি স্টেনগান ৪টি রাইফেল। গ্রেনেড মাত্র ৪টি। তাই নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান মুহূর্তের ভেতর পাকিস্তানি বাহিনীর ১২জন সৈন্য তখন পুলের ৫০ গজের ভেতরে ঢুকে ‘কিয়া হুয়া ভাই সেন্ট্রি’ বলে এগিয়ে আসে। মুক্তিযােদ্ধারা পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।
উত্তেজনায় সবাই কাপছেন। শক্রগুলাে পুলের ওপর উঠতে যাবে, ঠিক সেই অবস্থায় বাবুর হাতের স্টেনগান থেকে নির্গত বুলেটটি বিদ্ধ হয় পাকিস্তানি অধিনায়কের কোমরে। সাথে সাথে খায়ের, বেদানন্দ ও সুরতও গুলি করতে থাকেন। রাস্তার ওপর পড়ে যায় ৩জন পাকিস্তানি সেনা, ছটফট করতে থাকে তারা। আর বাকি ৯জন অপর পাশে অবস্থান নিয়ে গুলি। করতে থাকে পুলের দিক লক্ষ্য করে। এ সময় বাবু ১টি গ্রেনেড ছুড়ে মারলে। আহতদের ওপর পড়ে এবং তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় তাদের ছটফটানি। বাবু। আরেকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন রাস্তার অপর পাশে। খায়েরও ছুঁড়ে মারেন। একটি। তখন গুলি থামিয়ে দেয় শত্রুর দলটি। এ সময় খায়ের তাদের অস্ত্র। উঠিয়ে আনতে যান। একটি রাইফেলে যেই হাত রেখেছেন, অমনি বড়লেখা থেকে পুলের ওপর গুলি বর্ষিত হতে থাকে। একটিমাত্র রাইফেল তুলে নিয়েই তিনি সরে যান। এদিকে দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেন বাবু। তাড়াহুড়াের কারণে সব চার্জ সঠিক জায়গায় লাগানাে সম্ভব হয়নি, তাই পুলটি আংশিক বিধ্বস্ত হয়। এ সময় শক্রর একটি বিরাট দল অগ্রসর হতে থাকে এদিক লক্ষ্য করেই। তাই মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত ঐ স্থান থেকে সরে পড়েন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড