You dont have javascript enabled! Please enable it! শমসেরনগর-চৌমােহনার অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
শমসেরনগর-চৌমােহনার অ্যামবুশ
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার অন্তর্গত শমসেরনগর এ অঞ্চলের একটি আদি জনপদ। শমসেরনগর ছিল গুরুত্বপূর্ণ শহর। সীমান্তবর্তী শহরটি ছিল এ অঞ্চলের সব সীমান্ত ফাড়ি থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার জংশন পয়েন্ট। মৌলভীবাজার থেকে এ থানার দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলােমিটার।  ২৪ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে শমসেরনগর পাঠানাে হয়। শমসেরনগর এলাকায় নকশালপন্থি তৎপরতা ঠেকানাের অজুহাতে এ বাঙালি চৌকস অফিসার ও সৈন্যদের কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ মৌলভীবাজারে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন গােলাম রসুলের অধীনে ৩১ পাঞ্জাবের ১টি কোম্পানি শহরের ‘জনমিলন কেন্দ্র’-এ অবস্থান নেয়। মেজর। খালেদ মােশাররফ শমসেরনগর পৌছার অব্যবহিত পর ৩১ বালুচের ক্যাপ্টেন। গােলাম রসুল শমসেরনগর আসেন। ২৭ মার্চ মেজর খালেদ মােশাররফ তার কোম্পানি নিয়ে শমসেরনগর ত্যাগ করেন।
এ দিন থেকেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন গােলাম রসুলের অধীনে শমসেরনগরে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ২৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনী বিনা কারণে শমসেরনগর বাজারে সাধারণ জনতার ওপর গুলি ছুড়ে এবং এতে একজন বৃদ্ধ শহিদ হন। এ ঘটনা জনমনে আরও ক্রোধের সৃষ্টি করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে-কোনাে প্রকারেই হােক এরপর যদি শমসেরনগরে ক্যাপ্টেন গােলাম রসুল ও তার জওয়ানদের আগমন ঘটে, তবে। তা তারা প্রতিহত করবে। অযথা এ লােকহত্যার প্রতিশােধ নেবে। সিলেট অঞ্চলের মাঝে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরােধের ঘটনাগুলাের মাঝে শমসেরনগরের এ অ্যামবুশ একটি অন্যতম ঘটনা। পাকিস্তানিদের ২৭ মার্চের নির্বিচার হত্যার পরই শমসেরনগরের আপামর জনগণ প্রতিরােধ গড়ে তােলার পরিকল্পনা নেয়। এ কারণে তৎকালীন চেয়ারম্যান, মুজাহিদ, ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান, মােজাফফর আহমেদ, আব্দুল গফুর প্রমুখ এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন এবং পার্শ্ববর্তী সীমান্ত ফঁাড়িগুলাে থেকে বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের প্রতিরােধ যুদ্ধে শরিক হওয়ার আহ্বান। জানান। ইপিআর সৈনিকেরা জনতার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইপিআর-এর সুবেদার শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে স্থানীয় গণবাহিনী গড়ে তােলেন।
মুজাহিদ ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান ও মােজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে খুব তাড়াতাড়ি একটি পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন গােলাম রসুলের এ টহল দলটি প্রতিদিনই মৌলভীবাজার থেকে শমসেরনগর চৌমােহনা হয়ে কমলগঞ্জ যাতায়াত করতাে। ২৮ মার্চ শমসেরনগর চৌমােহনায় শত্রুর টহলটিকে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করা হয়। শমসেরনগর চৌমােহনার ৩টি বাড়ির ছাদে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বসিয়ে এ অ্যামবুশ পরিকল্পনা করা হয়।  ২৮ মার্চ ভােরে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে যথাস্থানে অবস্থান নেন। শমসেরনগর বাজারের প্রবেশমুখে রেল ক্রসিংয়ে রেল ওয়াগন দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। বিকাল আনুমানিক ৪টার দিকে মৌলভীবাজার থেকে ৩টি গাড়িতে ক্যাপ্টেন গােলাম রসুল তার টহল দল নিয়ে যথারীতি আসে। রেলক্রসিংয়ের কাছে এসে ব্যারিকেডের কারণে প্যাট্রলটি থমকে দাড়ায়।
দ্রুতগতিতে পাকিস্তানি সেনারা ব্যারিকেড সরানাের কাজ শুরু করে। এমন একটি মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল মুক্তিবাহিনী। পার্শ্ববর্তী ছাদের ওপর থেকে গর্জে ওঠে ইপিআর সৈনিকদের বসানাে এলএমজিসহ সব অস্ত্র । ধরাশায়ী হয় ২জন পাকিস্তানি। কিন্তু বাকি সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন গােলাম রসুল ভানুগাছের দিকে পালাতে সক্ষম হয়। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে ২টি গাড়িতে পাকিস্তানিরা খুব দ্রুত গতিতে আবার শমসেরনগর অতিক্রমের চেষ্টা করে। কিন্তু ছেলেরা তাদের অবস্থান পুনর্নির্বাচন করে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। গাড়ি ২টি শমসেরনগর চৌমােহনায় আসার সাথে সাথে অগ্নিবৃষ্টি শুরু হয় ছাদে বসানাে মুক্তিবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলাে থেকে। লুটিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন গােলাম রসুলসহ আরও ১০জন পাকিস্তানি। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি জঙ্গিবিমানগুলাে ২৯ ও ৩০ মার্চ পুরাে শমসেরনগর এলাকায় গুলি ও বােমাবর্ষণ করে। শমসেরনগর চৌমােহনার অ্যামবুশ প্রাথমিক প্রতিরােধের একটি সফল অভিযান। এতে পাকিস্তানি একজন অফিসারসহ ১২জন সৈনিক নিহত হয় এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১টি জিপ ও ১টি লরি। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং প্রচুর গােলাবারুদ। মুক্তিবাহিনীর সঠিক স্থান ও সময় নির্বাচনই শুধু নয়, দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় সংকল্প এবং দেশপ্রেমের অফুরন্ত প্রণােদনা ছিল প্রাথমিক এ যুদ্ধের সফলতার প্রধান কারণ। (শমসেরনগর-চৌমােহনার অ্যামবুশের নকশাটি দেখুন ৮৫৬ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড