কালেঙ্গা জঙ্গলের অ্যামবুশ
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার অন্তর্গত ১ নম্বর মিরাশী ইউনিয়নে কালেঙ্গা অবস্থিত। চুনারুঘাটের দক্ষিণে অবস্থিত কালেঙ্গা অরণ্যে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়স্থল নির্দিষ্ট অপারেশন এলাকায় তৎপরতা চালানাের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা। অরণ্য ব্যবহার করে। শত্রুরা এ বিষয়টি জানতে পেরে কালেঙ্গায় অপারেশন চালায়। সক্রিয় পর্যবেক্ষণের জন্য তারা রেস্ট হাউজে সদর দপ্তর স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা গােপন স্থান থেকে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধারা রেস্ট হাউজের পথে কয়েকটি অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন। স্থাপন করেন। শক্ররা ২০ সেপ্টেম্বর কালেঙ্গায় প্রবেশ করে। এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ ঘােরাফেরার পর রেস্ট হাউজে যাওয়ার পথে তাদের পায়ের চাপ লাগা মাত্রই একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এতে ১জন সৈন্য আহত হয় এবং বাকি। সৈন্যরা রেস্ট হাউজে না গিয়ে সিন্দুরখানের দিকে চলে যায়। পরদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা শক্তি বৃদ্ধি করে মাইন ফিল্ড অপসারণের জন্য ফিরে আসে। পাকিস্তানিরা এলাকাটিতে একটি শিবির স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং আরও একটি বড়াে আক্রমণের পরিকল্পনা নেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি দল কালেঙ্গা-সিন্দুরখান রােডের দুই পাশে জমায়েত হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি বৃহৎ দল কালেঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের পথ দেখিয়ে দিতে থাকে ২০-২৫জন রাজাকার। পাকিস্তানিরা আওতার মধ্যে আসতেই তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করা হয়। এ অ্যামবুশ এত চমৎকার হয়েছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নেয়ার সময় পর্যন্ত পায়নি। ফলে এক একটি বুলেটে এক একটি শত্রু ধরাশায়ী হয়। এমন সাফল্যের মাঝেও মুক্তিবাহিনীর ১জন শহিদ হন। নায়েক আব্দুল মান্নান এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি দাড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে শত্রু খতম করতে থাকেন। এতেও তিনি ক্ষান্ত না হয়ে অধিনায়কের কাছে বাহবা নেয়ার জন্য হঠাৎ করেই দল ত্যাগ করে শক্রব্যুহের দিকে অগ্রসর হন জীবিত শক্র ধরে। আনার জন্য কিন্তু শেষ রক্ষা হলাে না। পাকিস্তানিদের একটি বুলেট নায়েক আব্দুল মান্নানের দেহ বিদীর্ণ করে দেয়। ফলে তিনি তৎক্ষণাৎ শাহাদতবরণ করেন। এ অ্যামবুশে পাকিস্তানি ১জন অফিসার ও ৬১জন সৈনিক নিহত হয়। এ ছাড়া হতাহত হয় অসংখ্য সৈনিক এবং পালিয়ে যায় অনেকে।
কৈয়ারডালার যুদ্ধ
হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বদলপুর ইউনিয়নে কৈয়ারডালায় (বর্তমান গণকীরকান্দা) মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল। আজমিরীগঞ্জের পিটুয়ারকান্দায় ছিল পাকিস্তানিদের একটি অবস্থান। মুক্তিযােদ্ধা প্লাটুন অধিনায়ক জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় ১৫-২০জন। মুক্তিযােদ্ধা কৈয়ারডালায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ২ নভেম্বর প্রায় ৫০জন। পাকিস্তানি সৈন্যের ১টি দল মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। বিকাল ৪টা থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। জগৎজ্যোতি দাস পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অন্য সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি শত্রুর ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন একপর্যায়ে জগৎজ্যোতি দাস বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। পাকিস্তানিরা তার লাশ আজমিরীগঞ্জ বাজারে ঝুলিয়ে রেখেছিল ফলে তার লাশ আর উদ্ধার করা যায়নি।
দিনারপুর হাই স্কুলের যুদ্ধ
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ১১ নম্বর গজনাইপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম দিনারপুর (শতক গ্রাম)। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পাকিস্তানিরা দিনারপুর হাই স্কুল মাঠে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের ক্যাম্প স্থাপনের পর সুবেদার দেলােয়ার আলীর নেতৃত্বে প্রায় ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা শক্রর ঘাটি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে নায়েক তৈয়ব আলী (১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) শহিদ হন। সুবেদার দেলােয়ার আলী, মাহবুবুর রহমান সাদি ও আব্দুর রশীদের অধীনে ৭০-৭৫জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল নবীগঞ্জ থানায় হামলা চালায়। এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। দিনারপুর হাই স্কুলে অবস্থানকারী পাকিস্তানিরা গজনাইপুর পাহাড় থেকে ৬-৭জন মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে আনে এবং তাদের মধ্যে ৩জনকে স্কুল ভবনের পূর্ব কোণে হত্যা করে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড