টেবলাই রেইড
সুনামগঞ্জ মহকুমার পূর্বের সীমান্তবর্তী থানা ছাতকের একটি গ্রামের নাম ছিল টেবলাই ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। এ মাসেই অবস্থান নিয়েছে শেলা সাব-সেক্টরভুক্ত মুক্তিবাহিনীর ১টি দল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্লাটুন অধিনায়ক এম এ হাসিব। উদ্দেশ্য এ স্থান থেকেই পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিত হামলা করা। পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল পায়ে হেঁটে ও নৌকায় এসে এ স্থানেই অবস্থান নিয়েছে। ইতােমধ্যে তারা শত্রুপক্ষের অবস্থানসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছে। এখন তৈরি হবে পরিকল্পনা। একদিন পরিকল্পনা তৈরি হতেই মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি গ্রহণ করে এমন অবস্থায় ২৫ সেপ্টেম্বর ভাের সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানিরা তাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। সংখ্যায় তারা ৫০জন সাথে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এরা মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে খবর পেয়েছে দোয়ারা বাজার থেকে। তারপর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকে কোনাে দল নৌকায়, আবার কোনােটি পায়ে হেঁটে।। এভাবে এগিয়ে এসে একসময় পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে অবস্থান নিয়ে মিলিতভাবে মুক্তিবাহিনীর ওপর একযােগে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা মুক্তিবাহিনীর ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ছিল হালকা অস্ত্র আর তা দিয়েই তারা মােকাবিলা করতে থাকেন। মর্টারের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন কিছুক্ষণ পর মুক্তিযােদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে পিছিয়ে যান বাঁশতলা পর্যন্ত। সেখানে ছিল সাব-সেক্টর সদর দপ্তর আর বাঁশতলা থেকে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে আবার তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এবারের এ মুখােমুখি আক্রমণে দাঁড়াতে পারলাে না পাকিস্ত নিরা। ৪ ঘণ্টার যুদ্ধ শেষে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানিরা। ঐ সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায় ৪জন পাকিস্তানি সৈন্য। আহত হয় অনেকে। ১জন মুক্তিযােদ্ধাও এ যুদ্ধে শহিদ হন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সাথে মিশে যায় শেলা সাব-সেক্টরের ১জন মহান শহীদের শােণিত ধারা। টেবলাই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাব লাভ করেন আবুল হালিম সরকার, আব্দুল মজিদ ও ইদ্রিস আলী।
আমবাড়ি যুদ্ধ
সুনামগঞ্জ সদর থানার একটি গ্রাম আমবাড়ি। ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর। এ আমবাড়ির পথ দিয়েই পাকিস্তানিরা যােগাযােগ রক্ষা করে চলছে টেংরাটিলা, দোয়ারা বাজার, ছাতক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সঙ্গে ইতােমধ্যেই এ খবরটি মুক্তিবাহিনী জেনে যায়। আর তাই তারা পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যেই নতুন করে পরিকল্পনা করে, আলােচনা হয় নিজেদের মধ্যে। তারপর গৃহীত হয় অপারেশনের পরিকল্পনা। অবশেষে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল আসে আমবাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে নদী প্রবাহিত। তীরে পুঁতে রাখে তারা ‘শ খানেক বুবিট্র্যাপ আর ২টি মাইন একসময় পাকিস্তানিদের ৩০জনের ১টি দল এসে উপস্থিত হলাে প্রত্যেকের হাতে প্রচুর অস্ত্র আর গােলাবারুদ হাঁটছে তারা গন্তব্যস্থল লক্ষ্য করে একসময় এভাবে হাঁটতে হাটতে প্রবেশ করলাে তারা মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা ফাঁদে বিস্ফোরিত হলাে মাইন ও বুবিট্র্যাপ নিশ্চিহ্ন হলাে পুরাে দল। বিজয় হলাে মুক্তিযােদ্ধাদের এ অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধিনায়ক ফজলুল হক ভূঁইয়া।
বালিউড়া অপারেশন
বালিউড়া সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক থানার একটি বাজার পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেট এবার ছাতক সিমেন্ট কারখানাস্থ মুক্তিযােদ্ধার অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি ধ্বংস করা। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে প্রায় ৪ কিলােমিটার উত্তরে এ বালিউড়া বাজারের অবস্থান পূর্বেও বেশ কয়েকটি অপারেশন সংঘটিত হয়েছে এ স্থানে তারই মধ্যে একটি অপারেশন পরিচালনা করেন মেজর মুত্তালিব। অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ সন্ধ্যায় ৩০০ মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল নিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হন। রাতে তারা সেখানেই অবস্থান করেন। ভাের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ভূখণ্ড থেকেই বিএসএফ সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ওপর আক্রমণ শুরু করেন। ৮টা পর্যন্ত গােলাবর্ষণ করার পরও পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করেনি কিন্তু আরও ১ ঘণ্টা পর পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ আক্রমণ শুরু করলে মুক্তিযােদ্ধারা বালিউড়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয় অন্তত দেড় কিলােমিটার পিছনে সরে আসেন মুক্তিযােদ্ধারা। এখানে এসেও পাকিস্তানি বাহিনীর মুখােমুখি হতে হয় তাদের পশ্চিম দিক থেকে ১টি বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসে। যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষে। মেজর মুত্তালিবের মতে এ যুদ্ধে ৭৮জন পাকিস্তানি নিহত হয়। অপরপক্ষে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। ভারতীয় মেজর জেনারেল গুলবক্স সিং গিল ঐদিন হেলিকপ্টারে করে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করেন বলেও তিনি জানান। ইদ্রিস কোম্পানির নেতৃত্বে বালিউড়া বাজারে আরও একটি বড়াে ধরনের সংঘর্ষ হয়েছিল। এ কোম্পানির মাত্র ৬জন সদস্যের সমন্বয়ে প্রথম একটি সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। তারা সবাই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই এ বাজারে এসেছিল। এ বাজারের পূর্ব প্রান্তে চলে যাওয়া একটি সড়কের পার্শ্ববর্তী কাছারি পুকুরে তারা সবাই অবস্থান করে। সশস্ত্র হয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওত পেতে থাকেন তারা। চোখে-মুখে তাদের শত্রু নিধনের স্পৃহা। সময় গড়িয়ে যেতে থাকে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর হয় প্রতীক্ষার অবসান। ছনখাইড় একটি গ্রাম। এ গ্রামেই সমবেত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল। সাথে রাজাকারদের আরও ১টি দল এবং শান্তি কমিটির লােকজন। গ্রামের কাছাকাছি আসতে না আসতেই গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতের অস্ত্র তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ১টি করে রাইফেল এবং ২০ রাউন্ড করে গুলি পাকিস্তানিরা তখন ঝাকে ঝাকে গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে সেই আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পর্যুদস্ত হয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধারা। বাংলাবাজারে ছিল মুক্তিবাহিনীর আরও একটি ক্যাম্প সংবাদ পাঠানাে হলাে সেখানে সাথে সাথেই ২ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে বসে তারা। ঘায়েল হয় পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায় তারা তাদের অবস্থান ছেড়ে। বালিউড়া আসে মুক্তিবাহিনীর দখলে এরপর আর কখনাে পাকিস্তানি বাহিনী বালিউড়ার দখল নিতে পারেনি অক্টোবর মাসে সিলেট অঞ্চলের অসংখ্য অপারেশনের মধ্যে এগুলােই ছিল প্রধান। বহু এলাকা তখন মুক্তিবাহিনীর দখলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের একেবারে। ভেতরেও তখন ঝাকে ঝাকে মুক্তিযােদ্ধা নভেম্বর মাসে এঁরা আরও বেপরােয়া হয়ে ওঠেন তারা জকিগঞ্জ ও আটগ্রামসহ বিরাট অঞ্চল মুক্ত করে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড