তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ
তেলিয়াপাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান হবিগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণে মাধবপুর থানার অন্তর্গত তেলিয়াপাড়া ইউনিয়নে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান অবস্থিত। ভারতীয় সীমান্ত থেকে তেলিয়াপাড়ার অবস্থান ৩ কিলােমিটার উত্তরে এবং মাধবপুর থেকে ৮ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে তেলিয়াপাড়া অবস্থিত। সিলেটের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া যােগাযােগের জন্য একটি আদর্শ স্থান। আখাউড়া-সিলেট রেললাইনের ওপর তেলিয়া রেল স্টেশন ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়কটি তেলিয়াপাড়ার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। উঁচু-নিচু অসংখ্য রাস্তাঘাট ও ভৌগােলিক অবস্থার বিবেচনায় তেলিয়াপাড়া ছিল প্রতিরক্ষার জন্য একটি আদর্শ স্থান। তেলিয়াপাড়া থেকে দক্ষিণ দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যর সঙ্গেও যােগাযােগ ব্যবস্থা আছে। তেলিয়াপাড়ার পার্শ্ববর্তী উল্লেখযােগ্য স্থানগুলাের মধ্যে জগদীশপুর, ইটাখােলা, সুরমা চা-বাগান, মাধবপুর, নােয়াপাড়া, লালচান্দ ও চুনারুঘাট অন্যতম। যুদ্ধের পটভূমি প্রতিরােধের প্রথম দিকে বাস্তব পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফ পাকিস্তানিদের সম্মুখ আক্রমণ না করে ব্যাটালিয়নসহ তেলিয়াপাড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মেজর খালেদ মােশাররফ অনুধাবন করেন যে, ভারতের একেবারে সীমান্তে তেলিয়াপাড়া আশ্রয়স্থল হিসেবে আদর্শ স্থান। সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত ও শক্তি সঞ্চয় করে পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব।
তা ছাড়া মেজর খালেদ মােশাররফের ব্যাটালিয়ন পূর্বে কুমিল্লায় থাকায় এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট ও লােকজন সব তাদের চেনা ছিল, যা কিনা ব্যাটালিয়নের কাজকে আরও সহজ করে দেয়। এ উদ্দেশ্যে মেজর খালেদ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরসহ ৩০ মার্চ তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে আসেন। এর মধ্যে মেজর খালেদ মােশাররফ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহকে তেলিয়াপাড়ায় আসার জন্য যােগাযােগ করেন। মেজর সফিউল্লাহ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর নিয়ে তেলিয়াপাড়া আসেন ২ এপ্রিল। ৩ এপ্রিল মেজর জিয়া তেলিয়াপাড়ায় আসেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে শত্রুর ওপর এলােপাতাড়ি আক্রমণ পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এ বিচ্ছিন্ন ঘটনা গুলােকে সংযােগ করা একান্ত প্রয়ােজন ছিল। তাই সেই পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়ােজন হয় নেতৃত্বের। এর পাশাপাশি প্রয়ােজন পড়ে একটি রাজনৈতিক পরিচয়, যা না হলে মুক্তিযুদ্ধকে একটি বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করার আশঙ্কা থাকে। ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এ দিন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলােয় মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী সিনিয়র সামরিক অফিসার ও অবসর গ্রহণকারী কিছু সিনিয়র অফিসাররা একত্রে এক সভায়। মিলিত হন। অধিনায়করা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ ও মতামত আদানপ্রদানের এক সুযােগ পান।
ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কাজী নূরুজ্জামান (অব.), মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী। পাকিস্তানিদের আক্রমণে প্রায় নির্দেশনাহীন অবস্থায় জাতির । ক্রান্তিকালে দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসাররা ঐ সভায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত। গ্রহণ করেন: ১. এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে। পরিচালিত হবে এবং এ দায়িত্ব অর্পিত হয় সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার কর্নেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর ওপর। মেজর খালেদের প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানসহ বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগ, অর্থনেতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায় এবং সামরিক সাহায্য সংগ্রহের জন্য অবিলম্বে একটি রাজনৈতিক সরকার গঠন করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক। নেতাদের অনুরােধ করা। মুক্তিযুদ্ধকে একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও যুদ্ধসামগ্রী দিয়ে। সহায়তা করার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠার মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪. এ সভায় যুদ্ধসম্পর্কিত এলাকার দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর সফিউল্লাহকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর খালেদ মােশাররফ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল । রেজিমেন্ট নিয়ে কুমিল্লা অঞ্চলে চলে যান। মেজর সফিউল্লাহ সদর দপ্তর স্থাপন। করেন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে। ভৈরব-আশুগঞ্জের (১১-১৫ এপ্রিল) যুদ্ধের পর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মাধবপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। শত্রুদের। আক্রমণে ২৮ এপ্রিল মাধবপুরের পতন হলে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মূলত । তেলিয়াপাড়া ও মনতলা অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে।।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তেলিয়াপাড়ার সামরিক গুরুত্ব যােগাযােগ ব্যবস্থা ভালাে বলে উভয় পক্ষের কাছেই তেলিয়াপাড়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক ও মাধবপুর-জগদীশপুর-শায়েস্তাগঞ্জ সড়কটি তেলিয়াপাড়ার ওপর দিয়ে গিয়েছে। কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যােগাযােগ, রসদ ও মালামাল সরবরাহের জন্য তেলিয়াপাড়া দখল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে তেলিয়াপাড়া ছিল এ অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর। তেলিয়াপাড়া ও মনতলা ছাড়া আর কোনাে মুক্তাঞ্চল ছিল না। সে জন্য তেলিয়াপাড়া দখলে রেখে শত্রুদের চলাচলে বাধা দান এবং কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে তেলিয়াপাড়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধের সংগঠন উভয় বাহিনীর যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিমরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সদর তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত ছিল। প্রথম দিকে ‘ডি’ কোম্পানি থাকলেও পরবর্তী সময় ঐ কোম্পানি মনতলা চলে যায়। তেলিয়াপাড়ার প্রতিরক্ষার জন্য প্রথমে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবং পরবর্তী সময় ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে ১টি ইপিআর কোম্পানি মােতায়েন করা হয়। এর সঙ্গে প্রায় ৭০জন গণযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ২. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানিদের ১টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও আর্টিলারি ব্যাটারি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অবস্থান
১. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানিদের কিছু অংশ মাধবপুর ও জগদীশপুর এলাকায় অবস্থান করছিল। এ ছাড়া চুনারুঘাট এলাকা থেকেও কিছু সৈন্য এ যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনী: তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অবস্থিত মেজর সফিউল্লাহর সদর দপ্তরকে কেন্দ্র করে তেলিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে ওঠে। এখানে মুক্তিবাহিনীর প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়। সুরমা চা-বাগানের দক্ষিণে, তেলিয়াপাড়া ও সেখানকার অংশবিশেষ এ প্রতিরক্ষা লাইন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পূর্বপশ্চিম দিকের একটি নালা তেলিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভক্ত করেছে। আখাউড়া-সিলেট রেল রাস্তা প্রতিরক্ষা লাইনের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত হয়ে অভ্যন্তরীণ বৃত্তের পশ্চিম সীমারেখা গঠন করে। ইটাখােলা-চুনারুঘাট মহাসড়ক হচ্ছে এর উত্তরাংশের শেষ সীমা। ভেতরে রেলরাস্তার অংশটি চুনারুঘাট মহাসড়ক একটি অর্ধচন্দ্রাকার অবস্থা তৈরি করেছে। এখানে চা-বাগানের কয়েকটি দালান অবস্থিত। নালার উত্তর দিকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর। ঐ চক্রাকার প্রতিরক্ষা অবস্থানের মধ্যে ছিল এক বর্গমাইল এলাকা। তেলিয়াপাড়ার ৫ কিলােমিটার দক্ষিণে মনতলায় ক্যাপ্টেন নাসিম এবং আরও দক্ষিণে হরষপুরে মেজর মঈন তার কোম্পানি মােতায়েন করেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান চুনারুঘাটের দক্ষিণ এলাকায় তার কোম্পানি (ইপিআর) নিয়ে অপারেশন পরিচালনা করছিলেন।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
১. মুক্তিবাহিনী: মেজর সফিউল্লাহ পরিকল্পনা করেন যে শত্রুরা যেখানে দুর্বল, সেখানে আঘাত হানা হবে। শত্রুর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের চেয়ে মুক্তিবাহিনী চোরাগুপ্তা আক্রমণ, যােগাযােগ ব্যবস্থা বন্ধ ও ধ্বংস করাকেই প্রাধান্য দেয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে তেলিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি কা হয়। মুক্তিযােদ্ধা তেলিয়াপাড়ায় অবস্থান গ্রহণ করায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে সিলেট থেকে ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে রেল ও সড়কপথে যােগাযােগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছিল না। এর ফলে তাদের সামরিক অভিযানে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এর জন্য তারা তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। মেজর সফিউল্লাহ এমনভাবে তাঁর অবস্থান গ্রহণ করেন, যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তেলিয়াপাড়ার ওপর দিয়ে চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। মেজর সফিউল্লাহর সদর দপ্তর রক্ষা এবং ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে প্রতিরক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন মতিন ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি ইপিআর কোম্পানি চা-বাগানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। তেলিয়াপাড়ার সুরমা, নােয়াপাড়া, চুনারুঘাট পুরােটাই একটি চা-বাগান নিয়ে ঘেরা এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে। ২৫ কিলােমিটার দীর্ঘ এ রাস্তাটি পাকিস্তানের জন্য মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়।
কারণ এ রাস্তায় মুক্তিযােদ্ধারা সুযােগ পেলেই চালাতেন চোরাগুপ্তা আক্রমণ। ২. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানিরা মাধবপুর ও চুনারুঘাট এলাকা থেকে ধীরে ধীরে তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করে যুদ্ধের বিবরণ ব্যাপক সংঘর্ষের চেয়ে মুক্তিবাহিনী রেইড, অ্যামবুশ ইত্যাদি মাইনর অপারেশন পরিচালনায় অধিকতর গুরুত্ব দেয় ঐ লক্ষ্যে মে মাসে অনেক রেইড ও
অ্যামবুশ পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ক্যাপ্টেন মতিনের শাহজীবাজার বিদ্যুৎ স্টেশন রেইড, নােয়াপাড়া গ্রামে অ্যামবুশ শাহপুরে অ্যামবুশ এবং লালচান্দ চা-বাগানে অ্যামবুশ। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ বাগসাইর গ্রাম ও চুনারুঘাট-তেলিয়াপাড়া সড়কে শত্ৰু কনভয়ের ওপর অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। ৬ মে পাকিস্তানিরা দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। শক্ররা ভারতীয় বিএসএফ-এর ছদ্মবেশে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা এলাকায়। প্রবেশ করে। শত্রুরা একটি অভ্যন্তরীণ বৃত্ত তৈরি করে। তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল দৃঢ় ও সংহত। যােগাযােগ পরিখাসহ উস্থিত আচ্ছাদন। এদিক-ওদিক চলার জন্য উপযােগী। ক্যাপ্টেন মতিনের সৈন্যরা ৭ দিনের একটি অপারেশন পরিচালনার পর ক্লান্ত ছিল, ফলে শত্রুর আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলেন। যাই হােক ক্যাপ্টেন মতিনের নির্দেশে সৈন্যরা শত্রুর মােকাবিলা করে। এ যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক আবদুর রহমান তার মেশিনগান নিয়ে অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন।
মূলত মেশিনগানের গুলিতে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত হয় ক্যাপ্টেন মতিন মুক্তিযােদ্ধাদের শত্রুর পিছনে ধাওয়া করার নির্দেশ দেন। এ আক্রমণে শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যাও কম ছিল না। ৮ মে শত্রুরা জগদীশপুরে ১টি গােলন্দাজ ইউনিট নিয়ে আসে। সারাদিন ধরে থেমে থেমে তেলিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে গােলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু উল্লেখযােগ্য কোনাে ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়। ১০ মে শত্রুরা পুনরায় গােলা নিক্ষেপ শুরু করে এবং ১ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। এবারও কোনাে ক্ষতি করতে পারেনি। এভাবে তেমন কোনাে পরিবর্তন ছাড়া আরও কয়েক দিন যায়। শত্রুদের চাপ ক্রমশ বেড়ে চলে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অটুট থাকে। পাকিস্তানিরা উল্লেখযােগ্য কোনাে ক্ষতি করতে পারেনি। কখনাে সরাসরি, আবার কখনাে অতর্কিত শত্রুর আক্রমণ চলতে থাকে। গত কয়েক দিনের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি মারাত্মক ধরনের। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। তেলিয়াপাড়া মুক্ত রাখতে গিয়ে তার সৈন্যদের ৫০জন জীবন দিয়েছেন। সে জন্য তাদের বিশ্রামের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯ মে লেফটেন্যান্ট মােরশেদের সৈন্যরা ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করে লেফটেন্যান্ট মােরশেদের দুর্ভাগ্য যে, সেদিনই পাকিস্তানি বাহিনী এক ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। এর আগে গােলন্দাজ বাহিনী গােলাবর্ষণ করে।
অনিয়মিত সৈনিকদের নিয়ে লেফটেন্যান্ট মােরশেদের বাহিনী গঠিত ছিল। আর অবস্থান সুসংহত করার আগেই পাকিস্তানিদের অভিযান শুরু হয়। শত্রুদের দুর্বল করার জন্য মটার ব্যবহার করা হয়। পর্যায়ক্রমিক আগ্নেয়াস্ত্রের সহযােগিতা দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট মােরশেদকে। কিন্তু শত্রুরা বেষ্টনী ভেঙে ফেলার কাজে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে। এ রকম পরিস্থিতিতে মেজর সফিউল্লাহ তার সদর দপ্তর আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থান সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সন্ধ্যার আগে লেফটেন্যান্ট মােরশেদও তেলিয়াপাড়া ছেড়ে ভারতে গমন করেন। এটি ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে একটি মরণ আঘাত। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধারা যে কেবল অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হন তা নয়, তারা মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েন। তেলিয়াপাড়া হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি হজম করা মেজর সফিউল্লাহর সৈন্যদের জন্য বড়াে কঠিন হয়ে যায়। তারা কিছুতেই তা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। কোম্পানিটি নিজেদের অবস্থান রক্ষা করার ২০ দিনব্যাপী সংগ্রামে কয়েকজন অসম সাহসিক সৈনিককে হারিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা তেলিয়াপাড়া পুনর্দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার ফলে প্রতি-আক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়ে যায়। পরদিন সকালে ২০ মে ক্যাপ্টেন মতিন ও লেফটেন্যান্ট মােরশেদ প্রতিআক্রমণ শুরু করেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ তাদের অনুকূলে ছিল না। শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। এর ফলে ক্যাপ্টেন মতিন লেফটেন্যান্ট মােরশেদ তেলিয়াপাড়া থেকে পুনরায় ভারতীয় এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধার এ পরাজয় ছিল সাময়িক। ভারতের অবস্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পুরাে ৯ মাস তেলিয়াপাড়া অঞ্চলে রেইড বা অ্যামবুশ চালিয়ে পাকিস্তানিদের ব্যস্ত রাখে।
যুদ্ধের ফলাফল
তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে ১৯ মে পাকিস্তানিদের আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী তেলিয়াপাড়া থেকে ভারতে অবস্থান গ্রহণ করে। তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষেও হতাহতের সংখ্যা অনেক তেলিয়াপাড়ার পতন হলেও মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়ার অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠক, সঠিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা দান করে। তেলিয়াপাড়া মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ মুক্তাঞ্চল হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে বহু শহিদ হওয়া সৈনিকের তালিকায় রয়েছেন নায়েক নিজামুদ্দিন, ল্যান্স নায়েক ইসলাম মিয়া, সিপাহি মােবারক আলী, রঙ্গু মিয়া, গফফার মিয়া, আলী আজম ভূঁইয়া, জামালুদ্দিন, আবু মিয়া, মােজাহিদ, গিয়াসুদ্দিন ও আলকাস মিয়া। তেলিয়াপাড়া পতনের পর শুধু মনতলা ও সিংগার বিলের এক টুকরাে ভূখণ্ড মুক্তিবাহিনীর হাতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধে পরাজিত হলেও সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে শত্রুদের পক্ষে অসংখ্য হতাহত হয়।
যুদ্ধের সার্বিক মূল্যায়ন
১. মুক্তিবাহিনীর ব্যর্থতার কারণ: মুক্তিবাহিনীর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র এবং প্রয়ােজনীয় সরঞ্জামাদির অভাব এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে যােগাযােগের অভাব তা ছাড়া স্থানীয় জনগণের কিছুটা অসহযােগিতা এবং লজিস্টিক সহায়তার অভাব ছিল পরাজয়ের অন্যতম কারণ। ২. পাকিস্তানি বাহিনীর সাফল্যের কারণ: পাকিস্তানি বাহিনীর সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল আকস্মিক আক্রমণ, সৈন্যবলের পর্যাপ্ততা ও উন্নতমানের অস্ত্র, সরঞ্জামাদি। পাকিস্তানি বাহিনী এ যুদ্ধে ব্যাপক আর্টিলারির সমর্থন পেয়েছিল।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড