রানীগাঁও অপারেশন
রানীগাঁও শায়েস্তাগঞ্জ থানা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত। আগস্ট মাসে হবিগঞ্জের খােয়াই নদীর তীরে রানীগাঁও এলাকায় একটি অপারেশন পরিচালনা করা হয়। চুনারুঘাট থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে খােয়াই নদীর অপর তীরে দালাল মাসুদ চৌধুরীর বাড়ি। আর একটু উত্তরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে তখন কার্যত রাজাকারদের বাসস্থান ছিল। বাগাই ঘাঁটি থেকে ৪০ সদস্যের ১টি মুক্তিযােদ্ধার দল এ রাজাকার ঘাটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা আবু মিয়া, আব্দুন নুর, রইছ আলী, আব্দুস শহিদ, আব্দুল হামিদ, আব্দুল কাইয়ুম, আজিম উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিন, আব্দুল মালেক, কালা মিয়া, আজিম উদ্দিন (২) ও রােশন আলী প্রমুখ। এ দলের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এম এ জাহির। ঘাঁটি থেকে রওনা হয়ে প্রায় ১৫ কিলােমিটার পায়ে হেঁটে অগ্রসর হতে হয় তাদের। রাত প্রায় ১১টায় খােয়াই নদীর তীরে পৌছান তারা। তারপর সেখান থেকে সােজা রানীগাঁও গ্রামে। এখান থেকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা। একসময় ঘেরাও করেন রাজাকার ঘাটি। তারপর শুরু করেন ফায়ারিং। হতভম্ভ হয়ে যায় রাজাকার বাহিনী। একসময় অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় রাজাকাররা। মুক্তিযােদ্ধারা লাভ করেন বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ।
হসালিয়ার সেতু ধ্বংস এবং একটালা আক্রমণ
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে থানা সদর থেকে বাল্লা সীমান্ত অভিমুখের সড়কে ইসালিয়া সেতুর অবস্থান। থানা সদর থেকে সেতুটির দূরত্ব ১০ কিলােমিটার। পাকিস্তানিরা এ সেতুটি পাহারার কাজে রাজাকারদের নিয়ােজিত করে। গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুটি ধ্বংস করতে পারলে বাল্লা সীমান্তের সাথে সড়কপথে চুনারুঘাটের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হবে। শত্রুর চলাচলও বিঘ্নিত হবে। এ লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইসালিয়ার সেতু ধ্বংসের এবং একঢালা রাজাকার ঘাটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ইপিআর-এর সুবেদার সামছুল হুদার অধিনায়কত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল প্রস্তুত হলাে। সংখ্যায় তারা ২১জন। সহ-অধিনায়ক ফয়সল আহমদ, চৌধুরী এবং সুবেদার এস এম চৌধুরী। এ ছাড়া ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল লতিফ, আব্দুর রহমান, আব্দুল লতিফ (২), কাজী গােলাম মরতুজ, আবুল হােসেন, মানিক মিয়া এবং আব্দুল মালিক প্রমুখ। সাথে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র এবং সেতু ধ্বংস করার জন্য শক্তিশালী ডিনামাইট। মুক্তিযােদ্ধারা খুবই সন্তর্পণে ডিনামাইট সেট করলেন এবং প্রায় বিনা বাধাতেই উড়িয়ে দেন ইসালিয়া সেতুটি। মুক্তিযােদ্ধারা এবার অগ্রসর হন একঢালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। ওখানে রয়েছে রাজাকারদের একটি ঘাঁটি। শক্ত অবস্থান তাদের। এখান থেকেই। তারা চালাচ্ছে হত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতাে নারকীয় সব তৎপরতা। গভীর রাত। রাজাকাররাও গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ঘুমন্ত অবস্থায়ই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। কিন্তু মুহূর্তেই তারা প্রস্তুত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাজাকাররা পালাতে বাধ্য হলেও এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধা আবদুস সাত্তার শহিদ হন।
কৃষ্ণপুর গ্রাম আক্রমণ
হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার অন্তর্গত ১ নম্বর লাখাই ইউনিয়নের একটি গ্রাম কৃষ্ণপুর। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিরা কিশােরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানা থেকে ১টি নৌকা ও স্পিডবােটযােগে কৃষ্ণপুর গ্রামে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এ গ্রামের নিপেন রায়ের প্রাচীর ঘেরা বাড়ির ভেতরে ১৫-১৬জন পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ১২জন মারা যায়। এর মধ্যে যে ৪জন বেঁচে যান তাঁদের মধ্যে ২জন হচ্ছেন ভূষণ চন্দ্র সূত্রধর ও মঞ্জু রায়। নিপেন রায়ের বাড়ির ৪০০-৫০০ গজ পশ্চিমে (গদাইনগর) চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ির উত্তরের ঘাটে ৩৫-৪০জন গ্রামবাসীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে স্টেনগান দ্বারা ব্রাশফায়ার করলে ১০-১২জন শহিদ হন। কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিপেন রায়ের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিক ও অন্যান্য স্থানে সর্বমােট ৪৬জনকে হত্যার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এঁদের অধিকাংশকেই। নিকটস্থ শশানে দাহ করা হয়েছে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড