You dont have javascript enabled! Please enable it!
শাহবাজপুর (লাতু) আক্রমণ
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলােমিটার উত্তরপূর্ব দিকে একেবারে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে শাহবাজপুর বিওপি ও লাতু রেল স্টেশন। শাহবাজপুর বিওপি’র ভৌগােলিক অবস্থানটি এমন যে, সীমান্ত অতিক্রম করে বিয়ানীবাজার, বড়লেখা অথবা কুলাউড়ায় আসতে হলে এ বিওপি অতিক্রম করে আসতে হবে। অপরদিকে লাতু রেল স্টেশন একটা জংশন পয়েন্ট, যেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে পুরাে এলাকার ওপর কর্তৃত্ব রাখা যাবে। তারিখ: ১০ আগস্ট, ১৯৭১। শাহবাজপুর বিওপি ও লাতু রেল স্টেশনে পাকিস্তানিদের শক্ত অবস্থান ছিল। এ অবস্থান থেকেই তারা আশপাশের অঞ্চলে এমনকি বিয়ানীবাজার, বড়লেখা। এসব অঞ্চলেও অপারেশন পরিচালনা করতাে। বারপুঞ্জী সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রব এ এলাকা শত্রুমুক্ত করাটা সাব-সেক্টরের নিরাপত্তা এবং এ অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত ও সংবাদ সংগ্রহের সুবিধার জন্য প্রয়ােজন মনে করেন। সে অনুযায়ী তিনি ৪ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের কাছে লাতু-শাহবাজপুর আক্রমণের জন্য অনুমতি চান। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত অনুমতি প্রদান করেন এবং একই সাথে ভারতীয় ইকো সেক্টর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে সবধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরােধ করেন। যুদ্ধের সংগঠন ১, পাকিস্তানি বাহিনী: ৩১ পাঞ্জাবের ১ কোম্পানি এবং রাজাকারদের ১ প্লাটুন। ২. মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর ৫টি কোম্পানি (গণবাহিনী)। শাহবাজপুর রেল স্টেশনে পাকিস্তানিরা খুব শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে। শাহবাজপুর (লাতু) রেল স্টেশন এলাকাটা ছিল পাহাড়ি। শত্রুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করার জন্য কোনাে সুবিধাজনক পথ ছিল তাই এ প্রতিরক্ষা সামনাসামনি আক্রমণ করা ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না, আর আক্রমণের প্রধান উপকরণ ‘আকস্মিকতায় অর্জন করা একেবারেই সম্ভব ছিল না। তাই ক্যাপ্টেন রব একটু নতুন আঙ্গিকে অপারেশন পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১টি কোম্পানি শক্রর বিয়ানীবাজার থেকে সহায়ক বাহিনীকে প্রতিহত করবে এবং অপর একটি কোম্পানি।
শাহবাজপুর-বড়লেখা সড়কে শত্রু সহায়ক বাহিনী প্রতিহত করবে। বিয়ানীবাজারের রাস্তায় যে কোম্পানিটি রােড ব্লক করবে, সেটি থেকে ১টি প্লাটুন সর্বপ্রথমে শত্রু অবস্থানের পিছন থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করবে। তারা ঠিক ১০ মিনিট ফায়ার করবে এবং সাথে সাথে পশ্চাদপসরণ করে নিজ কোম্পানির সাথে যােগ দেবে যে মুহূর্তে প্লাটুনটি পশ্চাদপসরণ করবে, তখন সাথে সাথে ভারতীয় কামানের ১টি ব্যাটারি ৫ মিনিট ধরে শক্ত অবস্থানের ওপর গােলাবর্ষণ করবে। অবশিষ্ট ৩টি কোম্পানি গােলাবর্ষণের আড়ালে সামনে থেকে শত্রু। অবস্থানের ওপর আক্রমণ করবে। যুদ্ধের বর্ণনা ভাের ৫টায় সব কোম্পানি তাদের নির্ধারিত স্থানে পৌছে যায়। ক্যাপ্টেন রব অ্যাসল্ট কোম্পানিগুলাের সাথে ছিলেন, কিন্তু অন্য কোম্পানিগুলাের সাথে যােগাযােগের জন্য তার কোনাে ওয়্যারলেস ছিল না। রােড ব্লক প্রদানকারী কোম্পানি ২টির দায়িত্ব ছিল প্রধান। কারণ তারা যদি শক্র সহায়ক বাহিনী ঠেকাতে না পারে, তবে আক্রমণকারী কোম্পানিগুলাে কখনােই সফল হতে পারবে না। ১০ আগস্ট ভাের সাড়ে ৫টায় পরিকল্পনা। অনুযায়ী ১টি প্লাটুন শত্রুর পিছন দিক থেকে ফায়ার শুরু করে। শত্রুপক্ষ হঠাৎ পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় তাদের ওপর আর্টিলারি গােলাবর্ষণ কিন্তু পাকিস্তানিদের বাংকারগুলাে এত সুরক্ষিত ছিল যে ফিল্ড আর্টিলারির গােলা কার্যকর হচ্ছিল না। ঠিক সময়মতাে বাকি ৩টি কোম্পানি সামনে থেকে আক্রমণ করে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই শক্র তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে শুরু করে। সকাল ৭টায় মুক্তিবাহিনী প্রায় পুরাে ।
শাহবাজপুর স্টেশন দখল করে নেয়। এরপর মুক্তিবাহিনী বিওপি আক্রমণ করে। বিওপি থেকে তারা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু শত্রু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে সেখান থেকেও পিছু হটে যায়। বিওপিতে তখনাে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সেটা নামিয়ে বাংলাদেশি পতাকা উড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই মুহূর্তে বিজয়ের আতিশয্যে মুক্তিযােদ্ধারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন রব সবাইকে একসাথে করার চেষ্টা করতে থাকেন। ঠিক সেই মুহূর্তে খবর আসে, বাম দিকে যে কোম্পানিটির বড়লেখা থেকে শত্রু সহায়ক বাহিনীকে ঠেকানাের কথা ছিল, তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং শত্রু সেদিক থেকে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। একই সাথে শত্রুর আটিলারি। মুক্তিবাহিনী অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু করে। ক্যাপ্টেন রব পরিস্থিতি সম্পর্কে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে জানান।
মেজর দত্ত জানালেন, পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এদিকে নতুন আগত পাকিস্তানিদের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না দেখে ক্যাপ্টেন রব মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার আদেশ দেন। যুদ্ধের ফলাফল শাহবাজপুরের (লাতু) যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী তাদের উদ্দেশ্য অর্জন করতে পেরেছিল। তারা পুরাে বিওপি ও রেল স্টেশনের বেশিরভাগ দখল করে নেয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সফলতার প্রধান কারণ ছিল ক্যাপ্টেন রবের পরিকল্পনায় নতুনত্ব। এ কারণে যেখানে শত্রুর শক্ত অবস্থানে কোনােভাবেই শক্রকে ধোকা। দেওয়া সম্ভব হতাে না, সেখানেও শত্রুপক্ষ হতবাক হয়ে যায় এবং এ কারণেই তারা প্রাথমিক প্রতিরােধ করার সুযােগ পায় না। এ যুদ্ধে শক্রর ৮টি মৃতদেহ। পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করেন মুক্তিযােদ্ধারা, কিন্তু পরিবহনের কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় এর বেশির ভাগই তারা নিয়ে যেতে পারেন নি। শত্রু তাদের যুদ্ধাহতদের বেশির ভাগই নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময় জানা যায়, পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০জন। এ যুদ্ধে ৬জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ৫জন আহত হন। শিক্ষণীয় বিষয় ১. অনভিজ্ঞতা (মুক্তিযােদ্ধা)।
২. রােড ব্লক অবস্থানের ব্যর্থতা। ৩. আনন্দের আতিশয্য। শাহবাজপুরের (লাতু) যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী নিশ্চিত বিজয়ের আভাস পাওয়ার পরও তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা। যার কারণে পর পর ২টি লক্ষ্যবস্তু দখলের পর তারা পরিকল্পিতভাবে পুনর্গঠিত না হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। যারফলে শত্রু যখন পাল্টা আক্রমণ করে, তখন সেটা প্রতিহত করার মতাে অবস্থা মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল না। এ যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী রােড ব্লক প্রদানকারী কোম্পানিগুলাের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কিন্তু বড়লেখা থেকে শত্রু বৃদ্ধি। ঠেকানাের দায়িত্ব যে কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছিল, তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। যার কারণে প্রাথমিক সফলতা এলেও পরবর্তী সময় শত্রুরা নতুন সৈন্য দ্বারা পাল্টা আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন রবের বাইরের ২টি কোম্পানির সাথে যােগাযােগের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে রােড ব্লক প্রদানকারী অনভিজ্ঞ গণবাহিনীর কোম্পানিগুলােকে তিনি প্রয়ােজনীয় মুহূর্তে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করতে সক্ষম হননি। সর্বোপরি এতবড়াে বিজয়ের আনন্দে স্বল্প প্রশিক্ষিত গণবাহিনীর যােদ্ধারা আনন্দের আতিশয্যে একটু ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে, যার কারণে তারা শত্রুর পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!