মুক্তিযুদ্ধ হবিগঞ্জঃ মাধবপুরের অ্যামবুশ, হবিগঞ্জ ট্রেজারি লুট
মাধবপুরের অ্যামবুশ
২৮ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মাধবপুরের পতন ঘটে। পাকিস্তানি শত্রুরা শেরপুর-সাদিপুর লাইন আগেই দখল করে নিয়েছিল। এভাবে সিলেট মহাসড়ক শত্রুদের জন্য উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শক্ররা এ মহাসড়কটি নিজেদের যানবাহনের জন্য সরাসরি ব্যবহার করতে পারেনি। কেননা সড়কের ওপর সেতুগুলাে মুক্তিযােদ্ধারা ভেঙে দিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধারা যেখানে সেতু বিনষ্ট করেছেন, পাকিস্তানিরা মাটি ফেলে সেখানে ভিন্নমুখী রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। এ সড়কটি শত্রুদের চলাচলের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক করে তােলার জন্য মেজর কে এম সফিউল্লাহ সৈন্যদের পরামর্শ দেন এবং শত্রুদের কলাম সামরিক বহরকে অব্যাহতভাবে অতর্কিত আক্রমণের জন্যও নির্দেশ দেন। শত্রুদের যােগাযােগ। ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ ধরনের একটি অভিযানে ২য়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মােরশেদকে প্রেরণ করা হয়। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর কাছাকাছি নির্মিত এক বিকল্প রাস্তায় দুঃসাহসিক হামলা চালানাের জন্য তিনি পরিকল্পনা করেন এবং এর জন্য ২৩ মে দুপুর প্রায় ২টার । সময় তার সৈন্যদের ১২জনকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছান। সেখানে ২৩ মে দুপুর ২টার সময় ২টি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পেতে রেখে শত্রুদের জন্য অপেক্ষা। করতে থাকেন। প্রতীক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। রাত নেমে এল। সে । রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার লােকজন তখন।
কাকভেজা। তবু তারা ধৈর্য ধরে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা আসেনি। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার ১২জন সৈনিক বিদ্রি রাত যাপনের ফলে ক্লান্ত। অবশেষে কাছাকাছি এক পরিত্যক্ত গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন বেলা ৩টা। ১টি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে। সেখানে পৌছে লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার সৈন্যরা গােপনে সেতুর কাছে ঘটনাস্থলে যান। কনভয়ের সামনে ১টি জিপ এটি ১টি বড়াে ধরনের কনভয়। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ অতটা আঁচ করতে পারেননি। যাহােক, জিপটি যখন ডাইভারশন রােডের দিকে মােড় নিতে যায়, ঠিক তখনই পেতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। জিপটি হাওয়ায় উড়ে গিয়ে রাস্তার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয় জিপের ভাগ্যেও একই অবস্থা। কনভয়টি থেমে যায়।
এ পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট মােরশেদ তার সব কয়টি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। শত্রুরা মারাত্মক ক্ষগ্রিস্ত হয়। বহু হতাহত হয়। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ তার দলবলসহ দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। পাকিস্তানি শত্রুরা নিকটবর্তী গ্রামে মুক্তিযােদ্ধার আশ্রয়স্থল রয়েছে বলে সন্দেহ করে। শত্রুসৈন্যরা সংখ্যায় প্রায় ৩০০জন। গ্রামটি অবরােধ করে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা ও নির্যাতন চালায়। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার সঙ্গীরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন। অতঃপর গুলি ছুড়তে ছুড়তে সরে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী দুই মাইল পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট মােরশেদের দলকে ধাওয়া করে। উল্লেখ্য, এ ধরনের অপারেশনে এবারই প্রথম অ্যান্টি-ট্যাংক অর্থাৎ ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শত্রুর জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হয়।
১জন এনসিও অর্থাৎ নন-কমিশনড অফিসার এবং লেফটেন্যান্ট মােরশেদ। ব্যতীত ঐ অ্যামবুশ পার্টিতে মুক্তিযােদ্ধাদের দেওয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদের এ গ্রুপ থেকে সাদেক, ওয়াকার, ফজলে হােসেন, সাদি সেলিম, সালাম ও আনিস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
.
হবিগঞ্জ ট্রেজারি লুট
হবিগঞ্জ ট্রেজারি হবিগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের প্রথম দিকে অস্ত্র ও খাদ্য ইত্যাদির অভাব ছিল প্রবল। বিভিন্ন স্থানে থানা ট্রেজারি, খাদ্য গুদাম ইত্যাদি থেকে খাদ্য ও অস্ত্র তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। হবিগঞ্জ ট্রেজারিতেও অনুরূপ একটি রক্তপাতহীন যুদ্ধ হয়। সাবেক এম এন এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মানিক চৌধুরী সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেন। তার সাথে ছিলেন এম এন এ মােস্তফা আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত প্রমুখ। প্রাক্তন মুজাহিদ আব্দুন নুরও তাদের সাথে ছিলেন। পরিকল্পনা অনুসারে তারা অপারেশন চালান ট্রেজারিতে। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আকবর আলী খান কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে ট্রেজারির চাবি তুলে দিয়েছিলেন সরাসরি মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। ফলে রক্তপাতহীনভাবে ও বিনা বাধায় ট্রেজারির সমস্ত অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৫০টি রাইফেল ও ২২,০০০ রাউন্ড গােলাবারুদ ছিল। পরবর্তী সময় এগুলাে ব্যবহার করা হয়েছিল শেরপুর ও সাদিপুরের যুদ্ধে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড
ছবি ফাইল ফটো – সিলেটের একটি দল।