You dont have javascript enabled! Please enable it! ছােটলেখা রেইড,পাবই ২০ ফুটি পুল ধ্বংস,নিশ্চিন্তপুর অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
ছােটলেখা রেইড
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার অন্তর্গত ছােটলেখা, বড়লেখা থেকে প্রায়। ১০ কিলােমিটার দক্ষিণ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথের ওপর অবস্থিত একটি রেলব্রিজ। মুক্তিযােদ্ধারা হাওর প্রান্তর, বনবাদাড় সর্বত্রই বিরাজ করছেন। আঘাত করছেন লক্ষ্যবস্তুর ওপর। সন্ত্রস্ত করে তুলছেন শক্তিশালী পাকিস্তান। সেনাবাহিনীকে। এ সময় ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযােদ্ধা চিত্তরঞ্জন দত্ত। হাজির হন পেঁচার পাহাড় ক্যাম্পে। সীমান্ত বরাবর বিএসএফ ঘাটিতেই এ ক্যাম্প। নির্দেশ দিলেন তিনি তাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ ধ্বংস করে রেল চলাচল। বন্ধ করারও নির্দেশ দিলেন। বললেন, এ দায়িত্ব নিতে হবে পেঁচার পাহাড় ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদেরই। চললাে প্রস্তুতি। এ সাথে জুরীর পাশে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়ে এ সেকশনে রেল চলাচল বন্ধ করার পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়। পথপ্রদর্শক হিসেবে স্থানীয় ৩জন লােককে নিযুক্ত করা হয়। উপস্থিত হলাে নির্দিষ্ট তারিখ ২০ জুলাই। ইতােমধ্যে ২৮জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল তৈরি হয়েই ছিল। অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুলেমান আলী। সহযােগী ফকরুদ্দিন ও এনামুল হক। জুরী সীমান্তের দিকে পথপ্রদর্শকের নির্দেশ অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে তারা। হাতে রাইফেল, স্টেনগান, লাইট মেশিনগান,  বেয়নেট ও গ্রেনেড ইত্যাদি প্রচলিত অস্ত্র এবং প্রচুর বিস্ফোরক দ্রব্য ও গােলাবারুদ।
এসব গােলাবারুদ ও বিস্ফোরকদ্রব্য বহন করে প্রত্যেক। মুক্তিযােদ্ধা অগ্রসর হচ্ছেন সামনের দিকে। পথঘাট সবই তাঁদের অজানা-অচেনা। রাতের আঁধারে একমাত্র ভরসা পথপ্রদর্শক। শুধু তাদের এবং তাদের নির্দেশ অনুসরণ করা ছাড়া কারও কোনাে গত্যন্তর নেই। কিন্তু হঠাৎ করে ২জন পথপ্রদর্শকের কথাবার্তা, চালচলন সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। কেউ কেউ তা বলতেও থাকেন। অথচ এদের সাহায্য ছাড়া অগ্রসর হওয়াও সম্ভব নয়। সবাই সতর্ক দৃষ্টি রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। যে-কোনাে মুহূর্তে গুলি এসে বুক ঝাঁজরা করে দিতে পারে। রাত ৩টায় দলটি ছােটলেখা চা-বাগানে এসে পৌঁছে। এর ভেতর দিয়েই অতিক্রম করে যেতে হবে। অথচ মূল পরিকল্পনায় বাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। কিন্তু পথপ্রদর্শকের আগেই অটোম্যাটিক ফায়ারের শব্দ হলাে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাক গুলি। শুয়ে পড়লেন মুক্তিযােদ্ধারা। ক্রলিং করে যে যেদিকে পারলেন আড়াল।
হলেন। প্রাণরক্ষা করতে সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে পাল্টা আক্রমণ করতে ব্যর্থ হন মুক্তিযােদ্ধারা। একসময় পাকিস্তানি বাহিনীর গােলাবর্ষণ বন্ধ হয়। তাদের ধারণা ছিল মুক্তিবাহিনীর গ্রুপটি হয়তাে মারা পড়েছে অথবা পালিয়ে গেছে। তাই তারা আনন্দ উল্লাস। শুরু করে। এ অবসরে মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত একত্র হন। ৪টার দিকে তারা। পাকিস্তানি ক্যাম্পের কাছাকাছি একটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। তারপর শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ। এবারে অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে। ব্যর্থ হয় পাকিস্তানি বাহিনী। ২জন পাকিস্তানি সৈন্য এবং ৩জন রাজাকার নিহত হয়। বাকিরা অবস্থান ছেড়ে পিছনে পালাতে থাকে।
পাবই ২০ ফুটি পুল ধ্বংস
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী শমসেরনগর বিমানঘাঁটি। বিমানঘাটির প্রায় ১ কিলােমিটার উত্তরে পাবই গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে সিলেট-আখাউড়া রেল সড়ক। রেল সড়কের ওপর পাবই গ্রামের একটি রেল কালভার্ট, যা পাবই ২০ ফুটি পুল নামে পরিচিত। কুলাউড়া, সিলেট, বড়লেখার সাথে শমসেরনগর বিমানঘাটির সঙ্গে যােগাযােগের ক্ষেত্রে সেতু ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাজাকার বাহিনী গঠনের পর থেকেই পাকিস্তানিরা এ সেতুটির পাহারায় তাদের নিযুক্ত করে। ৫-৬জন রাজাকার সার্বক্ষণিক পাহারা দিত রেলসেতুটি। এ ছাড়া গ্রামবাসীদের পালাক্রমে প্রতি রাতে জোরপূর্বক প্রহরায় নিয়ােজিত করা হতাে। শুধু এর মাধ্যমেই পাকিস্তানিরা নিশ্চিত হতে পারেনি, তাই রাতে কয়েকবার তারা পুল এলাকা টহল দিত। এ পুল থেকে প্রায় ৫ কিলােমিটার পূর্ব দিকে মুক্তিবাহিনীর টিলাবাজার ক্যাম্প। মুক্তিবাহিনীর বেশ বড়াে একটা দল এ ক্যাম্পে অবস্থান করতাে। মুক্তিবাহিনীর এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট আলী ওয়াকিউজামান। এ ক্যাম্পের অধিনায়কই পরিকল্পনা করলেন ২০ ফুটি পুল ধ্বংস করার। ২৫ জুলাই এ অভিযানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ অভিযান সফল হলে সিলেট-আখাউড়া সেকশনে রেল চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র ও রসদ পরিবহনে সমস্যার সম্মুখীন হবে, অনেক জায়গায় ক্যাম্প পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, সফল অপারেশন পরিচালনায় স্থানীয় জনগণের আস্থা দৃঢ় হবে এবং বিশ্ববাসীও জানতে পারবে, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার সংবাদ।
শত্রুর মনােবলও দুর্বল হয়ে যাবে। এ অভিযানের নেতৃত্বের ভার। দেওয়া হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মােহাম্মদ আলীকে (মায়া)। এ গ্রুপের অন্যদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা শফিকুর রহমান, বশির উদ্দিন, আবদুর রউফ, আবদুর শুকুর ও ওয়াহেদ আলীসহ ১১জন। প্রত্যেকের সাথে স্টেনগান, গ্রেনেড, বেয়নেট আর সেতু ধ্বংস করার জন্য প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক ও অন্যান্য সামগ্রী। হাবিলদার মায়া অভিযানের আগেই পুল এবং এখানকার নিরাপত্তা। সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য অনুযায়ী তৈরি করলেন চমক্কার একটি পরিকল্পনা। স্থানীয় লােককে পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়ােজিত করা হলাে। | সেদিন ছিল ২৫ জুলাই, রাত প্রায় ২টার দিকে নসিরগঞ্জ বাজার, ভূঁইয়াগাঁও ও পাবইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপটি চৌশাইয়া গ্রামে এসে পৌছায়। এটি ছিল গ্রুপটির চূড়ান্ত মিলনস্থান। এখান থেকে বিভিন্ন পার্টি তাদের নির্ধারিত সরঞ্জামাদি নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় সেতু প্রহরারত রাজাকাররা তাদের দেখতে পেয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারাও পাল্টা জবাব দিতে থাকেন। মায়া মিয়া মনে করলেন, সেতু ধ্বংস করার আর কোনাে সুযােগ থাকলাে না। কেননা, বেশি সময় ব্যয় করলে মনু ও শমসেরনগর থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে আসবে।
ওপরন্ত গােলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। তবুও মরিয়া হয়ে তাঁর দল নিয়ে। অগ্রসর হতে থাকলেন অসীম সাহসী এ সৈনিক। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারা অদম্য গতি আর ‘জয় বাংলা’ হুংকারে রাজাকাররা প্রাণ নিয়ে পালায়। সামনের দিকে এগিয়ে যান দামাল ছেলেরা। ঝটপট লেগে যান ডেমােলিশন গ্রুপের সদস্যরা। দ্রুততার সাথে সঠিক স্থানে স্থাপন করেন বিস্ফোরক দ্রব্য। তারপর আগুন ধরিয়ে দিতেই উড়ে যায় সেতুর একটি পিলার ও একটি গার্ডার। বিচ্ছিন্ন হয় সিলেটের সাথে সারা দেশের রেল যােগাযোেগ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার অল্প। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিরা ঘটনাস্থলে এসে তর্জন গর্জন করে শূন্যে গােলা নিক্ষেপ করলাে কিছুক্ষণ, কিন্তু ততক্ষণে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন।
নিশ্চিন্তপুর অ্যামবুশ
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার নিশ্চিন্তপুর গ্রামটি বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ ভূখণ্ড। কমলগঞ্জ থানা থেকে প্রায় ১৬ কিলােমিটার দক্ষিণে এ সুন্দর ছিমছাম গ্রাম। গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে খরস্রোতা মনু নদ প্রবাহিত পূর্বমুখী হয়ে, আর গ্রামের পূর্ব প্রান্তেই নদীপথ হয়েছে উত্তরমুখী। ফলে গ্রামের দুই দিকেই মনু নদ এবং এ নদই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে। পূর্ব দিকে নদ অতিক্রম করলে ভারতীয় গ্রাম রাঙ্গাউটি এবং দক্ষিণ দিকে কালিপুর। কালিপুর গ্রামেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পটি চাতলাপুর বাগান থেকে স্থানান্তর করা হয়। প্রায় ৩৫০জন মুক্তিযোেদ্ধা এ ক্যাম্পে থাকতেন। আর এঁদের পরিচালনায় সহায়তা করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদ। এ ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনও পরিচালনা করা হয়। আলীনগর পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে ১ কোম্পানি সৈন্য আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কালিপুর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়া যায়। গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিল পাকিস্তানি মেজর রফিক। নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কাছাকাছি এসে বৃন্দারানীর দিঘির পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে তারা। দিঘির পূর্ব ও দক্ষিণ দুই দিকেই নিশ্চিন্তপুর গ্রাম। শক্রর অবস্থানের সংবাদ খুব সহজেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌছে যায়। পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য ক্যাপ্টেন হামিদ সুন্দর একটি পরিকল্পনা করেন। ৭৬জন মুক্তিযােদ্ধাকে ২টি দলে ভাগ করা হয়।
আর দুই দলের নেতৃত্বে থাকেন যথাক্রমে শফিকুর রহমান ও আবদুস সালাম চৌধুরী বাচ্চু। দল ২টি অবস্থান গ্রহণ করেন মনু নদের দক্ষিণ তীরে কালিপুর গ্রামের প্রান্ত ঘেঁষে। এ স্থানে নদটা ঘােড়ার নালের মতাে, তাই খুব সুন্দর অ্যামবুশের স্থান। নদ অতিক্রম করার চেষ্টাকারী যে কাউকেই দিতে হবে চরম খেসারত। তুলনামূলকভাবে হালকা অস্ত্র আর ২ ইঞ্চি মর্টার মুক্তিবাহিনীর সাথে। নদের উঁচু পাড়ের কারণে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি শত্রু। ২৭ জুলাই ভাের প্রায় ৫টা। শত্রুর দলটি উত্তর দিক থেকে অগ্রসর হয়ে মনু নদের বাঁধে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে তখন তাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দ্রুত গতিতে নামছিল নদের দিকে। ইতােমধ্যেই তাদের সাের্সরাবেশকিছু নৌকাও জোগাড় করে রেখেছিল। উদ্দেশ্য তাদের কালিপুর ক্যাম্প আক্রমণ। একে একে সবাই তারা নদের ঢালে নেমে নৌকায় ওঠার জন্য জটলা করছিল। মুক্তিযােদ্ধারা অপর পারে বাঁধের ওপর। পাকিস্তানিরা নৌকায় উঠতে যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে এলএমজি, এসএমজি, স্টেনগান ও ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে এক সাথে গােলা বর্ষণ করতে থাকেন মুক্তিযােদ্ধারা। ৪ ঘণ্টা লড়াই হয় এখানে দুই পক্ষের মধ্যে।
মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিদের পালানাের উপায় পর্যন্ত রুদ্ধ হয়ে যায়। একের পর এক মারা পড়তে থাকে। তারা। নদের ঢালু থেকে ওঠার চেষ্টা করলেই বুকে-পিঠে বিদ্ধ হতে থাকে বুলেট নীচ থেকে তাদের বর্ষিত গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের গায়ে লাগছিল না। ফলে হতাহত হলাে শুধু শত্রুপক্ষ সকাল ৯টার দিকে শত্রুর জীবিত সৈন্যরা কোনােমতে পালাতে সক্ষম হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পায় মেজর রফিক। এ যুদ্ধে শত্রুর দলের শুধু নিহতের সংখ্যাই ২০জনেরও বেশি। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধা আবদুস সােবহান বাবুল শহিদ হন এ যুদ্ধে। পাকিস্তানিরা এ যুদ্ধের ফলাফল থেকে বুঝতে পারে যে, মুক্তিযােদ্ধারা শুধু চোরাগুপ্তা পথেই আক্রমণে সিদ্ধহস্ত নন, সম্মুখযুদ্ধেও তাঁদের জুড়ি নেই। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যদের মধ্যে ছিলেন মনােহর আলী, সােহাগ মিয়া, ইয়াসিন আলী, ইশই, সুন্দর আলী, আজবর আলী, আর্শদ আলী, আহমদ আল শাহ, মনােহর আলী প্রমুখ।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড