You dont have javascript enabled! Please enable it!
গাজীপুর চা-বাগান অপারেশন
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানা সদর থেকে প্রায় ৪ কিলােমিটার পূর্বে। বেশ বড়াে বাগান গাজীপুর। কুলাউড়া থেকে সরাসরি সীমান্তে যাওয়ার প্রায় সব রাস্তাই গিয়েছে গাজীপুর বাগানের ভেতর দিয়ে। তাই এ বাগান এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকারীর পক্ষে সীমান্ত থেকে যে-কোনাে ধরনের সাহায্য পাওয়া সম্ভব, আবার ভেতর থেকে সব ধরনের তথ্য বা দ্রব্যও অর্জন করা সম্ভব। তাই গাজীপুর বাগানের আধিপত্য বিস্তার করাটা পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১-৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। গাজীপুর বাগানে ছিল পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। এখান থেকেই তারা আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এ বাগানের কয়েকটি বাংলাে ছিল নির্যাতনের কেন্দ্র। আশপাশের এলাকা থেকে নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতাে। এ ছাড়া এ ক্যাম্পের অবস্থানের কারণে চুঙ্গাবাড়ি, কৈলাশহর, বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে কুলাউড়া ও বড়লেখা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত হচ্ছিল বাধার সম্মুখীন।
তাই চুঙ্গাবাড়ি। ক্যাম্প থেকে গাজীপুর চা-বাগান দখলের পরিকল্পনা করা হয়। যুদ্ধের সংগঠন ১. পাকিস্তানি বাহিনী: ৩টি কোম্পানি ২২ বালুচ রেজিমেন্ট, ১টি  কোম্পানি রাজাকার। | ২. মিত্রবাহিনী: ১টি কোম্পানি মুক্তিবাহিনী, ৬ রাজপুত রেজিমেন্ট (ভারতীয় সেনাবাহিনী), ৯৯ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেড। গাজীপুরে পাকিস্তানিদের একটি বেশ শক্ত অবস্থান ছিল। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর আবদুল ওয়াহিদ মােগল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেই গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, চুঙ্গাবাড়ি ক্যাম্পের সবাই। এতে অংশ নেবে। প্রায় ৭০জন মুক্তিযােদ্ধা, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আব্দুল মােমিত আসুক। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর এ বিশাল দলকে এ ৬০-৭০জন মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে চিন্তা করে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হরদয়াল সিংয়ের নেতৃত্বে ৬ রাজপুত রেজিমেন্ট এ অপারেশনে অংশ নেয়। ২৯ নভেম্বর চুঙ্গাবাড়ি ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা সাগরনল বাগানে অবস্থান নেন, একই। স্থানে ধর্মনগর থেকে ৬ রাজপুত এসে মিলিত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে। বহুগুণে বেড়ে যায় মুক্তিবাহিনীর মনােবল। ৩০ নভেম্বর পুরাে দলটা। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হরদয়ালের নেতৃত্বে কাকুরা চা-বাগানে প্রবেশ করে। কাকুরা বাগানে ৬০-৭০জন রাজাকার এবং ৫জন পাকিস্তানি একটা অস্থায়ী ক্যাম্প করেছিল। মিত্রবাহিনী বাগানে প্রবেশের পূর্বেই তারা এ তথ্য জানতে পারে এবং কৌশলে কোনােপ্রকার গুলি খরচ না করেই পুরাে দলটাকেই ধরে ফেলে। পরদিন ১ ডিসেম্বর, মিত্রবাহিনী গাজীপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রগামী দল কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথেই শত্রুর দ্বারা তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়। থেমে যায় অগ্রাভিযান।
ঐ স্থান থেকে গাজীপুর ক্যাম্প আর ২-৩ কিলােমিটার পথ। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রাতের বেলা একযােগে আক্রমণ করা হবে। সারাদিন ধরে চলে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হরদয়াল সিং আসুকে সাথে নিয়ে ব্যাপক রেকি করেন। রাতেই ২ কোম্পানি সামনে রেখে আক্রমণ রচনা করা হলাে। প্রথম দিকে যৌথবাহিনী আরও অগ্রসর হলাে, কিন্তু ভােরের দিকে পাকিস্তানি মেশিনগানগুলাে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠায় আর এগােনাে সম্ভব হচ্ছিল না। কর্নেল হরদয়াল একটু সুবিধাজনক অবস্থান নির্বাচন করে পুরাে দলকে সেখানেই অবস্থান করার নির্দেশ দিলেন। ২ ডিসেম্বর রাতে আবারও আক্রমণ করা হয় কিন্তু কোনাে সুফল পাওয়া যায়নি। শত্রু তাদের অবস্থানে অটল থাকে। ৩ ডিসেম্বর ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট মিত্রবাহিনীর সাথে যােগদান করে। অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল এ বি হারলিকর। এদিকে ৯৯ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেড সরাসরি ফায়ার সহায়তা প্রদানের জন্য নিযুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা করা হয়। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী মাসুক ও মােহনলাল সােম মুক্তিবাহিনীর ২টি দল নিয়ে শত্রুর পিছনে অবস্থান নেবেন। এদিকে ভারতীয় ৬ রাজপুত এবং ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট সামনে থেকে আক্রমণ করবে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা পিছন থেকে শত্রুর ওপর আক্রমণ চালাবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে মাসুক ও মােহনলাল তাদের বাহিনী নিয়ে মেরিনা বাগান হয়ে গাজীপুর ক্যাম্পের পিছনে লদরপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেন। রাত ১২টা আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা। হয়। রাত পৌনে ১২টা থেকে ভারতীয় আর্টিলারি পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ শুরু করে। আর্টিলারি ফায়ারের আড়ালে প্রথমে ৬ রাজপুত রেজিমেন্ট ৩ কোম্পানি সামনে রেখে আক্রমণ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের কিছুতেই পরাস্ত করা যাচ্ছিল না। রাত প্রায় ৩টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা পিছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ রচনা করে। কোনােপ্রকার আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না।
করে ভােজালি নিয়ে তারা শত্রু সৈন্যদের বাংকারে নেমে পড়ে। কিছু বােঝার আগেই মারা যায় প্রায় ২০০ পাকিস্তানি। ভাের হওয়ার আগেই বাকিরাও প্রাণ নিয়ে পালায়। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল গুরুতর আহত। কর্নেল হারলিকর এ অ্যাকশনের নাম দেন ‘কুকরি’। ৫ ডিসেম্বর মুক্ত হয় গাজীপুর। এ দিন সন্ধ্যার দিকেই মুক্তিযােদ্ধারা মিত্রবাহিনীসহ কুলাউড়া পেীছালে। উপায়ান্তর না। দেখে কুলাউড়া ছেড়ে পালায় পাকিস্তানিরা। গাজীপুরের যুদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
দত্তগ্রাম রেইড
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার অন্তর্গত শরীফপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দত্তগ্রাম। মনু নদ এখানে আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে প্রায় ২ কিলােমিটার ভেতরে মনু নদর পশ্চিম পাড়ে ছায়াসুনিবিড় সবুজের সমারােহে ঘেরা গ্রাম দত্তগ্রাম। এপ্রিল মাসের শেষ ভাগে পাকিস্তানিদের হত্যাকাণ্ড ও নারকীয় নির্যাতন যখন তুঙ্গে, তখন তারা দত্তগ্রামের মতাে ছােট গ্রামে প্রবেশ করে। এ গ্রামে ছিল মুক্তিযােদ্ধা মায়ামিয়া, তেরা মিয়া ও আরও বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধার বসতবাড়ি। তাই এ গ্রামের ওপর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিশেষ আক্রোশ। তারা গ্রামে প্রবেশ করে চালায় অমানুষিক নির্যাতন আর বেশিরভাগ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তারা গ্রামের অদূরে ক্যাম্প করে এ নির্যাতন চালাতে থাকে। দত্তগ্রামের বিপরীত দিকে ছিল মুক্তিবাহিনীর। কৈলাশহর ক্যাম্প। নিজ গ্রামের ওপর পাকিস্তানিদের এ অমানুষিক নির্যাতন আর সহ্য হয় না মুক্তিযােদ্ধাদের। ৩০ এপ্রিল টিলাবাজার ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর ১৭জনের একটি দল দত্তগ্রামের বিপরীত দিকে মনু নদের পূর্ব তীরে অবস্থান নেয়। তাদের সাথে ছিল ২ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, এসএলআর ও প্রয়ােজনীয় পরিমান গােলাবারুদ। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা সৈয়দ মােখলেছুর রহমান। বিকাল প্রায় ৩টায় মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি এসে পৌছায় ভারতীয় গ্রাম কালীপুরে। এখন মুক্তিযােদ্ধা আর পাকিস্তানি ক্যাম্পের মাঝখানে শুধু মনু নদ। এ অবস্থান থেকে তারা মর্টার ও এলএমজির সাহায্যে গােলাবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর । কিন্তু শত্রু তার প্রত্যুত্তরে কোনাে পাল্টা ফায়ার করেনি।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবারও মুক্তিবাহিনী শুরু করে গােলাবর্ষণ কিন্তু এবারও প্রতিপক্ষ একেবারেই নিশ্ৰুপ। কোনােপ্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ভাবেন যে, শত্রুরা তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়েছে। নিজ মাটি শত্রুমুক্ত করার আনন্দে ভরে ওঠে তাদের বুক। দ্রুত নদ অতিক্রম করে তারা চলে আসেন দত্তগ্রামে পুড়িয়ে দেওয়া নিজেদের ঘড়বাড়ি দেখে তারা হাহাকার করে ওঠেন, হয়ে পড়েন আবেগাপ্লুত ঠিক এ সময় দুই দিক থেকে অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানিরা। হঠাৎ আক্রমণে হতভম্ব হয়ে পড়েন মুক্তিযােদ্ধারা। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়, প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তুমুল গােলাগুলি চলতে থাকে। চারদিক দিয়ে শক্র ঘিরে ফেলে দলটিকে। এর মধ্যে দলের অধিনায়ক ইসলামকে সাহায্যের জন্য নদের ওপারে পাঠান। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর একটা বিরাট দল সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সংঘবদ্ধ এ বিরাট বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায়। বেঁচে যায় ঘেরাও হয়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর দলটি। যদিও দত্তগ্রাম রেইডে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তথাপি এটা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটি বড় ধরনের শিক্ষা। পাকিস্তানিরা বুদ্ধি খাটিয়ে খুব সহজেই মুক্তিবাহিনীর দলটিকে ফাঁদে ফেলে দেয়। ফলে শত্রু তাদের পরিকল্পনার সফলতা পায়। মুক্তিবাহিনীর স্বল্প প্রশিক্ষিত এ দলটির দূরদর্শিতার অভাব ও অনভিজ্ঞতায় ছিল পরাজয়ের মূল কারণ।
চাতলাপুর চা-বাগান ও পালকি সেতু আক্রমণ
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার শরীফপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত চা-বাগান চাতলাপুর। শমশেরনগর থেকে প্রায় ৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাংলাদেশভারত সীমান্তের খুব কাছাকাছি চাতলাপুর চা-বাগান। সীমান্ত থেকে থানা সদর তথা জেলাসদরে যোগাযােগের জন্য এ বাগান একটি জংশন পয়েন্ট। চাতলাপুর থেকে মুরইছড়া প্রায় ১১ কিলােমিটার দূরত্বে। পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলে অবস্থান নেয়ার পর থেকে প্রায়ই এ পথে টহল দিত। ফলে মুক্তিবাহিনীর দেশের ভেতরে প্রবেশ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দেশের ভেতর থেকে শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে খবরদানকারী সংবাদবাহকদের চলাচলেরও অসুবিধা হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে, পাকিস্তানিদের এ রাস্তায় চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমেই পরিকল্পনা করা হলাে, এ রাস্তার ওপর অবস্থিত পালকি সেতু ধ্বংস করতে হবে। এটা করতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর যান্ত্রিক বহরের এ রাস্তায় চলাচল বন্ধ হবে, তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারবে এ রাস্তায় চলাচল নিরাপদ নয়।
২৭ মে রাত ২টা বেজে ৩০ মিনিটে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি প্লাটুন চা-বাগানে প্রবেশ করে। পুরাে দলটিকে ২টি ভাগে ভাগ করা হলাে। একটির অধিনায়ক হলেন শফিকুর রহমান এবং অপরটির আব্দুস সালাম চৌধুরী বাচ্চু। ২টি গ্রুপের কাছেই ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক ও নিজস্ব অস্ত্র। সেতুর। কাছাকাছি গিয়ে দুই দল দুদিক থেকে সেতুটি ঘেরাও করে ফেলে। সেতুর দুই পাশ্বে বড়াে বড়াে বাংকার যার দুটিতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর বাকিগুলােয়। ছিল তাদের দোসর রাজাকার। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান। বা গতিবিধি বুঝতে পারেনি। একটু দূর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা নদীতে নামেন। পানিতে শব্দ না করে সঁতরে চলে এলেন ব্রিজের নীচে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিস্ফোরক বসানাে হলাে। অধিনায়করা পুনরায় পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, সব ঠিক আছে। নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেন মুক্তিযােদ্ধারা, প্রায় একই সাথে বিস্ফোরিত হয় সব বিস্ফোরক, ভেঙে পড়ল পালকি সেতু। বিকট শব্দ আর ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল পাকিস্তানি আর তাদের দোসররা। এ সুযােগে মুক্তিযােদ্ধারা বাংকার লক্ষ্য করে তাদের হাতের গ্রেনেড ছুড়ে মারতে থাকেন। বাংকারের ভেতরই মারা যায় ১জন পাকিস্তানি হাবিলদার আর ১জন রাজাকার, আহত হয় অনেকে। এবার পাকিস্তানিরা গুলি ছুড়তে শুরু করে, কিন্তু। ততক্ষণে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে আশ্রয়ে পৌছে গেছেন।
পৃথমপাশা ডাকঘর রেইড
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার প্রায় ১২ কিলােমিটার দক্ষিণে পৃথমপাশা অবস্থিত। এখানে ছিল পাকিস্তানিদের একটি শক্ত অবস্থান। এ ক্যাম্প থেকেই তারা আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অন্যান্য অপকর্ম চালাতাে। এ ক্যাম্প থেকে পৃথমপাশা ডাকঘরে অবস্থিত টেলিফোন  এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে অন্যান্য স্থানের সাথে টেলিফোনে যােগাযােগ রাখা হতাে।  এ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কারণে শুক্র দ্রুত সংবাদ পৌছাতে পারতাে এবং ১০১৫ মিনিটের মধ্যে কুলাউড়া থেকে অতিরিক্ত অস্ত্র ও সৈন্যের সাহায্য পাওয়া সম্ভব হতাে। তাই সঁড়েরগঞ্জ পাহাড়ের বড়াে কালাইগিরিতে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প অধিনায়ক মজিবুর রহমান এ অঞ্চলে অন্যান্য অপারেশন পরিচালনার পূর্বে এ এক্সচেঞ্জ ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী  মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে ১২জনের একটি দল গঠন করা হয়। ২৪ জুন রাত ৯টায় দলটি ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে, লক্ষ্য পৃথমপাশা  ডাকঘর পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় রাত দেড়টায় দলটি পৃথমপাশা বাজারে পৌছায়। এখান থেকে প্রায় ৩০০ মিটার ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে তারা এগােতে থাকে নবাববাড়ির পাশ দিয়ে, যেখানে পাকিস্তানিরা থাকতাে। অতি সতর্কতার সাথে এ জায়গাটুকু পার হয়ে তারা পৌছায় ডাকঘরের সামনে। প্রহরারত ৫জন রাজাকার হঠাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের দেখে ভূত দেখার মতাে চমকে উঠলাে কিছু করতে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরে তারা অস্ত্র ফেলে পালালাে। মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত ডাকঘরের তালা ভেঙে এক্সচেঞ্জের ট্রান্সমিটারটি খুলে নেন এবং অন্যান্য নথিপত্রও সাথে নিয়ে রওনা দেন। ঠিক এ সময় নবাববাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়। বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলতে থাকে। এর মধ্য দিয়েই। মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। এ গােলাগুলি চলাকালীন ওরফি গ্রামের  একজন কিশাের শহিদ হন।
মুরইছড়া ক্যাম্প আক্রমণ
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার অন্তর্গত মুরইছড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের এলাকায় তাদের নির্যাতন চালাতাে। তা ছাড়া এ ক্যাম্পের খুব কাছেই ছিল মুক্তিবাহিনীর টিলাবাজার ক্যাম্প। মুরইছড়ার কারণে টিলাবাজার ক্যাম্পের কার্যক্রম সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে, মুরইছড়া থেকে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানি বাহিনী সরিয়ে দিতে হবে। এ কাজের জন্য ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে ২৮জনের একটা দল তৈরি করা হয়। ১২ জুলাই মুক্তিবাহিনী তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বের হয় অপারেশনের উদ্দেশ্যে। মেঘাচ্ছন্ন দিন, সন্ধ্যার পর থেকেই পুরাে আকাশ কালাে করে শুরু হলাে বজ্ৰপাত আর ঝড়-বৃষ্টি। প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে এগিয়ে চললেন মুক্তিযােদ্ধারা। রাত ১টা ৩০ মিনিটের দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি পেীছে যায় মুরইছড়ার কাছাকাছি। তাদের সাথে ছিল কিছু হালকা অস্ত্র । দলটি মুরইছড়া থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দক্ষিণে হাওরের মধ্যে অবস্থান নেয় । হাওরের মধ্যে ছনক্ষেত এবং মাঝে মাঝে উচু-নীচু ঢিবির সাথে মিশে তারা আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়। রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর অবস্থান জানার জন্য গুলি ছােড়েন। প্রায় ২০ মিনিট পর পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, তাও খুব জোরালাে কিছু নয়, বিক্ষিপ্ত ২-১টি রাইফেলের ফায়ার। মুক্তিযােদ্ধারা মনে করেন, পাকিস্তানিরা সংখ্যায় খুব একটা বেশি নেই।
আসলে এটা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ধোকা দেওয়ার জন্য শত্রুর একটা কৌশল। রাত প্রায় সাড়ে ৩টায় শক্র সব ফায়ার বন্ধ করে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা ভেবেছিলেন স্বভাবসুলভভাবে পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়েছে। তাই তারা আরও অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের খুব কাছাকাছি চলে আসেন। রাত তখন প্রায় ৪টা, হঠাৎ চারদিক থেকে ‘ইয়া আলী হুংকার করে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। হঠাৎ এ আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান মুক্তিযােদ্ধারা। পরক্ষণেই সংবিত ফিরে পেয়ে মিসির আলী তার এলএমজি থেকে অবিরাম গুলি ছুড়তে শুরু করেন। একই সাথে গর্জে ওঠে সহযােদ্ধাদের হাতের অস্ত্রগুলাে তবে বেশিক্ষণ শক্রকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছিল না, তাই সাহায্য চেয়ে দ্রুত সিগন্যাল। পাঠানাে হলাে ভারতীয় ভূখণ্ডে খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন হামিদ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন মুক্তিযােদ্ধারা। ভাের প্রায় হয় হয়, মুক্তিযােদ্ধারা বুঝতে পারছিলেন যেভাবেই হােক সূর্য ওঠার আগে এখান থেকে বের হতে হবে। দ্রুত তারা দুটো দলে ভাগ হয়ে এক দলের ফায়ারের আড়ালে অন্য দল পিছু হটতে লাগল, প্রায় ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন নিজেদের প্রচেষ্টায়ই। দ্রুত তারা পাকিস্তানিদের আওতার বাইরে চলে আসেন, তখন। মসজিদে ফজরের আজান শােনা যাচ্ছিল আশ্চর্যের বিষয় হলাে, এ অপারেশনে। মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ সামান্যতম আহতও হন নি।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!