You dont have javascript enabled! Please enable it!
মাধবপুরের প্রতিরােধ যুদ্ধ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান
হবিগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণের থানা মাধবপুর। মাধবপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৩২। কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে এবং সরাইল থেকে ২০ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলটি আশপাশের অঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে নিচু। তিতাস নদ ও এর । শাখা সােনাই নদী এলাকাটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। এ ছাড়া কিছু খাল। এলাকাটির উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। পশ্চিমে হরিণবেড়ের কাছে রয়েছে তিতাস। নদের প্রশস্ত বাঁক। এ নদ এবং বেঁকে যাওয়া অংশটি ছিল মাধবপুরের প্রতিরক্ষা। অবস্থানের জন্য একটি সহায়ক প্রতিবন্ধকতা। মধ্যবর্তী ভূমি ভগ্ন এবং উঁচু-নিচু । প্রকৃতির পূর্ব পাশে আন্তর্জাতিক সীমারেখা। সব মিলিয়ে বিছিন্ন ও সংকীর্ণ। এলাকাটি প্রতিরােধ অবস্থা গড়ে তােলার জন্য ছিল খুবই উপযােগী যুদ্ধের পটভূমি আশুগঞ্জ, ভৈরব পতনের পর মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মাধবপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। আশুগঞ্জভৈরববাজার-লালপুরের যুদ্ধে (১৩-১৫ এপ্রিল) শত্রু ধীরে ধীরে মাধবপুর এলাকায় অগ্রসর হয়। শাহবাজপুর দখলের পরই মাধবপুরের শত্রুর সঙ্গে বড়াে। আকারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানিদের একটি ব্রিগেড সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
মহাসড়কের ওপর গুরুত্বপূর্ণ মাধবপুর দখল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। হবিগঞ্জের মাধবপুর থানা অন্যান্য স্থানের তুলনায় নীচু, অসমতল, উঁচু-নিচু কিছু এলাকা চা-বাগানে ঘেরা। তা ছাড়া এটা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়কের ওপরে এখান থেকে সংযােগ সড়ক জগদীশপুর-হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জের সাথে সংযােগ স্থাপন করেছে। পক্ষান্তরে এলাকাটি ছিল সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি। পাকিস্তানিরা সীমান্তবর্তী এলাকা ও সরবরাহ লাইন রক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল তাই তারা মাধবপুর যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনা করে। মাধবপুর দখলে। আনতে পারলে শক্রর জন্য সরবরাহ লাইন ও তেলিয়াপাড়াস্থ ২য় ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্টের সদর দপ্তর আক্রমণ সহজ হতাে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঐ স্থানের গুরুত্ব বা সামরিক গুরুত্ব মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর থানা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাধবপুর ছিল বৃহত্তর সিলেটের প্রবেশদ্বার। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানিদের জন্য মাধবপুর থানা সদর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়ক আয়ত্তে রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরি। যে কারণে মাধবপুর দখলে রাখা ছিল উভয় বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যুদ্ধের সংগঠন
১. মুক্তিবাহিনী: মাধবপুরের যুদ্ধে মূলত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩টি কোম্পানি ও ইপিআর-এর ২টি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে উল্লেখযােগ্যসংখ্যক আনসার ও বেসামরিক যােদ্ধা প্রতিরােধযুদ্ধে অংশ নেন। ২. পাকিস্তানি বাহিনী: ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, ১টি মর্টার ব্যাটারি, ১টি ফিল্ড ব্যাটারি ও রিজার্ভ ফোর্স মাধবপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অবস্থান ও পরিকল্পনা | ১. মুক্তিবাহিনী: মাধবপুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে সােনাই নদীর লাগােয়া এলাকায় ডান পার্শ্বে ক্যাপ্টেন মতিনের ইপিআর কোম্পানি কৈতরা গ্রামে মােতায়েন ছিল। ক্যাপ্টেন নাসিম ও তার কোম্পানিকে সেতু রক্ষার দায়িত্বে ৩টি ৮২ মিলিমিটার মর্টার দ্বারা ফায়ার সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা অবস্থানের পিছনে রেজুরা এলাকায় লেফটেন্যান্ট মান্নানের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারে অবতরণকৃত সৈন্য বিধ্বংসী ১টি প্লাটুন মােতায়েন করা হয়। মাধবপুর এলাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মেজর সফিউল্লাহর পরিকল্পনায় গড়ে ওঠে। মাধবপুর প্রতিরক্ষা প্রস্তুতকালে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি (ইপিআর) শাহবাজপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। আশুগঞ্জ থেকে পশ্চাদপসরণের পর ক্যাপ্টেন নাসিম তার কোম্পানি নিয়ে মাধবপুর থানা সদর এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট-মাধবপুর সড়কের উভয় পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। শাহবাজপুর থেকে প্রত্যাহারের পর ক্যাপ্টেন মতিন ইপিআর কোম্পানি নিয়ে মাধবপুর বাজারের পশ্চিমে কৈতরা গ্রামে অবস্থান নেয়। সুবেদার মজিবুর রহমান ইপিআর কোম্পানি নিয়ে ২টি শাখায় বিভক্ত রাস্তার মােড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট মান্নানের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারে অবতরণকৃত সৈন্য। বিধ্বংসী ১টি প্লাটুন মােতায়েন করা হয় আরও উত্তরে ।
পাকিস্তানি বাহিনী: মাধবপুর যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, গােলন্দাজ ও বিমান আক্রমণসহ শাহবাজপুরে অবস্থান করে মাধবপুর সড়কে অগ্রাভিযান শুরু করে। মাধবপুর দখল করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, পর্যাপ্ত গােলাবারুদ ও বিমান-সমর্থনসহ আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তারা নৌ ও সড়কপথে গমনাগমনেরও পরিকল্পনা নেয়।
যুদ্ধের বিবরণ
২৮ এপ্রিল সকাল ৮টায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনী গােলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানিরা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ । আগুনের বােমা বেপরােয়াভাবে ব্যবহার করে। ফলে প্রতিরক্ষার চারদিকে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। শক্রর প্রধান অংশ দুপুর ১২টায় প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে। এসে অবস্থান নেয়। শত্রু তিন দিক থেকে দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে। ১টি দল। ডান পাশে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে, আরেকটি দল সম্মুখস্থ ২টি। কোম্পানির মাঝামাঝি স্থানে আক্রমণ চালায়। তৃতীয় দলটি ক্যাপ্টেন নাসিমের ওপর সামনাসামনি আক্রমণ করে। এভাবে শুরু হয় ব্যাটালিয়নের মুখােমুখি। আক্রমণ তৎপরতা। তার পিছনে অনুসরণ করে আরেকটি পাকিস্তানি। ব্যাটালিয়ন। বিশেষভাবে তৈরি পরিখা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি, মর্টার ও রাইফেল নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রুর মধ্যবর্তী কলাম ক্যাপ্টেন নাসিম। ও ক্যাপ্টেন মতিনের সম্মিলিত অবস্থানে ভাঙন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি কোম্পানি শত্রুদের উপর্যুপরি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ডান দিকের অগ্রসরমাণ ক্যাপ্টেন। নাসিমের প্লাটুন এবং বাম দিকের ক্যাপ্টেন মতিনের প্লাটুনের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে আংশিকভাবে ভেতরে ঢুকে যায়। এ দলটি বেলা ৩টায় আরও উত্তর। দিকের অবস্থানে আসে এবং ডান পার্শ্বে প্রধান সড়কে মােড় নিয়ে ক্যাপ্টেন। নাসিমের অবস্থানে আঘাত করে।
এ অবস্থায় সম্মুখস্থ ২টি কোম্পানির পারস্পরিক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আক্রমণকারী সৈন্যদের প্রবল চাপে। ক্যাপ্টেন মতিনের বাম পার্শ্বের অবস্থান ভেঙে যায় এবং প্রতিরক্ষা অবস্থান। নাজুক হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিবেষ্টিত হওয়ার আশঙ্কায় অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মতিনকে পিছনে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট মােরশেদের রিজার্ভ প্লাটুনকে শক্রর ডান দিকে আক্রমণের আদেশ দেওয়া হয়। শত্রু যখন ক্যাপ্টেন নাসিম ও ক্যাপ্টেন মতিনের মধ্যকার এলাকায় ঢুকে পড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন আলীনগর গ্রাম থেকে ডান দিকে শক্রর ডান। দিকের পিছনের অংশে লেফটেন্যান্ট মােরশেদের নির্দেশ অনুযায়ী আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে। এর ফলে শত্রুর সম্মুখ আক্রমণ প্রতিহত হয় এবং শত্রুর। পশ্চাদপসরণ করে যাওয়ার সুযােগ সৃষ্টি হয়। এটা ছিল জীবন রক্ষাকারী অভিযান, যা লেফটেন্যান্ট মােরশেদ চমক্কারভাবে সম্পন্ন করেন। লেফটেন্যান্ট মােরশেদের সফল আক্রমণের ফলে শত্রু বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। পলায়নপর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির সিপাহি মফিজ এ যুদ্ধে বিরল শৌর্য প্রদর্শন করেন। লেফটেন্যান্ট মােরশেদের আক্রমণে শত্রুরা পিছু হটলে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মাধবপুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মনতলার দিকে পশ্চাদপসরণ করে।
যুদ্ধের ফলাফল
এ যুদ্ধে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযােদ্ধারা দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে অসংখ্য হতাহত হন এবং শত্রুর প্রায় ২৭০জন হতাহত হয়। শত্রুর তুলনায় অস্ত্র, সরঞ্জামাদি ও প্রশিক্ষিত জনবল কম থাকলেও মুক্তিযােদ্ধারা সাহস, নৈপুণ্য ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে শত্রুদের মােকাবিলা করেন এবং প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন। নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মাধবপুর থেকে মনতলা এলাকায় নতুন অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!