অপারেশন মুসলিমপুর
বালাট সাব-সেক্টর থেকে পরিকল্পনা করা হয় মুসলিমপুর অপারেশনের। বাছাই করা হয় এক সেকশন দুর্দান্ত মুক্তিযােদ্ধা। অধিনায়ক নিযুক্ত হন মুক্তিযােদ্ধা পাণ্ডবচন্দ্র দাস। একসময় পরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান গ্রহণ করলেন তারা। নির্ধারিত স্থানে। এখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান মাত্র ৪০০ গজ দূরে। ২০ আগস্ট দুপুর ২টা। প্রচণ্ড রােদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। গ্রামের লােকজন কাজকর্ম শেষ করে আশ্রয় নিয়েছে বাড়ির আঙিনাস্থ গাছতলায়। কেউ দুপুরের আহার করছে কেউ কেউ আদায় করছে জোহরের নামাজ। আর মুক্তিযােদ্ধারা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নকশা আঁকছেন। সুবিধাজনক সময়ে তারা আক্রমণ করবেন। সেই বিশেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষমাণ মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০জন সৈন্য গানবােটে করে তাদের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। বােটগুলাে ভর্তি আধুনিক অস্ত্র ও গােলাবারুদ বােট থেকে আক্রমণ রচনা করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ভারী অস্ত্রের গােলায় একে একে ধসে পড়ে বাংকারগুলাে উপড়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি। কিন্তু অল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হালকা অস্ত্রধারী মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ভয়ে ভীত নন। দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান মুক্তিযােদ্ধারা জীবন-মরণ পণ করে লড়তে লাগলেন। তারা ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখেন শত্রুর অগ্রাভিযান এ সময় মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ ফুরিয়ে এলে তারা কৌশল পরিবর্তন করে চলে যায় জিনারপুর গ্রামে পরদিন কোম্পানি অধিনায়কের নির্দেশে চলে যায় মেরুয়াখলা গ্রামে।
কৃষ্ণতলা অপারেশন
বেশ কিছুদিন যাবত পাকিস্তানিরা এখান থেকে আশপাশের গ্রামের লােকজনের ওপর নির্যাতন করে আসছে। তাই এদের বিরুদ্ধে একটি অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। ডালারপার ও নারায়ণতলা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ২টি দলের অবস্থান ছিল। এ ২টি দলের সমন্বয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করে চূড়ান্ত আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মহিউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ আগস্ট তারা আক্রমণ করেন কৃষ্ণতলা গ্রামের পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঐ দিন বিকাল ৫টায় শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধের সাঁড়াশি আক্রমণ প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করলে পাকিস্তানিরাও পাল্টা জবাব দিতে অগ্রসর হয় তারা যে-কোনাে হামলার জন্য সদা প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধ চলে ২ ঘন্টা ধরে নারায়ণতলার অবস্থান থেকে রহিম বক্স ২ ইঞ্চি মর্টারের গােলা ছুড়তে থাকেন শত্রুর নিক্ষিপ্ত গােলাগুলির ভেতরেই তিনি তখন অনেকখানি সামনে এগিয়ে গেছেন। তার লক্ষ্যভেদী মর্টারের গােলা ধ্বংস করছে একের পর এক শত্রু ফলে নিহত হয় প্রায় ১০জন পাকিস্তানি এ সময় হঠাৎ পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত ১টি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রহিম বক্সের বুকে মুক্তিযােদ্ধা রহিম সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান। স্বদেশের মাটি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েন সে চিরতরে। সহযােদ্ধা ইলিয়াস আলী ও ওয়াজিদ আলী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করেন। ঐদিন সকালে পাকিস্তানিরা কৃষ্ণতলা, নলুয়া ও গুজাবিল আক্রমণ করেছিল। মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মজিদের নেতৃত্বে সহযােদ্ধারা সেই আক্রমণ প্রতিহত করলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।
নলুয়া-গুজাবিল যুদ্ধ
সুনামগঞ্জ, সদর থানার নলুয়া ও গুজাবিল গ্রাম বালাট সাব-সেক্টরভুক্ত মুক্তিবাহিনীর ২টি ঘাটি। এগুলােয় ‘বি’ কোম্পানির অবস্থান। দলনেতা কোম্পানির সহ-অধিনায়ক আব্দুল মজিদ। সকাল ৭টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ১ মাইল দূরবর্তী কৃষ্ণতলা গ্রাম থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অবস্থানের ওপর বেপরােয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেই সাথে নলুয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা অসীম সাহসে গুজাবিল গ্রাম থেকে গােলা নিক্ষেপ করতে শুরু করলে শক্ররা। পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর প্রায় ১ ঘন্টা পর পশ্চিমা শত্রুর দল পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের অন্য একটি অবস্থানের ওপর আকস্মিক হামলা চালায়, তবে তা গােলা নিক্ষেপের নির্দিষ্ট সীমানার (রেঞ্জ) বাইরে থেকে। তারা পুনরায় বিচ্ছুদের কবলে পড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা মুক্তিবাহিনীকে অপচয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে দুর্বল করে দেওয়ার একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল, কিন্তু বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা সুকৌশলে সেই হীন চক্রান্তের জাল এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। শক্ররা পূর্ববর্তী ৩টি ব্যর্থ অভিযানের গ্লানি নিয়েও সকাল ১১টার দিকে আবার নলুয়া গ্রামের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।
এবার শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের নাগালের মধ্যে এসে যায়। আর তাই অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা বজ্রের দৃঢ়তা নিয়ে রুখে দাঁড়ান। প্রতিটি অস্ত্র আগুন ঝরাতে শুরু করে। ফলে শত্রুর দল পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। তবে এবার অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অন্তত ৩জনের গায়ে গুলি লাগে শত্রুর এ দুঃসাহসের সমুচিত জবাব দিতে পরদিন ভাের ৪টার দিকে প্রবল বর্ষণ মাথায় নিয়ে নির্ভীক মুক্তিযােদ্ধারা কৃষ্ণতলা গ্রামের লালঘরের পশ্চিম পাশে শত্রুদের একটি নতুন বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলেন। এতে বাংকারটি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। এর অন্তত ৪ ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনারা গুজাবিল গ্রামের ওপর নতুন করে আক্রমণ রচনা করে বসে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা কৌশলে তা এড়িয়ে যান। ফলে এবারও কোনােরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড