কুড়িগাঁও আক্রমণ
তখন ছিল নভেম্বর মাস। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটতে শুরু করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। যদিও শত্রুদল পশ্চাদপসরণ করছিল তার পরও তেলিখাল থেকে মাত্র ২ কিলােমিটার দক্ষিণে তারা একটি শক্তিশালী ব্যুহ তৈরি করার চেষ্টা করে এবং আবারাে সংঘর্ষ বাধে। কিন্তু এ যুদ্ধ ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়েই শক্রদল পালিয়ে যায় । ২৫ সেট ইউনিফর্ম, ১৫ জোড়া বুট জুতা, ৮ বস্তা ইটা, ৩ বস্তা চাল ও বেশ কিছু গােলাবারুদ ফেলে পালিয়ে গিয়ে তারা তাদের প্রাণ রক্ষা করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কেউ হতাহত হয়নি। পাকিস্তানিদের পক্ষেও হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। কারণ, যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি কোনাে সদস্যের মৃতদেহ বা তাদের কারও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নজরুল ইসলাম, সুরুজ আলী, আবদুল আজিজ, নুরুল হক, অধিনায়ক আবদুল কাদির প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর এ দলটি সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
গনিগঞ্জ রেইড
১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর, সুনামগঞ্জ শহরের ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে জয়কলস গ্রামে আনুমানিক রাত ১২টা নাগাদ খবর আসে, ২জন মিলিশিয়া ও ৮জন রাজাকারের ১টি দল গনিগঞ্জ গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালাচ্ছে। এর আগেও তারা একইভাবে পুড়িয়ে দেয় গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এ সংবাদ পৌছামাত্র তারা প্রতিশােধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। এ উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিকভাবে শক্রর ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। গনিগঞ্জের উত্তরে ইমামগঞ্জ। যে পথ দিয়ে শত্রু ক্যাম্পে ফেরত যাবে, সেখানেই তারা ফাঁদ পেতে শক্রর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু চতুর পাকিস্তানি সেনারা পায়ে চলার পথ ব্যবহার না করে নৌপথে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়। তাদের নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী শত্রু একই পথ ব্যবহার না করলেও মুক্তিযােদ্ধারা অল্প কিছুক্ষণ পরই শত্রুর চতুরতা বুঝতে পারেন এবং তাদের নৌকার ওপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করেন। ফলে খুব সহজেই শত্রুপক্ষ প্রতিহত হয়। শত্রুপক্ষকে বহনকারী নৌকাটি কালনী নদীর অথৈ জলে তলিয়ে যায় এবং ১জন মিলিশিয়া ও ১জন রাজাকার নিহত হয়, বাকি অন্য সবাই কমবেশি আহত হয়ে নদী সাঁতরে অন্য তীরে আশ্রয় নেয়। আহত রাজাকাররা আফজালাবাদ বাজারের দিকে যাওয়ার পর এক লঞ্চভর্তি পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে এবং মুক্তিযােদ্ধারাও পাল্টা জবাব দিলে লঞ্চটি পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনােরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বেহেলী রেইড
সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রাম বেহেলী এ গ্রামের বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে করুণাসিন্ধু রায়, বরুণ রায় এবং লােকসংগীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর নাম উল্লেখযােগ্য জামালগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত এবং বিভিন্ন রকম অস্ত্র, গােলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য পাকিস্তানিরা গ্রামের এ পথটি ব্যবহার করতাে। তাই এ পথে পাকিস্তানিদের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য অধিনায়ক জিয়াউদ্দিন ও গােলাম রসুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল প্রেরণ করা হয়। কিন্তু গােপন সূত্রে পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনার কথা জেনে যায় এবং ২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা সাহসের সাথে লড়াই করে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করেন। এভাবে পর পর ৩ দিনে ৩টি যুদ্ধ হয় এবং প্রতিটিতেই মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হন। শেষে পাকিস্তানিরা বিমান হামলা শুরু করেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর শুধু ১জন শহিদ এবং অন্যজন গুরুতর আহত হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড