You dont have javascript enabled! Please enable it!

ধলই অপারেশন

ধলই বাংলাদেশের অপূর্ব সুন্দর এলাকা। পাহাড় ঘেরা সুশােভিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বললেও যেন কম বলা হবে। ভারত সীমান্তবর্তী এ পাহাড়ি জনপদে ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া ছােট ছােট পাহাড়ি ঝরনা ও নালাগুলাে যে কারাে মন কেড়ে নিতে সক্ষম। মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গল উপজেলাধীন ধলই প্রাকৃতিক দিক থেকে যেমন অনন্য, তেমনি এর ভৌগােলিক গুরুত্ব অপরিসীম। সবুজ চা-বাগানের মাঝে মাঝে পায়ে চলা পথ, কোথাও বাশঝাড়ে ভরপুর পাহাড়ের ঢাল থেকে উচু এলাকা, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না এর সৌন্দর্যের কথা। ওখানকার চা-বাগানগুলাে এলাকাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। জনপদ বলতে বেশিরভাগই হচ্ছে বিস্তীর্ণ চা-বাগান সেগুলােও সমতলের জনবসতি থেকে ভিন্নতর প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে তােলা মানববসতি। চারদিকে চা-বাগান, আশপাশে পাহাড়, মিশ্র বাঁশবাগান, নালা, ছড়া, ছােট ছােট গ্রাম সবই সামরিক কৌশলগত কারণে যাথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ধলই বিওপি ভারত সীমান্ত হতে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে অবস্থিত এর ৩ কিলােমিটার পশ্চিমে ধলই নদী এবং এ এলাকায় ধলই চা-বাগান উত্তরে আছে।

সুদৃশ্য বালিছড়া পাহাড় এবং এর সংলগ্ন ভারতের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দক্ষিণে আছে ছােট ছােট পাহাড়, ঘন জঙ্গল ও নালা। কামালপুরের সঙ্গে মােহনপুর, বালিগাঁও, পাত্রখলা চা-বাগানগুলাে ধলই বিওপি’র আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ধলই হতে একটি রাস্তা ধলই চা-বাগান দিয়ে পূর্বে ভারতের আম্বাসার দিকে গিয়েছে। ধলই চা-বাগান ছিল ফিনলে গ্রুপের মালিকানাধীন একটি চা-বাগান। আরেকটি রাস্তা ধলই থেকে কমলগঞ্জ হয়ে উত্তরে শ্রীমঙ্গলের দিকে গিয়েছে। কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও সিলেটে প্রবেশের জন্য ধলই একটি অতি প্রয়ােজনীয় প্রবেশপথ। সিলেট প্রবেশ করার সামরিক পরিকল্পনা করা হলে ধলই দখল করা অতি প্রয়ােজনীয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালােরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পর মুক্তিবাহিনী পর্যায়ক্রমে নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীতে সংগঠিত হয়। সে সময় কৌশলগত কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারত থেকে যেন মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত প্রবেশপথগুলাে দখল করে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধলই বিওপিকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করা হয়। ধলই প্রতিরক্ষার জন্য ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ৩ কোম্পানির অধিক সৈন্য ও ৯১ মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানি ও টর্চি স্কাউটের ১টি প্লাটুনকে ধলই প্রতিরক্ষার জন্য নিয়ােজিত করা হয়। এদের সঙ্গে অতিরিক্ত মেশিনগান এবং মর্টারও সংযােজন করা হয়। ধলই-শ্রীমঙ্গল রাস্তার আশপাশের এলাকা সুরক্ষিত রাখার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের চৌকি স্থাপন করে। এপ্রিল থেকে প্রায় ৬ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধলই এলাকাকে শক্ত ও মজবুত প্রতিরক্ষা এলাকা হিসেবে প্রস্তুত করে। চারদিকে বাংকার আচ্ছাদিত মেশিনগান পােস্ট ও পরিখা খনন করা হয়। আশপাশের লােকজনকে জোরপূর্বক এনে প্রতিরক্ষা মজবুত করা ও পরিখা খনন করার কাজে নিয়ােজিত করে তারা। ধলই বিওপি, ধলই চা-বাগানের ইমারত, অফিসারদের বাংলাে, কারখানা, কুলি লাইনকে স্ট্রং পয়েন্ট হিসেবে বানানাে হয়। আচ্ছাদিত মেশিনগান পােস্টগুলাে লােহার বিমের সাহায্যে পাকা করা হয়। যাতে মিডিয়াম আর্টিলারির গােলা এগুলােকে ধ্বংস করতে না পারে। প্রতিরক্ষা পােস্টগুলাে চারদিকে ছিল পাঞ্জি (শক্ত বাঁশ দ্বারা নির্মিত ধারালাে শলা, যা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়), মাইনফিল্ড, কাটাতারের বেড়া। মেশিনগান পােস্টগুলাের সামনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধককারী গাছ ও ঝােপজঙ্গল কেটে ফেলা হয় যেন কোনাে অনুপ্রবেশকারী ঢােকামাত্র দৃষ্টিগােচর হয়। প্রতিরক্ষা এলাকার চারদিকে আন্তঃসীমা ও বহিঃসীমা (দুই স্তরে) প্রতিরক্ষা বেষ্টনী স্থাপন করা হয়।

বহিঃসীমায় কাঁটাতারের বেড়া ও পঞ্জি লাগানাে হয় এবং আন্তঃসীমায় কাঁটাতারের বেড়া ও মাইন পুঁতে রাখা হয়। মাইন পোঁতা এলাকা মেশিনগান ফায়ারের রেঞ্জের মধ্যে ছিল। পুরাে এলাকাজুড়ে টেলিফোনের তার স্থাপন করা হয় যেন প্রত্যেকটি অবস্থান থেকে অন্যান্য অবস্থানে অব্যাহতভাবে খবরাখবর প্রেরণ করা সম্ভব হয়। স্থানে স্থানে গতিবিধি নিরূপণের জন্য পােস্ট স্থাপন করা হয়। ২ কিলােমিটার ও ১ কিলােমিটার এলাকাজুড়ে এ প্রতিরক্ষাব্যুহের অন্তর্ভূক্ত হয়। পাকিস্তানিরা এ প্রতিরক্ষাব্যুহকে আক্রমণাত্মক ডিফেন্স হিসেবে প্রস্তুত করে। যেহেতু এলাকাটা চা-বাগান, নালা, ছড়া ইত্যাদি দ্বারা পরিবেষ্টিত, তাই এ এলাকায় আক্রমণ করার জন্য অধিকসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ খুবই কষ্টসাধ্য ছিল এবং কোনরকম সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করেছিল ধলইয়ে একটি বড়াে ধরনের আক্রমণ রচনা করা সম্ভব হবে না। প্রাকৃতিক কারণেই ধলই এলাকা একটি আদর্শ প্রতিরক্ষা এলাকা হিসেবে গড়ে তােলা সহজ ছিল। ফায়ার পাওয়ার দিয়ে চারদিকে রক্ষাব্যুহ তৈরির পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে ধলই এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান কৌশলগতভাবে ক্যামােফ্লাজ করা হয়। এর ফলে তাদের অবস্থানগুলােকে নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা দুরূহ  ছিল।

মােট কত সৈন্য সেখানে অবস্থান করছে এবং কোন অবস্থানে কত সৈন্য আছে তা জানা কঠিন ছিল। ধলই প্রতিরক্ষা এলাকার কাছে গ্রামের লােকজনের চলাফেরা প্রায় বন্ধ করা হয়েছিল বলে এলাকার মানুষের কাছ থেকে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলাের বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া ছিল দুষ্কর।  ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ‘জেড’ ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ এলাকায় তাদের অপারেশন চালু রাখে। তখন তাদের অবস্থান ছিল তেলঢালায়। তারপর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ‘জেড’ ফোর্স সিলেট সীমান্তে আসে। তখন ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে মেজর মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমদ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে খ্যাতনামা অফিসার ছিলেন। তার পেশাগত দক্ষতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বহুল আলােচিত ছিল। নিজেদের জীবন বাজি রেখে মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর মঞ্জুর, মেজর আবু তাহের এবং ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী শিয়ালকোট সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় ১,৭০০ বাঙালি সামরিক অফিসার যারা পাকিস্তানে অবস্থান করছিল তাদের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেছিলেন। আর এ ৪জন হলেন যােগদানকারীদের মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য, সাহসী ও উদ্যমী মেজর মঞ্জুর যিনি শিয়ালকোটে ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি এ পরিকল্পনার অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে এ বিপজ্জনক সীমান্তপথ অতিক্রম করেন ৩জন উল্লিখিত অফিসারের সাথে। মেজর আবু তাহের যিনি পাকিস্তানের কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের সদস্য ছিলেন তিনিও পরে কমলপুরে সম্মুখ সমরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় পাকিস্তানি স্থাপনার সামনে গুরুতরভাবে আহত হন। মেজর মঞ্জুর ৮ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে এ ৪জন অফিসারের অবদান অপরিসীম। মেজর জিয়াউদ্দিন ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আম্বাসা শহর থেকে ৪ কিলােমিটার দূরে একটি উঁচু ভূমিতে ব্যাটালিয়নের ছাউনি স্থাপন করেন। যেহেতু তিনি এ রেজিমেন্টের একজন অফিসার ছিলেন সেহেতু তার আগমন সৈনিকদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। আম্বাসা থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছিল ৩২ কিলােমিটার। এ এলাকাটা সৈনিকদের প্রশিক্ষণের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক ছিল। কামালপুর যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সৈন্য হতাহত হয় এবং রেজিমেন্টে নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের ভর্তি করা হয় ও তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউদ্দিন আম্বাসা থেকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালিয়ে যেতে থাকেন।

প্রশিক্ষণ ও অপারেশন একসাথেই চলতে থাকে। তার ৪জন যােগ্য কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন। এ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুব, ‘বি’ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হাফিজ, ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক লে. কাইয়ুম, ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়ক বজলুল গনি পাটোয়ারী। যুদ্ধের পরিকল্পনা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধলই এলাকায় তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থেকে প্রায়ই ১০৫  মিলিমিটার কামান এবং মর্টার দিয়ে ভারতীয় শহর কমলপুরে গােলা ছুড়তাে। তাদের এ অপারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিল পাকিস্তানের ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ৮৮ মটার ব্যাটারি। গােলান্দাজরা ফিল্ডগান ও মটরগুলাে ধলইয়ের প্রতিরক্ষার পিছনে এনে গােলা ছুড়ত। তাদের ধারণা ছিল যে, এ এলাকাগুলােতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির আছে। এ গােলা নিক্ষেপের জন্য সেই এলাকার বেশকিছু অসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে কমলপুর শহর এবং আশপাশের এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ ভারতীয় সরকারের কাছে নিজেদের অসুবিধার কথা জানায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ধলই থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের উৎখাত করতে না পারলে জনসাধারণের পক্ষে এলাকায় থাকা দুঃসাধ্য হবে। আরও আলােচনা হয়। যে, ভবিষ্যৎ যুদ্ধে শ্রীমঙ্গল এবং সিলেট দখলের জন্য ধলই হবে প্রবেশপথ।

‘জেড’ ফোর্সের সৈনিকদের জন্য সম্মুখ সমরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের যােগ্যতা ও দক্ষতা পরীক্ষার সময়ও এসেছিল। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে ধলই আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ভারতীয় ৪ কোর অধিনায়ক লে. জেনারেল সগৎ সিং ১৯৭১ সালের অক্টোবরে ধলই আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি ধলই দখলের প্রস্তুতির জন্য মুক্তিবাহিনীর ‘জেড ফোর্স’ অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড অধিনায়ক এস ডি এস ইয়াদবকে নির্দেশ দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেডকে বলা হতাে ফ্যান্টম ব্রিগেড। ৪ কোরের অধীনে এ ব্রিগেডটি ছিল একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড। ধলই অপারেশনের জন্য ব্রিগেডটি ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনস্থ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব তার ব্রিগেড নিয়ে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শহর কামালপুরে আসার নির্দেশ পান। মেজর জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব আলােচনা করেন যে, যেহেতু ধলই। কৌশলগত কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, তাই এ এলাকা অতি দ্রুত দখল করা প্রয়ােজন। আলােচনায় পূর্বে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক কয়েকটি যুদ্ধ যেমন কামালপুরে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আক্রমণ ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নকশী আক্রমণ নিয়েও পর্যালােচনা করা হয়। আলােচনা করা হয়। যে, এ যুদ্ধে আক্রমণরত সৈনিকদের পর্যাপ্ত আর্টিলারি সহায়তা দেওয়া হবে, যা পূর্বে দেওয়া হয়নি। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অক্টোবরের শেষেই ধলই মুক্ত করা হবে।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও একটি সভা করা হয়। সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব ও তার স্টাফ অফিসাররা অংশগ্রহণ করেন। ধলইয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংখ্যা কত ছিল তা নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব প্রাপ্ত তথ্য হিসেবে সেখানে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি এবং কিছু সংখ্যক মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের সৈনিক আছে বলে জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়করা দ্বিমত প্রকাশ করেন এবং জানান যে সেখানে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ৩ কোম্পানির অধিনায়ক সৈন্য, আছে এবং মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের ১টি সম্পূর্ণ কোম্পানি আছে। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের এ তথ্য মেনে নেননি। এবং ধলই আক্রমণ করার জন্য ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত দেন। ধলইয়ে সঠিক কত পাকিস্তানি সৈন্য আছে তার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন ছিল, কারণ এলাকাটা অতি নিখুঁতভাবে ক্যামােফ্লাজ করা ছিল এবং বারবার রেকি প্যাট্রল পাঠিয়ে এবং এলাকার লােকজনের কাছ থেকেও বেশি কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিল যে, ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ৩ কোম্পানির অধিক ও মুজাহিদের ১টি কোম্পানি এ এলাকাকে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা প্রস্তুত করেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল অতিরিক্ত মেশিনগান ও মর্টার। পরের কয়েকদিনের যুদ্ধে এটাই প্রমাণ হয়েছিল যে, মেজর জিয়াউদ্দিনের তথ্য সঠিক ছিল এবং এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা করলে ধলইয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কম হতাে এবং স্বল্প সময়ে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হতাে। 

পরবর্তীকালে এ বিষয়ে ধলই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় ৬১ ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডের সঙ্গে আলাপ করা হয়, যিনি ব্রিগেডিয়ার ইয়াদবের আহত হওয়ার পর ব্রিগেড অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জানান যে, ধলই এলাকাতে পাকিস্তানিদের ৩ কোম্পানির বেশি সৈন্য এবং মুজাহিদের ১টি কোম্পানি ছিল। এ বাহিনীর অধিনায়ক ছিল ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জাভেদ। আরও একটি বিষয় ছিল যে, পরবর্তীতে কম সময়ে ধলইয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে যে-কোনাে সময় প্রয়ােজনে অতিরিক্ত সৈন্য আনা পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা সম্ভব ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে সে এলাকায় প্রচুর সৈন্য ও গােলাবারুদ বহনযােগ্য গাড়ি ছিল। চা-বাগানগুলাের কাজে ব্যবহৃত গাড়িগুলাে তাদের যুদ্ধযান হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। নিজেদের প্রয়ােজন অনুযায়ী এগুলাে দিয়ে তারা সৈন্য ও যুদ্ধসরঞ্জাম ব্যবহার করত। পাকিস্তানি বাহিনী ঐ এলাকায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চা-বাগানগুলাের গাড়িসমূহ ছিনিয়ে নিয়েছিল। শ্রীমঙ্গলেও পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য ও যানবাহন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রকৃতপক্ষে ধলই আক্রমণ করার জন্য সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কমপক্ষে ২টি ব্যাটালিয়নের অধিক সৈনিকের প্রয়ােজন ছিল।

অথচ সেখানে মাত্র ১টি ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণের পকিকল্পনা করা হয়, যা অনেক সামরিক বিশ্লেষকের মতে আত্মহত্যার শামিল ছিল। এরপরও আক্রমণ করার জন্য মাত্র ১টি কোম্পানি দক্ষিণ দিক থেকে নিয়ােগ করা হয়, যা। ছিল আরও অসুবিধার কারণ। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একটি মারাত্মক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, পাকিস্তানি বাহিনীর সমস্ত অবস্থান ও প্রতিরক্ষার সমস্ত তথ্যের জন্য সরেজমিনে ‘সি’ কোম্পানিকে দক্ষিণ দিক, যেদিকে বেশির ভাগ প্রতিরক্ষা পজিশন ছিল, সেদিক থেকে আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যাহােক, ভারতীয় অধিনায়কের পরামর্শে মেজর জিয়াউর রহমান এ আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রস্তুত হতে বলেন। মেজর জিয়াউদ্দিন ধলইয়ের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক লে. কাইয়ুমকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ প্রদান করেন। পরিকল্পনা করা হলাে, তিনি নিজে ২টি কোম্পানি নিয়ে পাত্রখলা চা-বাগান এলাকা দখল করবেন এবং তারপরে সেখানে একটি রােড ব্লক স্থাপন করবেন যেন শ্রীমঙ্গল থেকে পাকিস্তানি সৈনিকরা ধলই যুদ্ধে যােগ দিতে না পারে এবং ধলই থেকে যেন সৈন্যরা শ্রীমঙ্গল থেকে পাকিস্তানি সৈনিকরা ধলই যুদ্ধে যােগ দিতে না পারে এবং ধলই থেকে যেন সৈন্যরা শ্রীমঙ্গলের দিকে পালিয়ে যেতে পারে। ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার-ইন-চীফ কর্নেল এম এ জি ওসমানী আম্বাসায় আসেন এবং সৈনিকদের সঙ্গে মিলিত হন। সেই আলােচনায় তাকে ধলই আক্রমণের পরিকল্পনা জানানাে হয় এবং লে, কাইয়ুম তাকে তার কোম্পানির আক্রমণ পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিশদ তথ্য জানান। সামগ্রিক পরিকল্পনার বিষয় জেনে কর্নেল ওসমানী সন্তোষ প্রকাশ করেন। ধলই এলাকা দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা ছিল কঠিন।

এ এলাকা ছিল কিছুটা জলমগ্ন এবং প্রচুর নালা ছিল সেখানে। পরিকল্পনা করার সময় বিবেচনা করা হয় যে, যেহেতু দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করা কঠিন সেহেতু পাকিস্তানিরা সেদিকে বেশি নজর দেবে না। ভাের হবার আগেই আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। এ আক্রমণের পূর্বে আম্বাসা এলাকায় আক্রমণের মহড়া করা হয়। পাত্রখলা চা-বাগান ছিল ধলই বিওপি থেকে প্রায় ২ কিলােমিটার উত্তরে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর রাতে মেজর জিয়াউদ্দিন পাত্ৰখলা এলাকা দখল করবেন এবং তার পর পরই ২৮ অক্টোবর ভাের ৪টার সময় দক্ষিণ দিক থেকে ‘সি’ কোম্পানি দ্বারা আক্রমণ রচনা করা হবে। এরপর থেকে ‘সি’ কোম্পানি ‘জেড’ ফোর্স অধিনায়ক মেজর জিয়ার নির্দেশের অধীনে চলে আসবে। ভাের ৪টার পূর্বে কোম্পানি এফইউপিতে অবস্থান গ্রহণ করবে এবং পূর্ব-পশ্চিম হতে প্রবাহিত একটি অগভীর নালার পাড়ে হবে এফইউপি। ৪টার সময় কোম্পানি এফইউপি অতিক্রম করবে এবং কোম্পানি অধিনায়ক চিৎকার করে কোড শব্দ ‘চড়ে যাও’ বলবেন। কোম্পানি পাকিস্তানি পজিশনের প্রায় ৫০০ গজ দূরে পৌছে যাওয়ার পর ফায়ার অ্যান্ড মুভ করে এগিয়ে যাবে। প্রথম ফেহজে বাম দিক থেকে ৭ নম্বর প্লাটুন শক্রর অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাবে এবং এ প্লাটুনের অধিনায়ক হবেন লে, নূর। ৮ নম্বর প্লাটুন যার নেতৃত্বে থাকবেন নায়েব সুবেদার আবুল হাসেম, টিজে। তিনি তার প্লাটুন নিয়ে ফায়ার । অ্যান্ড মুভ করে এগিয়ে যাবেন। ফায়ার অ্যান্ড মুভ করে এগিয়ে যাওয়ার সময়। ৯ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে অবস্থান করবেন কোম্পানি অধিনায়ক লে. কাইয়ুম।

প্রথম ২টি প্লাটুন শত্রুর অবস্থান দখলের পর ৩ নম্বর প্লাটুন উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে পুনর্গঠন করবে এবং অন্যান্য অবস্থান দখল করবে। এ যুদ্ধে বাংকারগুলাে ধ্বংস করার জন্য ১০৬ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করা হবে এবং মেশিনগানগুলাে ফায়ার অ্যান্ড মুভে এবং পরবর্তীতে পুনর্গঠনে সহযােগিতা করবে। কভারিং ফায়ার অ্যান্ড মুভে এবং পরবর্তীতে পুনর্গঠনে সহযােগিতা করবে। কভারিং ফায়ার মর্টার দ্বারা দেওয়া হবে। এ ছিল ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমর পরিকল্পনা। সিদ্ধান্ত হয় এ অপারেশনে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী ফায়ার সাপাের্ট দেবে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ব্যাপারে কিছু আলােচনা করা যাক। ধলই, শ্রীমঙ্গল, সিলেট এলাকা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের দায়িত্বভুক্ত এলাকা। এ ডিভিশনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর । জেনারেল আব্দুল মজিদ। এ ডিভিশনের অধীনে ছিল ২০২ ব্রিগেড, ৩১৩ ব্রিগেড এবং ২৭ ব্রিগেড। আরও ছিল ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ৮৮ মর্টার ব্যাটারি ও ১৭১ মর্টার ব্যাটারি। ৩১৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে ছিল ২টি পদাতিক রেজিমেন্ট তথা ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ২২ বালুচ রেজিমেন্ট, ১ কোম্পানি টর্চি স্কাউট ও ৯১ মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের ২টি কোম্পানি। এ ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা। ব্রিগেডিয়ার রানা মৌলভীবাজার শহরে তার ব্রিগেড সদর দপ্তরে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং তারপর কামালগঞ্জ থেকে লাতু পর্যন্ত তার পুরাে অপারেশন এলাকা পরিদর্শন করেন।

তিনি ধলই এলাকাকে একটি কি-পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত। করেন এবং তার ব্রিগেডের অফিসারদের বলেন যে, এ এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটি আছে ২৭ ব্রিগেডের এলাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আখাউড়া এবং কসবা। তিনি তার অধীনে সবচেয়ে অভিজ্ঞ রেজিমেন্ট ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ধলইয়ে। প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করার নির্দেশ দেন। তিনি তার অফিসারদের জানান যে, সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে হয়তাে মুক্তিবাহিনী বা ভারতীয় বাহিনী ধলই আক্রমণের চেষ্টা করবে। কারণ এ এলাকাটা তাদের জন্য অতি প্রয়ােজনীয়। তিনি তাঁর এ নির্দেশ গােয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছিলেন। প্রতিরক্ষাব্যুহ আরও শক্তিশালী করার জন্য তিনি ১টি মুজাহিদ কোম্পানি ও টর্চি স্কাউটের সৈনিকদের ধলই পাঠাতে নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এটাও উল্লেখ ছিল যে, মুক্তিবাহিনী ধলই প্রতিরক্ষা আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যস্ত রাখবে এবং এর ফাঁকে মুক্তিবাহিনীর অনেক গেরিলা বাংলাদেশের ভিতর অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে। সুতরাং পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মিত ফাইটিং প্যাট্রল পাঠাতে হবে, ধলইয়ের আশপাশের এলাকা সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং এলাকায় সম্পূর্ণ সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে হবে। সম্ভাব্য আক্রমণের ধারণা থেকে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। বস্তুত ধলইয়ের আশপাশ দিয়ে মুক্তিবাহিনী গেরিলারা সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে কয়েকবার বাংলাদেশে গেরিলা অপারেশনের জন্য প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু সফলকাম হতে পারেনি।

ব্রিগেডিয়ার রানার নির্দেশে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ৩টি কোম্পানি। এবং টর্চি স্কাউট ও মুজাহিদের ১টি কোম্পানি ধলই প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত হয়। এবং এলাকাজুড়ে সুরক্ষিত বাংকার ও পরিখা খননের কাজে নিয়ােজিত হয়। ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ৪র্থ কোম্পানি শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করছিল এবং ধলই আক্রমণ হলে শ্রীমঙ্গল থেকে এ কোম্পানি তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে বলে নির্দেশ ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারদের লিখিত পুস্তকগুলাের মধ্যে এর উল্লেখ আছে যে, ২৯ অক্টোবর ধলই এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সেখানে সৈন্য সাহায্য পাঠানাে যায়নি। আরও উল্লেখ আছে যে, কয়েকবার। চেষ্টা করেও পাকিস্তানি বাহিনী ধলইয়ে পুনরায় সৈন্য পাঠাতে পারেনি। ২৭ অক্টোবর ধলই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আম্বাসা থেকে যাত্রা করে সমাবেশ এলাকার দিকে। সেখান থেকে ধলই অভিমুখে সৈনিকরা অগ্রসর হয়। পরিকল্পনা মােতাবেক ‘বি’ কোম্পানি নিয়ে। মেজর জিয়াউদ্দিনের নির্দেশে মেজর হাফিজ পাত্রখলা চা-বাগান এলাকা দখল। করেন এবং সঙ্গে থাকেন ক্যাপ্টেন মাহবুব। এ স্থানটি ধলই বিওপি হতে প্রায় ২ মাইল উত্তরে। ‘ডি’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে পাত্রখলার ১ মাইল।

উত্তরে পাকা সড়কে রােড ব্লক স্থাপন করেন যেন শ্রীমঙ্গল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা ধলই পৌছতে না পারে। ইতােমধ্যে পরিকল্পনা মােতাবেক ধলইয়ের দক্ষিণ দিক থেকে লে. কাইয়ুম এফইউপি অতিক্রম করেন। শুরু হয় এ অসম যুদ্ধ। | ধলই থেকে কোনাে পাকিস্তানি সৈন্য পালিয়ে আসে কিনা কিংবা শ্রীমঙ্গল থেকেও কোনাে পাকিস্তানি সৈন্য আসে কিনা পাত্রখলায় অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন মাহবুব তারই অপেক্ষায় রইলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর ফরােয়ার্ড অবজারভেশন অফিসার মেজর চৌধুরী। তিনি একজন দক্ষ ও উদ্যমী আর্টিলারি অফিসার ছিলেন। তার সঙ্গে ভারতীয়। সেনাবাহিনীর ৬১ ব্রিগেডের প্রায় ২০জন সৈনিকের ২টি সেকশন ছিল। এ প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায় ক্যাপ্টেন হাফিজের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্যাপ্টেন মাহবুব ১টি ফাইটিং প্যাট্রল নিয়ে ধলইয়ের দিকে শত্রুর গতিবিধ জানার জন্য অগ্রসর হন।  প্রায় আধা ঘন্টা পর সামনে থেকে গােলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন মাহবুব একজন সাহসী অফিসার ছিলেন। তিনি আন্দাজ করেন যে, শত্রুর ফাইটিং প্যাট্রল উত্তর দিকে পাঠিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে সচেষ্ট হবে এবং সেই কারণে তিনি ধলইয়ের দিকে রওনা হন। তিনি দেখতে পান যে, কিছু পাকিস্তানি সৈনিক মেঠো পথ দিয়ে ধলই থেকে আসছে।

তিনি এলএমজি স্থাপন করে অ্যামবুশ পজিশনে চলে যান। একটু পরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ১০জন সৈনিক সেই পথে আসে এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব তাদের উপরে এলএমজি। ফায়ার করেন। এ অ্যামবুশে পাকিস্তানের ৬জন সৈনিক নিহত হয় এবং বাকিরা দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে আত্মগােপন করে। ক্যাপ্টেন মাহবুব দেখতে পান যে, সুবেদার র্যাংকের একজন সৈনিক আহত হয়ে পড়ে আছেন পরে জানা গেছে। তার নাম সুবেদার গুলচমন। এ আহত ব্যক্তিকে নিয়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব ‘বি’ কোম্পানির পজিশনে চলে আসেন। সুবেদারকে ফাস্ট এইড দেওয়ার পরে তিনি। মৃত্যুবরণ করেন। এটাই ছিল ধলই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রথম হতাহতের ঘটনা। পরিকল্পনা মােতাবেক লে, কাইয়ুম ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে এফইউপি ৪টার সময় অতিক্রম করেন। প্রায় ৫শ’ গজ অতিক্রম করার পর এ ২টি প্লাটুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ফায়ার অ্যান্ড মুভের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

লে, নূরের ৭ নম্বর শত্রুর সঙ্গে ফায়ার ফাইটে লিপ্ত হন, পরক্ষণেই সুবেদার আবুল হাসেমের ৮ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গের শত্রুর ফায়ার ফাইট শুরু হয়। ইতােমধ্যে ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ১০৬ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল শত্রুর অবস্থানের উপরে ফায়ার করতে থাকে। মুহূর্তেই পুরাে ধলই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সিকোম্পানির সৈনিকরা শত্রুর পজিশনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানি সৈনিকরা প্রচণ্ডভাবে মেশিনগান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ঘন গাছপালা এবং নালার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া ও নিশানা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। লে, নূর শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রায় ২০০ গজ নিকটে তার প্লাটুন নিয়ে চলে আসেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈনিকদের মেশিনগান ফায়ারের কারণে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। যুদ্ধের এ পর্যায়ে লে, নূর আবার মেশিনগানগুলিকে নিস্তব্ধ করার জন্য তার প্রাটুন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মেশিনগানের গুলিতে আহত হন। তাকে আহত অবস্থায় পিছনে নিয়ে আসা হয়। ইতােমধ্যে ৮ নম্বর প্লাটুনের অধিনায়ক সুবেদার আবুল হাসেম টিজে এগিয়ে যেতে চেষ্ট করেন। কিন্তু শত্রুর মেশিনগানের তীব্র গুলিবর্ষণের মুখে তার পক্ষে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এ মেশিনগানগুলাের গুলিতে আরও কয়েকজন সৈনিক আহত হন। সে সময় সৈনিকদের মধ্যে কিছুটা হতাশা লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু যােগ্য প্লাটুন অধিনায়করা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সৈনিকদের একত্র করেন। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড গােলাগুলিতে সার্বিকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। কোম্পানির সৈনিকরা মরণপণ চেষ্টা করেও অগ্রসর হতে। পারছিল না। এ পর্যায়ে আবুল হাসেম তার পিছনে থাকা ৩ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে অবস্থানরত কোম্পানি অধিনায়ক লে. কাইয়ুমের সঙ্গে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে পর্যালােচনা করেন। তারা বুঝতে পারেন যে, শত্রুর বিশাল একটি বাহিনী ধলই দখল করে আছে এবং শক্র সংখ্যা যা মনে করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। লে, কাইয়ুম দেখতে পান যে, বিওপি’র কাছে একটি মেশিনগান এবং তার পশ্চিমে আরও একটি মেশিনগান ক্রমাগত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে এবং এগুলােকে ধ্বংস করতে না পারলে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এ দুটো মেশিনগানের মধ্যবর্তী উঁচু স্থান থেকে একটি পানিবাহী নালা ‘সি’ কোম্পানির দিকে বয়ে আসছে। লে, কাইয়ুমের সঙ্গে তখন অবস্থান নিয়েছেন তার রানার সিপাহি হামিদুর। রহমান। লে, কাইয়ুম হামিদুরকে ২টি মেশিনগান পােস্ট দেখিয়ে দেন এবং নিশ্চিত করেন যে হামিদুর সে ২টি পােস্ট দেখেছে। তীক্ষ্ণবুদ্ধির হামিদুর সঠিকভাবে মেশিনগান ২টি চিহ্নিত করেন। তারপরে লে, কাইয়ুম হামিদুরে হাতে ২টি গ্রেনেড দিয়ে বলেন যে, এ নালা থেকে মেশিনগানগুলাের দূরত্ব ৫০০ গজের বেশি হবে।

এ নালা দিয়ে ক্রলিং করে বাঁদিকের (পশ্চিম দিকের) প্রথম মেশিনগান পােস্টে যেতে হবে এবং মেশিনগান বাংকারের গর্ত দিয়ে ১টি গ্রেনেড পােস্টের ভিতর দিয়ে নিক্ষেপ করে তা ধ্বংস করতে হবে। এভাবে আবার দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্ট অর্থাৎ নালার পূর্বদিকে অবস্থিত মেশিনগানটি ধ্বংস করতে হবে। লে, কাইয়ুম স্নেহভরে হামিদুরকে বলেন যে, তার দুঃসাহসী পদক্ষেপের উপরই নির্ভর করছে ‘সি’ কোম্পানির সৈনিকদের জীবন এবং এ যুদ্ধের সাফল্য। হামিদুর লে. কাইয়ুমকে বলেন ‘করে দেব স্যার’। আর বিলম্ব করে হামিদুর সেই নালা দিয়ে ক্রলিং করে অগ্রসর হতে থাকেন। লে, কাইয়ুম বলেছিলেন, হামিদুরের শেষ কথা ছিল ‘করে দেব স্যার’। তিনি কিন্তু বলেননি করে আসব স্যার। তিনি হয়তাে অনুধাবন করেছিলেন যে, আর ফেরত আসা সম্ভব হবে না। কারণ এ কঠিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে এ রকম কঠিন মিশন। সম্পন্ন করে ফেরত আসা প্রায় অসম্ভব। হামিদুরের মনে হয়তােবা ছিল সেই দুঃসাহসী সৈনিকের চিত্র, যিনি পালিয়ে না গিয়ে ইবিআরসির মাঠের কাছে একা ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈনিকদের উপর আক্রমণ করেছিলেন। এ অজানা সৈনিকের বীরত্বকথা হামিদুর অনেককেই বলেছিলেন এবং তিনিই হয়তাে ছিলেন তার জীবনের আদর্শ। | আধাে আলাে আঁধারে ২টি গ্রেনেড হাতে নিয়ে ক্রলিং করে হামিদুর মেশিনগান পােস্টগুলাের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার সহযােদ্ধারা বিস্ময়ে এ কিশােরের সম্মুখ সমরে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন। মেশিনগানগুলাে তখনাে অবশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে চলেছে। প্রায় ৪৫০ মিটার ক্রলিং করার পর হামিদুরকে আর দেখা যাচ্ছিল না।

বােঝা গেল, বাঁদিকের মেশিনগান পােস্টের দিকে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন ক্রলিং করে। সবার উকণ্ঠা কাটিয়ে গ্রেনেড ফাটার আওয়াজ এবং চিৎকারের শব্দ শােনা গেল একটু পরই। বােঝা গেল, হামিদুর কোম্পানি অধিনায়কের নির্দেশ অনুযায়ী প্রথম মেশিনগান পােস্ট উড়িয়ে দিয়েছেন। তারপর ঐ এলাকায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে সামান্য কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ‘সি’ কোম্পানির সৈনিকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন হামিদুরকে আবার দেখার জন্য। তাদের উদ্বেগ বেড়ে যায়। কারণ সহযােদ্ধারা তখনাে দেখতে পান যে, দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্ট থেকে ফায়ার হচ্ছিল। আন্দাজ করা হয় যে, প্রথম মেশিনগান পােস্ট ধ্বংস করার সময় হয়তাে হামিদুর আহত হয়েছেন এবং তার জন্যই হয়তাে দ্বিতীয় পােস্টে যাওয়ার জন্য তার সময় লাগছে। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্ট থেকে গ্রেনেড ফাটার শব্দ এবং চিঙ্কার শােনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ’ বলে একটা চিৎকারও কানে এলাে। সবাই বুঝতে পারলেন এটা কিশাের হামিদুরের কন্ঠ। কিছু পরে হামিদুরের সহযােদ্ধারা দেখলেন নালা দিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে মগজও বয়ে আসছে এবং দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্ট থেকে আর কোনাে গুলি আসছে না। তারা বুঝলেন এ রক্ত হামিদুরের।

একই সঙ্গে তারা বুঝতে পারলেন যে, দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্টও ধ্বংস হয়ে গেছে। কারণ সেগুলাে থেকে আর গুলি আসছে হামিদুরের সহযােদ্ধারা দ্রুত অগ্রসর হয়ে সামনের এলাকা দখল করেন। সামনে গিয়ে দেখেন যে, হামিদুর নিস্তব্ধ শুয়ে আছেন। তাঁর কপাল ও বুকের সামনের অংশ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে এবং ভেঙে গেছে। কপালের উপরিভাগ। সহযােদ্ধারা দ্রুত তার মরদেহ পিছনের দিকে নিয়ে। আসেন। কোম্পানি অধিনায়ক সেই এলাকাতে ফায়ার বেইস স্থাপন করেন এবং শক্রর সামনের অবস্থানগুলাের দিকে গুলি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তার। নির্দেশে কয়েকজন সহযােদ্ধা হামিদুরের মরদেহ আম্বাসায় নিয়ে যায়। ইতােমধ্যে ২৮ অক্টোবর বিকালে শ্রীমঙ্গল থেকে আগত পাকিস্তানি ১টি কোম্পানি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর অবস্থানের ওপরে আক্রমণ চালায়। ধলইয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্যের জন্যই ওরা এ রােড ব্লক ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ‘ডি’ কোম্পানি প্রচণ্ডভাবে শক্রর ওপরে গুলি চালায় এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী বেতারে মেজর চৌধুরীর কাছে আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্টের অনুরােধ করেন। আটিলারি ফায়ার নির্ভুলভাবে দুশমনের উপরে পড়ে। ‘ডি’ কোম্পানি ও আর্টিলারির ফায়ারের তীব্রতার জন্য কিছুক্ষণ পরে পাকিস্তানি বাহিনী সে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এ আক্রমণ যথার্থভাবে প্রতিহত করা হয় এবং পাকিস্তানিদের প্রায় ২০-৩০জন হতাহত হয়। 

২৮ অক্টোবর দুপুরের দিকে ‘বি’ কোম্পানির অবস্থানের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের তৎপরতা দেখা যায়। সেখানেও মেজর চৌধুরী যথাযথ ও নির্ভুলভাবে। গােলাবর্ষণ করেন এবং পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রচেষ্টা ধূলিসাৎ করে দেন। ধলই যুদ্ধে সাহসিকতা ও সঠিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মেজর চৌধুরীকে পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বীরচক্র উপাধিতে ভূষিত করে। আমরা ধলইয়ে মূল প্রতিরক্ষার অবস্থানের দিকে আবার নজর দেব। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ধলইয়ের যুদ্ধ চলে উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে। দক্ষিণে ধলইয়ের সীমানার মধ্যে ‘সি’ কোম্পানি ফায়ার বেইস স্থাপন করে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ধলইয়ের পাকিস্তানের বিওপি, ফ্যাক্টরি, কুলি লাইন এবং মূল। প্রতিরক্ষা ইত্যাদি এলাকার তখনাে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুঝতে পারে যে, উত্তর দিক দিয়ে পালাতে গেলে তাদেরকে বাধা দেওয়া হবে এবং কিছু সৈনিক ইতােমধ্যে পালানাের সময়। নিহত হয়েছে। শ্রীমঙ্গল থেকে সৈন্য সাহায্য আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ বেঙ্গল রেজিমেন্ট রােড ব্লক করে রেখেছে এবং এ অবস্থান বারবার চেষ্টা করেও অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং ধলই প্রতিরক্ষাব্যুহে অবস্থানরত ৩০ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জাভেদ সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা এ প্রতিরক্ষার মধ্যে থেকেই যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। তাদের কাছে ছিল অনেক গােলাবারুদ ও সরঞ্জাম। এ সময় যুদ্ধের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং লে, কাইয়ুম। মেজর জিয়াউর রহমানকে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অবহিত করেন। তিনি নির্দেশ পান যে, ফায়ার বেইস যেন হাতছাড়া না হয়। এবং সেখান থেকে শত্রুর পজিশনের উপরে গুলি চালানাে যেন বন্ধ না হয়। মেজর জিয়া সর্বশেষ যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে ৬১ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইয়াদবের সঙ্গে আলােচনা করেন।

পুনঃআক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ

সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কোর অধিনায়ক লে. জেনারেল সগৎ সিং পর্যলােচনা করেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার ইয়াদবকে ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড নিয়ে ধলই আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। ৬১ ব্রিগেডের অধীনে ছিল ২ জাট রেজিমেন্ট, ৭ রাজপুতনা রাইফেলস এবং ১৪ গার্ড রেজিমেন্ট (১৪ গার্ড রেজিমেন্ট ৭৩ মাউনটেন্ট ব্রিগেড থেকে এ অপারেশনের জন্য ৬১ ব্রিগেডের অধীনস্থ করা হয়)। কিন্তু তখন পর্যন্ত সীমান্তবর্তী শহর কমলপুরের কাছে শুধুমাত্র ২ জাট রেজিমেন্ট অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সুতরাং তিনি ২ জাট রেজিমেন্টকে ধলই আক্রমণ করতে নির্দেশ দেন।  ৪ কোর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে ৭ রাজপুতনা রাইফেলস ও ১৪ গার্ড রেজিমেন্ট রওনা দেয় কমলপুরের দিকে। কিন্তু তাদের পৌছতে বেশ কিছু সময়। লাগবে। কোর অধিনায়ক ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল বেন গঞ্জালভেসকে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থার উপরে সার্বিক নজর রাখতে নির্দেশ করেন। তিনি ৫৭ ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ২ আর্টিলারি ব্রিগেডকে কমলপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে নির্দেশ দেন। এ ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কৈলাস প্রসাদ পান্ডে, যাকে ভারতীয় বাহিনী টম পান্ডে বলে সম্বােধন করতাে।  ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ২৯ তারিখ ভােররাতে কমলপুরে পৌছেন এবং তার ইউনিটগুলােকে কমলপুরে আসার নির্দেশ দেন। ২ আর্টিলারি ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩টি মাউন্টেন আর্টিলারি রেজিমেন্ট, ১টি লাইট রেজিমেন্ট। এ যুদ্ধের জন্য সেখান থেকে ৬১ ব্রিগেডের ফায়ার সাপাের্টের জন্য ৫৯ মাউন্টেন রেজিমেন্ট, ১টি ব্যাটারি মিডিয়াম ৫.৫ ইঞ্চি গান (যা কোর হেডকোয়ার্টারের ২৪ মিডিয়াম রেজিমেন্ট থেকে আনা হয়েছিল) এবং ৮২ লাইট রেজিমেন্টে ১টি ব্যাটারি যার মধ্যে ছিল ১২০ মিলিমিটার মটর দেওয়া হয়। ২৯ অক্টোবর দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু করার পরিকল্পনা হয়।

এ অপারেশনে ২ জাট ব্যাটালিয়নের ৩টি কোম্পানিকে নিয়ােজিত করা হয়। বলা হয় ২টি কোম্পানি সামনে এগিয়ে যাবে, আর ১টি থাকবে রিজার্ভে। এ ব্যাপারে ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। অধিনায়ক ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব ২ জাট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কে এস দালালকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আক্রমণ আরম্ভ করতে বলেন। কিন্তু ২। জাটের অধিনায়ক লে. কর্নেল দালাল যুদ্ধ এলাকা পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা করার জন্য আরও সময় চান। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব জানান যে, এত অল্প সময়ে। সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া কঠিন। যা হােক, লে. কর্নেল দালাল অতি দ্রুত ম্যাপের মাধ্যমে এলাকা সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে তার অধীনস্থ অর্ডার গ্রুপকে যুদ্ধের নির্দেশ দেন। এরপরও অভিজ্ঞ ২ আর্টিলারি ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার পান্ডে মতামত দেন, যেহেতু পাকিস্তানি বাহিনীর পজিশনগুলাে অতি সুদৃঢ়, বাংকারগুলাে পাকা করা, তাই ঐগুলাের ওপর আর্টিলারি গান ফায়ার করা। হলেও দ্রুত ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। তিনি আরও জানান, যেহেতু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছে, সেহেতু দিনের বেলা এত সৈন্য একসাথে আক্রমণে পাঠানাে সঠিক হবে না। ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে পরামর্শ দেন যে, আক্রমণ রাতে করা উচিত হবে। তদুপরি ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড অধিনায়ক ইয়াদবের নির্দেশে দুপুরের পর আক্রমণ শুরু হয়। শক্রর প্রতিরক্ষাব্যুহের অধিনায়ক ইয়াদবের নির্দেশে দুপুরের পর আক্রমণ শুরু হয়। শক্রর প্রতিরক্ষাব্যুহের ৬০০ গজের মধ্যে গিয়ে ২ জাট রেজিমেন্ট পাকিস্তানিদের প্রচন্ড গােলাগুলির মুখে পড়ে। ফলে তারা আর অগ্রসর হতে পারছিল না। তখন ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক এবং ৬১ ব্রিগেডের অধিনায়ক সৈন্যদের এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালান। একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয় এবং জাট রেজিমেন্টের আক্রমণে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে প্রতিরােধ করে। এ সংঘর্ষে জাট রেজিমেন্টের প্রায় ৩০জন সৈনিক নিহত এবং বহু আহত হয়।

তাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল দালাল আক্রমণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে ২ জাট ব্যাটালিয়ন বেইসে ফেরত আসার অনুমতি চান। ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের সৈনিকরা যারা একই ফ্রিকোয়েন্সিতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছিলেন। তারা ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব ও লে. কর্নেল দালালের সমস্ত কথােপকথন শুনেছেন। এ ঐতিহাসিক কথােপকথনে এটাই জানা গিয়েছিল ২ জাট রেজিমেন্টের। অধিনায়ক লে. কর্নেল দালাল বলেছিলেন যে, আমার অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছে এবং ২টি কোম্পানি নিয়ে এ শক্ত ঘাঁটি দখল করা সম্ভব নয়। উত্তেজিত ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব দালালকে তার কথার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে আবারাে আক্রমণ চালানাের নির্দেশ দেন। অন্যথায় লে. কর্নেল দালালকে কোর্ট মার্শাল করা হবে বলে জানান। লে. কর্নেল দালাল জানান যে, এ ২টি কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ধলই দখল করা সম্ভব নয়, তিনি তার প্রিয় সৈনিকদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে  ঠেলে দিতে পারবেন না এবং তিনি শাস্তির জন্য প্রস্তুত। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব। তাকে মনে করিয়ে দেন, জাট ব্যাটালিয়নের ১০০ বছরের ঐতিহ্য এবং সম্মান। ধূলিস্যাৎ হতে দেওয়া যায় না। এমন অপ্রীতিকর আলাপ-আলােচনার একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব ৭ রাজপুতনা রাইফেলসকে, যারা তখন যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে চলে এসেছে তাদেরকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেন। এবং নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। ইতােমধ্যে বিকালে ৪ কোর অধিনায়ক। কমলপুরে পৌছেন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করেন। তিনি রাগান্বিত হয়ে ২ জাট ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের পদ থেকে লে. কর্নেল দালালকে অপসারণের নির্দেশ দেন। তিনি আরও সাবধান করে দেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে না পারলে ৬১ ব্রিগেড অধিনায়ককেও অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। ৫৭ ডিভিশনের অধিনায়ক এবং ২ আর্টিলারি ব্রিগেড অধিনায়ক, কোর অধিনায়ককে ২ জাটের অধিনায়ককে আরেকটি সুযােগ দেওয়ার জন্য অনুরােধ করেন। যা হােক বিস্তারিত আলােচনার পর ৩০ অক্টোবর পুনরায় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়।

ইতােমধ্যে ২ দিনে পাকিস্তানিরা ধলইয়ে তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষা অবস্থা পুনর্বণ্টন করে। ১টি কোম্পানি অবস্থান নেয় বিওপি এলাকাতে, ১টি কোম্পানি পজিশন নেয় ফ্যাক্টরি এলাকায়, ১টি কোম্পানি কুলি লাইনে ও টুইন হাট এলাকাতে। বাকি মুজাহিদ ও টর্চি স্কাউটের সৈনিকদের রিজার্ভ রাখা হয় এবং প্রয়ােজনে পাত্রখলা আক্রমণ করে শ্রীমঙ্গলের রাস্তা খােলার চেষ্টার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয় । ৭ রাজপুতনা রাইফেলস ইতােমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান গ্রহণ করে। ৩০ তারিখ রাতে ২ জাটের ২টি কোম্পানি কুলি লাইন ও টুইন হাট এলাকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে এবং তাদের সঙ্গে ১টি রাজপুতনা রাইফেলসকে দেওয়া হয়। রাজপুতনা রাইফেলসের আরও ১টি কোম্পানিকে বিওপি আক্রমণ করতে দেওয়া হয়, ২ জাটের ১টি কোম্পানিকে ও রাজপুতনা রাইফেলসের ১টি কোম্পানিকে ফ্যাক্টরি বিল্ডিং আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২ জাট রেজিমেন্টের ৪র্থ কোম্পানি রিজার্ভে থাকার নির্দেশ পান। রাজপুতনা রাইফেলসের ২টি কোম্পানিকে রিজার্ভে রাখা হয় এবং পাত্রখলার দিক থেকে যদি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেষ্টনী ভেদ করে পাকিস্তানি সৈনিকরা চলে আসে তাহলে তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ভারতীয় এ আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয় রাত ৩টায়। নির্দেশ দেওয়া হয় এ আক্রমণ শুরু করতে হবে পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। ৩০ অক্টোবর দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং ধলইয়ের আশপাশের নালাগুলাে পানিতে ডুবে যায়। ধানক্ষেতগুলােও তলিয়ে যায়।

অনেকটা প্রায় কোমর পানি দিয়ে অগ্রসর হতে হয় সৈনিকদের এবং অনেক কষ্টে ২ জাট ও ৭ রাজপুতনা রাইফেলস এফইউপিতে পৌছে। কিন্তু পাকিস্তানি পজিশনগুলাে ঠিকমতাে নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। তখন তাদেরকে সাহায্য করার। জন্য আর্টিলারি ফায়ার করে পাকিস্তানিদের অবস্থান নির্দেশ করা হয়। ভােররাত ৪টার দিকে জাট রেজিমেন্টের ডান দিকের কোম্পানি অধিনায়ক মেজর কানওয়ার সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হন। তার কোম্পানি কুলি লাইন দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এ আক্রমণে তার বেশ কিছু সৈনিক হতাহত হয়। কিন্তু বাঁদিকে অগ্রসরমাণ কোম্পানি যা ছিল মেজর পাওয়ারের অধীনস্থ তারা লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারেননি এবং আক্রমণের পরেও পুরাে টুইন হাট এলাকা। দখল করতে পারেননি। ইতােমধ্যে ২ জাটের অধিনায়ক রিজার্ভ সৈন্য তলব করেন। তারা পৌছানাের আগেই পাকিস্তানি ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট প্রতি-আক্রমণ করে। তারা টুইন হাট এলাকা আবার দখল করে নেয়। কিন্তু কুলি লাইন দখল করতে ব্যর্থ হয়। সে সময় টুইন হাট এলাকায় ব্রিগেডিয়ার ইয়াদবের হাঁটুর উপরিভাগে মেশিনগানের গুলি লাগে। রাজপুতনা রাইফেলসের একটি কোম্পানি তাকে উদ্ধার করে এবং চিকিৎসার জন্য রিয়ারে পাঠিয়ে দেয়। তখন ২ জাটের অধিনায়ক ৫৭ ডিভিশনের অধিনায়ককে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি। সম্পর্কে অবহিত করেন এবং আবার যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন অধিনায়ক তাকে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে আসার। অনুমতি দেননি এবং ৪ কোর কমান্ডারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেন। ৪ কোর অধিনায়ক তাৎক্ষণিক ব্রিগেডিয়ার পান্ডেকে ৬১ ব্রিগেডের অধিনায়ক নিয়ােগ করেন। তখন ভাের ৬টা, ৩১ অক্টোবর ১৯৭১। পান্ডে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান গ্রহণ করেন তখন ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে। দ্বিধাদন্দ্ব ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।

২ জাটের ১টি কোম্পানি কুলি লাইন দখল করেছিল। কিন্তু বাকি এলাকাগুলাে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিআক্রমণ করে পুনরায় দখল করে নিয়েছিল। তখন আশপাশে রিজার্ভ সৈন্য ছিল না, যাদের দিয়ে আক্রমণ করা যায়। নতুন ব্রিগেড অধিনায়ক পান্ডে কঠিন এক পরিস্থিতিতে গঙ্গানগর এলাকা থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। টম পান্ডে। ব্রিগেড অধিনায়ক হিসেবে সকালে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার পর প্রথমেই তিনি ৭ রাজপুতনা রাইফেলসের উপ-অধিনায়ক মেজর আবতার সিংকে ১টি প্লাটুন নিয়ে আহত ও নিহত সৈনিকদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরানাের নির্দেশ দেন। কারণ হতাহত সৈনিকদের দেখে যুদ্ধরত সৈনিকদের মনােবল হাঁস পাচ্ছিল এবং এটা মানবিক দিক থেকেও যথােচিত ছিল না। আবতার সিং অতি দ্রুত হতাহত সৈনিকদের সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর পান্ডের নির্দেশে আবতার সিং আরেকটি প্লাটুন নিয়ে ২ জাটের দখলে থাকা কুলি লাইনে গােলাবারুদ পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। কারণ তাদের গােলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এ কর্মসম্পাদন করতে গিয়ে মেজর আবতার সিং শক্রর গুলিতে গুরুতর আহত হন। এজন্য সম্মুখভাগে অবস্থানরত ২ জাট রেজিমেন্টের সৈন্যদের কাছে গােলাবারুদ পাঠানাে কঠিন হয়ে পড়ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এ অচলাবস্থা নিরসনের জন্য পান্ডে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ২ জাট, ৭ রাজপুতনা।

রাইফেলস, ১৪ গার্ড রেজিমেন্টকে নির্দেশ দেন যে, ১ নভেম্বরের রাতের মধ্যে ধলই দখল করতে হবে এবং এর কোনাে নড়চড় হবে না। যেহেতু পান্ডে নিজেই যুদ্ধের সম্মুখভাগে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তাই তাঁর এ নির্দেশ ৩টি রেজিমেন্টকেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তখন পর্যন্ত ৭ রাজপুতনা রাইফেলসের ১টি কোম্পানি এবং ১৪ গার্ড যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌছায়নি। তিনি তাদেরকে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে আসার ব্যবস্থা করলেন। নিজে সম্মুখ লাইনে অবস্থান করে আর্টিলারি ফায়ার প্ল্যান চূড়ান্ত করেন।  ৩১ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি ইলুমিনেশন রাউন্ড দিয়ে টার্গেট রেজিস্ট্রেশন করেন। প্রতিটি কোম্পানির সাথে ফরােয়ার্ড অবজার্ভার প্রেরণ করেন। সন্ধ্যার পর তিনি পুরাে ডিভিশন আর্টিলারির ইন্টেন্স ফায়ার শত্রুর অবস্থানের ওপর আনেন এবং নিজে ফায়ার ডিসিপ্লিন তদারক করেন। অধিনায়কের এ মনােভাবে এবং সৈন্যদের পুরােভাগে অবস্থান নেয়ার কারণে ২ জাট ও ৭ রাজপুতনা রাইফেলস মনােবল ফিরে পায়। সে সময় ব্রিগেডিয়ার পান্ডে যুদ্ধের সম্মুখ লাইনে সৈনিকদের অবস্থানে পরিদর্শন করে সৈনিকদের মনােবল বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। ৭ রাজপুতনা রাইফেলসের কোম্পানি ও ১৪ গার্ড রেজিমেন্ট সন্ধ্যার পরে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছে এবং তাদেরকে বিওপি এবং কারখানা এলাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রিগেড অধিনায়ক আর্টিলারি ফায়ার দ্বারা ও ৪টি রিকয়েললেস রাইফেল সম্মুখ লাইনে এনে শত্রুর বাংকার ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন, যেন আক্রমণের আগেই বাংকারগুলােকে ধ্বংস করা যায়। | ৩১ তারিখ বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাংকারগুলােতে আর্টিলারি ও রিকয়েললেস রাইফেল দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ করা হয়। এর ফলে পাকিস্তানি। বাহিনীর বেশ কিছু বাংকার বিধ্বস্ত হয়। 

১ নভেম্বর রাত ৩টায় পরিকল্পনা মােতাবেক ভারতীয় সৈনিকরা ব্রিগেড অধিনায়কের পূর্বের নির্দেশ অনুযায়ী আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। ডিভিশন আর্টিলারির ফায়ারের কভারে ৭ রাজপুতনা রাইফেলস বিওপি’র অবস্থান আক্রমণ করে। সব কয়টি অবস্থানের মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ ছিল বিওপি অবস্থান, যার ২টি মেশিনগান পােস্ট মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক হামিদুর রহমান আগেই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এলাকার কিছু অংশ ‘সি’ কোম্পানি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দখল করেছিল। জাট রেজিমেন্ট আক্রমণ চালায় কুলি লাইন ও টুইন। হাট এলাকায় এবং গার্ড রেজিমেন্ট আক্রমণ চালায় ফ্যাক্টরি এলাকাতে। ভারতীয় প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পিছিয়ে পড়ে এবং বেশকিছু এলাকা ভারতীয় বাহিনীর দখলে চলে আসে।

পরদিন ১ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানি সেনারা এলাকাজুড়ে প্রতিআক্রমণ করে। এ প্রতিআক্রমণে ৭ রাজপুতনা রাইফেলসের অধিনায়ক লে. কর্নেল দেবসেন আহত হন এবং তার সঙ্গের আর্টিলারি অবজার্ভার শহিদ হন। ফলে ভারতীয় সৈনিকদের মধ্যে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং কিছু রাজপুতনা রাইফেলসের সৈনিক পশ্চাদগমন করতে উদ্যোগী হয়। সে সময় ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে দ্রুত ঐ এলাকায় সশরীরে উপস্থিত হন এবং তার নির্দেশে রাজপুতনা রাইফেলস আবার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে রাজপুতনা রাইফেলসের ২জন কোম্পানি অধিনায়ক মেজর পুনিয়া ও মেজর সুভাস আহত হন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে সামনে থেকে নিজেই আর্টিলারির ক্লোজ ফায়ার আনার আদেশ দেন এবং এরপরই ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যে প্রতিরক্ষাব্যুহের সামনে বেয়নেট চার্জ ও হাতাহাতি যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ মরণপণ যুদ্ধ যখন চলছিল সে সময় ব্রিগেডিয়ার পান্ডের ডান হাতের একদিকে গুলি লেগে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ব্রিগেড সদর দপ্তরের অফিসারদের বারবার অনুরােধেও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেননি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের পর আবারাে যুদ্ধ পরিচালনায়  নিয়ােজিত হন। সে সময় তিনি যদি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতেন তাহলে ধলই যুদ্ধে বিজয় লাভ করা সম্ভব হতাে না। কারণ সৈনিকরা মনােবল হারিয়ে ফেলত। পান্ডে সেদিন আদর্শ অধিনায়কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

ব্রিগেডিয়ার পান্ডের নির্দেশে ১৪ গার্ড রেজিমেন্টের রিজার্ভ সৈন্যরা রাত ৯টায় কুলি লাইন দখল করে নেয়। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিছন হটতে বাধ্য হয়। তারা দ্বিধাবিভক্ত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক সৈনিকের লাশ যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে আহত সৈনিকদের নিয়ে ছােটো ছােটো দলে ভাগ হয়ে জঙ্গল এবং চা-বাগানের মধ্য দিয়ে তারা এলাকা ত্যাগ করে। এভাবেই ২ নভেম্বর সকালে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।  পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারদের লিখিত বইয়ে মুদ্রিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ধলই আক্রমণের প্রথমদিকে মেজর জাভেদ ধলই-শ্রীমঙ্গলের রাস্তা মুক্ত রাখার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধে মেজর জাভেদ নিজ সৈনিকদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং বারবার প্রতিআক্রমণ দ্বারা হারানাে এলাকা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষার ওপর ভিত্তি করেই ধলই দখলে রাখার চেষ্টা করেছিল সে এবং কয়েকবার সফলও হয়েছিল। পরে এ যুদ্ধে সে নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ২জন অফিসার, ৩জন জেসিও, ৯০জন সৈনিক এবং বাকি মুজাহিদ ও টর্চি স্কাউটের সৈন্য। সব মিলে ১৬০জন পাকিস্তানি সৈনিক এ যুদ্ধে নিহত হয়। এ যুদ্ধে প্রচুর ক্ষতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা ১৪ ডিভিশনের অধিনায়ককে জানায় যে, এভাবে প্রতিরক্ষার অবস্থান গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে আরও ক্ষয়ক্ষতি হবে। সে পরামর্শ দেয় যে, উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ভারতের ভিতরে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ আক্রমণ করে ধ্বংস করতে হবে।

তাহলে তারা এভাবে আর আক্রমণ করতে পারবে না। এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীও এভাবে তাদের সাহায্যে আসতে পারবে না। সে তার ব্রিগেডের অধীনস্থ ২২ বালুচ রেজিমেন্ট, ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে পুনর্গঠন করে এবং ৩৯ বালুচ রেজিমেন্টকে এনে তার ব্রিগেডকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেয়। সে আরও জানায় যে, তার ব্রিগেড পুনর্গঠিত হলে একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং ১টি হেভি মটার ব্যাটারির সাহায্যে সে ভারতের অভ্যন্তরে অপারেশন চালাতে প্রস্তুত হবে। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ধলই। যুদ্ধের পরে মৌলভীবাজারে ৩১৩ ব্রিগেড সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসলে ব্রিগেডিয়ার রানা আবার আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প ধ্বংস করার অনুমতি চায়। জেনারেল নিয়াজি সেই অনুরােধে সাড়া দেয়নি। কিছু পর্যলােচনা ধলই যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধগুলাের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। এ যুদ্ধে একদিকে যেমন অনেক সাহসিকতাপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে, অন্যদিকে সেখানে কিছু বেপরােয়া ও ত্রুটিপূর্ণ পদক্ষেপও নিতে দেখা গেছে। এ ধরনের বড়াে যুদ্ধে এ রকম ঘটনা বিরল নয়। শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ধলইয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর তারা আক্রমণ প্রতিহত করেছে এবং বারবার প্রতিআক্রমণ করেছে। তাদের প্রতিআক্রমণগুলাে ছিল তাৎক্ষণিক ও সাহসিকতাপূর্ণ।

১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা এ অসম যুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রেখেছে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। ভারতীয় বাহিনীকে প্রস্তুতির পূর্বেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করানাে হয়েছিল। ভারতীয় ২ জাট রেজিমেন্টকে পুরােপুরি প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বেই দিনের আলােতে এরূপ শক্তিশালী ঘাঁটির বিরুদ্ধে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া ঠিক হয়নি। উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে যুদ্ধে সাফল্য আসে না। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যদি পর্যাপ্ত আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট দেওয়া হতাে এবং যদি পাকিস্তানি অবস্থানের বাংকারগুলাে পূর্ব থেকে ধ্বংস করা হতাে তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সৈনিক কম হতাহত হতাে।  ৭ রাজপুতনা রাইফেলস তাদের অধিনায়ক আহত হওয়ার পর তারা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। কিন্তু ব্রিগেড অধিনায়ক তাদের সঙ্গে শরিক হওয়ায় তারা মনােবল ফিরে পায়। ব্রিগেডিয়ার অধিনায়কের সঠিক আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট প্ল্যানিং ও বাংকার ধ্বংস করার পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করায় যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনে। কোনাে প্রতিরক্ষাব্যুহ যদি পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত করা হয়, তাহলে তার উপরে সরাসরি আক্রমণ না করে সেটা পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাই সঠিক। ভারতীয় সেনাবাহিনী ধলইয়ে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির পর এ বিষয়ে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি পাশ কাটিয়ে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পিছন থেকে কাট অফ করে পর্যদস্ত করেছিলেন। কোনাে প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকেও আক্রমণাত্মক মানসিকতা ও পরিকল্পনা থাকা উচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষায় থেকেও বারবার প্রতিআক্রমণ। করেছে এবং হারানাে জায়গাগুলাে দখল করতে সচেষ্ট ছিল। এ যুদ্ধে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কগণ সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তারা তাদের সৈন্যদের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন।

এ যুদ্ধ জয়ের জন্য এটিও একটি অন্যতম কারণ। এ যুদ্ধে তাদের অনেকেই নিহত ও আহত হন। এ যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এ যুদ্ধে ২ জাট ব্যাটালিয়ন এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একই উদ্দেশ্যে এবং যৌথভাবে যুদ্ধ করেছে। ১৯৬৫ সালে এ জাট ব্যাটালিয়ন লাহাের ফ্রন্টে যুদ্ধ করে এবং একপর্যায়ে তারা শালিমার গার্ডেনের কাছে পৌছে যায়। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঐ যুদ্ধেই পাকিস্তানি সৈনিক হিসেবে জাটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাহাের রক্ষা করে। ইতিহাসের কী পরিণতি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের অবস্থান বদলে গিয়েছিল। এ যুদ্ধে ভারতীয় অধিনায়ক দুঃসাহসী টম পান্ডেকে পরমবীর দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন জেনারেল সগৎ সিং। ভারতীয় সেনাবাহিনী পরে তাকে মহাবীর চক্র প্রদান করে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!