আহসানমারা অ্যামবুশ
পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজরের নেতৃত্বে বেশ কিছু সেনাসদস্য সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে রওনা দেয় সুনামগঞ্জ অভিমুখে এ সংবাদটি যথাসময় পৌছে যায় মুক্তিবাহিনীর বালাট সাব-সেক্টরে দলটিকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি অধিনায়ক গৌরাঙ্গচন্দ্র দেশী তিনি তার সাথে নিলেন আব্দুর রহিম, সান্তা মিয়া, সুধীর সূত্রধর, প্রীতেশ চৌধুরী ও আলী হায়দারসহ ৭জন মুক্তিযােদ্ধাকে ১টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড, কিছু বিস্ফোরক এবং আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি তাঁদের একমাত্র অস্ত্র সামান্য গুলিসহ ১টি এসএলআর এবং কয়েকটি মাত্র স্টেনগান তাদের হাতে দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর নির্দেশে সুনামগঞ্জ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এঁদের থাকাখাওয়ার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। চিয়াকান্দিতে রাত্রি যাপন করে সমস্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট নৌকায় করে রওনা দেন তারা অগ্রসর হন আহসানমারা অভিমুখে অন্ধকার রাত নিঃশব্দে এগিয়ে গেল নৌকাটি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কাছাকাছি অবস্থানের কাছে। ত্বরিত গতিতে ১টি মাইন স্থাপন করা হলাে রাস্তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দিকে ১টি জিপকে এগােতে দেখা গেল। অন্ধকার ভেদ করে দ্রুত বেগে এগােচ্ছে সেটি আরেকটু এগােতেই শােনা গেল আকাশ-মাটি কাঁপানাে ভয়ানক শব্দ। তারপরই সব শেষ বিধ্বস্ত জিপটি পড়ে গেল রাস্তার পাশে। সেই সাথে মারা গেছে তার চালক।
সৈয়দপুর-নলুয়ার যুদ্ধ
২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী সুনামগঞ্জ সদর থানার মুসলিমপুর, উড়াকান্দা ও রামপুর গ্রাম থেকে বালাট সাব-সেক্টরভুক্ত মুক্তিবাহিনীর সৈয়দপুর গ্রামের নদীর পাড়ের অবস্থানের ওপর ত্রিমুখী হামলা চালায়। এ আক্রমণে শত্রুরা ৩ ইঞ্চি মর্টার পর্যন্ত ব্যবহার করে। তখন বিকাল আনুমানিক ৫টা প্রিয় জন্মভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির অগ্নি-শপথে বলীয়ান মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চিমাদের এ সাড়াশি আক্রমণের সমুচিত জবাব দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করলেন না। ফলে ঘণ্টা খানেক পরই শত্রুরা মুসলিমপুর ও রামপুর গ্রাম ত্যাগ করে উড়াকান্দা গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে শত্রুদের দল উড়াকান্দা গ্রামে গিয়ে একত্র হয়। অন্য ২টি অবস্থান ত্যাগ করে যাওয়ার সময় নরখাদকেরা রামপুর গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়া রাত ১১টার দিকে পুনরায় কিছুদূর এগিয়ে দালাল আব্দুল জব্বারের বাড়ি থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্ববর্তী অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এ আক্রমণ প্রতিহত করতে অসম সাহসী মুক্তিযােদ্ধারা গুজাবিল গ্রামের অবস্থান থেকে একমাত্র এলএমজিটি সৈয়দপুর গ্রামের অবস্থানে নিয়ে আসেন এবং শত্রুপক্ষকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হন।
পরদিন সকাল ৭টার দিকে ২টি লঞ্চযােগে প্রায় অর্ধশতাধিক শত্রুসেনা। হালুয়া ঘাট হয়ে কৃষ্ণতলা গ্রামের লালঘর অবস্থানে পৌছে এবং সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিবাহিনীর নলুয়া গ্রামের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড হিংস্রতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে এবারেও পাকিস্তানিরা ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে হামলা চালায়। একে তাে স্বল্প প্রশিক্ষণ, তার ওপর অপর্যাপ্ত গােলাবারুদ। তবু বুকভরা দেশপ্রেম নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধের বিশাল প্রাচীর গড়ে তােলেন ১টি ২ ইঞ্চি মর্টারের কাছে শক্রদের এত অস্ত্র আর গােলাবারুদ হার মানতে বাধ্য হয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই শত্রুরা নিশ্ৰুপ হয়ে যায়। বিকাল ৪টা নাগাদ রামপুর ও উড়াকান্দা গ্রাম থেকে শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর সৈয়দপুর গ্রামের অবস্থানে নতুন আক্রমণ চালিয়ে বসে এবার মুক্তিযােদ্ধাদের খুব একটা গােলাবারুদ খরচ করতে হয় না। কয়েকটি গুলিবর্ষণেই শত্রুরা পিছিয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধাদের এ অবস্থানে তখন ‘বি’ কোম্পানির সহ-অধিনায়ক আব্দুল মজিদ দলনেতার দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাজাবাজ অ্যামবুশ
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের এক অন্ধকার রাত খুব সতর্কতার সাথে মুক্তিযােদ্ধারা সুনামগঞ্জের আহসানমারায় পাকিস্তানি ১টি জিপ বিধ্বস্ত করার পর তারা আত্মরক্ষার্থে খুব সতর্কতার সাথে তাদের অবস্থান ত্যাগ করে দ্রুতবেগে অন্যত্র সরে যাচ্ছে। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিশােধমূলক পাল্টা হামলার আশঙ্কায় দ্রুত তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্যই এ আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা। তা ছাড়া ক্ষুধা নিবৃত করাও প্রয়ােজন তাই তারা সােজা গিয়ে ওঠে রাজাবাজ গ্রামে ওখানে তখন রান্নার কাজ চলছে এবং সেটা। তাদের জন্যই একসময় তারা গ্রামে এসে পৌঁছে এবং বিশ্রাম নিতে থাকে তাদের পরের রাত কেটেছে অদ্রিায় দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে অনাহারে ফলে গা এলিয়ে দিতেই হাওরের মৃদুমন্দ বাতাসে দ্রুত ঘুম নেমে আসে সবার চোখে। দলপতির চোখও ঢুলু ঢুলু করছে ঠিক এ সময়ই বিশাল এক নৌকা বােঝাই করে পাকিস্তানি বাহিনী জামালগঞ্জ থেকে এ গ্রামে এসে উপস্থিত হয় এ গ্রাম থেকে জামালগঞ্জের (সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি থানা) দূরত্ব মাত্র ৪ মাইল সেখানে রয়েছে শত্রুর একটা শক্তিশালী ঘাটি মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কের নির্দেশে তারাও নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১টি এসএলআর ও ১টি স্টেনগান নিয়ে প্রতিরক্ষায় পাঠালেন ২জন মুক্তিযােদ্ধাকে ১জনের হাতে গ্রেনেড সিদ্ধান্ত হয় ৫০ গজের মধ্যে নৌকাটি আসার সাথে সাথেই গুলি করতে হবে, যাতে প্রতিটি গুলির সদ্ব্যবহার হয়। একসময় শত্রুর দল নাগালের মধ্যে আসতেই গর্জে ওঠে সানু মিয়ার হাতের এসএলআর তাকে সহযােগিতা করেন আলী হায়দার। একপর্যায়ে এসএলআরটি নষ্ট হয়ে গেলে আলী হায়দার এটাকে সিঙ্গেল শর্টের উপযুক্ত করে ব্যবহার করতে থাকেন আর এর থেকেই বর্ধিত হয় ২০-২৫ রাউন্ড গুলি তারপর মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে রাজাবাজ ত্যাগ করতে সমর্থ হন তাদের ব্যয় হয় শুধু কয়েক রাউন্ড গুলি। আর পাকিস্তানিরা হারায় তাদের দলভুক্ত বেশ কয়েকটি তাজা প্রাণ ও অস্ত্র ।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড