আনন্দনগর আক্রমণ
অন্য সব অঞ্চলের মতাে সুনামগঞ্জ মহকুমার জামালগঞ্জ থানার সাচনা বাজারেও রয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্প। এখান থেকে একদিন ১ সেকশন পাকিস্তানি সৈন্য রসদপত্র নিয়ে যাচ্ছিল তাহিরপুরে সাচনা, গােবিন্দপুর ও তাহিরপুর রুটে যাওয়ার সময় আনন্দনগরে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে যায় তারা আগে থেকেই এখানে অবস্থান করছিল ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা। তাদের মধ্যে ছিল এমএফ ও গণবাহিনীর সদস্যেরাও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এমএফ জিয়া এবং গণবাহিনীর মুজাহিদ। ২ নভেম্বর তাঁরা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয়। অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সংঘর্ষ শেষে মুক্তিযােদ্ধারা এখান থেকে ২টি রাইফেল এবং প্রচুর রসদপত্র লাভ করেন। এসব রসদপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয় বড়ছড়ায় এখানেই সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনের সদর দপ্তর।
তাহিরপুর আক্রমণ
সুনামগঞ্জ মহকুমার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের একটি থানা তাহিরপুর। শনির ও দেখার হাওরের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় একটি দ্বীপের মতাে দেখায় এ থানা সদরকে। গ্রাম ও হাওর দ্বারা পরিবেষ্টিত এ জনপদ সুনামগঞ্জ মহকুমার সাথে তাহিরপুরের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নদীপথ। তাহিরপুর থানা সদর দিয়েই নদীপথে টেকেরঘাটের পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান দেওয়া হয়। তাই নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য হাওরগুলাের ওপর সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে এ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার স্বার্থে পাকিস্তানি বাহিনী শত শত সৈন্য, ভারী অস্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণে গােলাবারুদের সমাবেশ ঘটায় ঐ অঞ্চলে দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী সার্বক্ষণিক নিজেদের কাজে ব্যবহারের জন্য অসংখ্য জলযান, নৌকা, স্পিডবােট, লঞ্চ এবং সেগুলাের চালকদের আটকে রাখে এসব জলযান ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে চরিতার্থ করতাে তাদের হীন স্বার্থ ধরে নিয়ে আসতাে সুন্দরী গ্রাম্য মেয়েদের তাদের আটকে রেখে তারা দিনের পর দিন পর্যায়ক্রমে ভােগ করতাে, আবার একসময় কাউক ছেড়ে দিত ক্ষতবিক্ষত দেহে পুনরায় ধরে নিয়ে আসতাে ভাগ্যহীনা নতুন কোনাে বাঙালি তরুণীকে। এভাবেই তাহিরপুরে চালিয়ে যায় ঘৃণ্যতম পৈশাচিকতা। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় তাহিরপুর আক্রমণ করার। প্রায় ৩০০ যােদ্ধাকে নিয়ে সংগঠিত হয় ঐ বাহিনী। সংগ্রহ করা হয় প্রচুর অস্ত্র, গােলাবারুদ ও নৌকা। পূর্ব থেকেই রেকি এবং আক্রমণ পরিকল্পনার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল এবং এ অভিযানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় আক্রমণ পরিচালনার জন্য সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিবাহিনী নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে যায়। পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ চলে পুরাে ২ দিন।
তবে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটানাে সম্ভব হয় না। মুক্তিবাহিনী ১২ দিন ধরে তাহিরপুর অবরােধ করে রাখে। অন্যান্য বিকল্প পথও গ্রহণ করে তারা। তাহিরপুরের সাথে সমস্ত যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় খাদ্য সরবরাহ। ফলে তাহিরপুর ত্যাগ করে চলে যেতে হয় পাকিস্তানিদের। এখানকার লড়াইয়ে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। কমিউনিস্ট নেতা নজির হােসেন এ যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এর আগে অবশ্য ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিন ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে তাহিরপুরে আরেকটি অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পূর্বের রেকি অনুযায়ী। মুসলিম ও মাহফুজ ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে অগ্রসর হলেন পাকিস্তানি বাহিনীর সংখ্যা প্রায় ১ কোম্পানিরও বেশি। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা একটি সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তবু বাংলার স্বাধীনতাপাগল দামাল ছেলেরা মুসলিম উদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের এ অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানিরা প্রথমেই একেবারে কাবু হয়ে যায় নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার আগেই লুটিয়ে পড়ে একের পর এক পাকিস্তানি সেনা। মাত্র আধা ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের যে এত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, ব্যাপারটা ক্যাপ্টেন মুসলিম কল্পনাও করতে পারেননি মৃত্যুর কোলে তখন ঢলে পড়েছে। ৩৮জন পাকিস্তানি সেনা আহতও হয়েছে অসংখ্য কিন্তু ততক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়েছে তারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে শুরু করে পাল্টা আক্রমণ এবার মুক্তিবাহিনী সে আক্রমণে টিকতে পারলাে না। শহিদ হলেন আবুল কাশেম। তারপর সরে আসলাে মুসলিমউদ্দিন ও মাহফুজের দল।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড