বেতুরা অ্যামবুশ
বেতুরা গ্রামটি সুরমা নদীর পাদদেশে অবস্থিত। গ্রামটি দোয়ারা বাজার থানার অন্তর্গত। গ্রামটি ছাতক থানা সদর থেকেও ৭ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এখান দিয়েই চলে গেছে পাইপলাইন, যা দিয়ে টেংরাটিলা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয় ছাতক পেপার মিলে। পাইপলাইনটি ধ্বংস করা গেলে পেপার মিলে উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব হবে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাবে পাকিস্তানি সরকার। ভূগর্ভস্থ গ্যাস সরবরাহ লাইনটি কীভাবে ধ্বংস করা যায় এ পরিকল্পনাটি বেশ কয়েকবার করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের তাঁবেদার রাজাকার কর্তৃক সার্বক্ষণিক নজর রাখা হয় এ গ্যাস স্থাপনাগুলাে। টহল দিতে থাকে তারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। শেলা সাব-সেক্টরের ১টি দল আসে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়। এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ইদ্রিস আলী। তিনি ছিলেন রয়েল ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্য এবং কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। তার গ্রামের নাম নৈনগাঁও। এখানেই আসে মুক্তিবাহিনীর দলটি। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, তিনিই। ঠিক হয়, এখান থেকেই অপারেশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম বেতুরায় তখন পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান করছিল। কুখ্যাত দালাল মফচ্ছিল আলী ফকির নিজ বাড়িতেই তাদের আহারের ব্যবস্থা করেছে। মুক্তিবাহিনীর ইদ্রিছ আলী, আব্দুস সামাদ, গিয়াস উদ্দিন ও আব্দুল আজিজ এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা আগস্ট মাসে ফকিরের বাড়ি আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে বেধে যায় যুদ্ধ। কিন্তু সে যুদ্ধ ছিল অল্প সময়ের জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের হামলার মুখে টিকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করেন। সেই সাথে কুখ্যাত দালাল মফচ্ছিল আলী ফকিরের বাড়িটিও তারা ধ্বংস করতে সমর্থ হন।
বেরিগাঁও যুদ্ধ
সুনামগঞ্জের উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে বালাট। এ ক্যাম্পের গণবাহিনী অধিনায়ক ছিলেন ইনামুল হক চৌধুরী, সহকারী অধিনায়ক ছিলেন সদর উদ্দিন চৌধুরী। এ বালাট থেকেই সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত বিল-হাওরে অসংখ্য অপারেশনের মাধ্যমেই এ সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি বিরাট অংশ মুক্তিবাহিনী নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহর দখল করা সম্ভব হচ্ছিল না। শহরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ, দীর্ঘ ১৫ কিলােমিটার হাওর প্রান্তর অতিক্রম করে মহকুমা সদরে প্রবেশ করতে গেলে একটি শক্ত ঘাঁটির মুখােমুখি হতে হবে। শহর থেকে ২-৩ কিলােমিটার উত্তরে বেরিগাঁও গ্রাম। সমস্ত উত্তরাঞ্চলের সাথে যােগাযােগের একমাত্র রাস্তাও এ গ্রামের ওপর দিয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীকে শহরে প্রবেশ করতে হলে এ পথেই করতে হবে। তাই পাকিস্তানিরা এখানে একটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে। পাকিস্তানি সৈন্য ছাড়া। ১০০জন মিলিশিয়া এবং ১৫০জন রাজাকারের সমাবেশ হয় এখানে। মটারসহ ভারী অস্ত্র, প্রচুর গােলাবারুদ ও রসদ জমা করেছে তারা। এভাবে ঐ অঞ্চলের একটি শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে বেরিগাঁওকে তৈরি করা হয়। তাই বারবার মুক্তিযােদ্ধারা বেরিগাঁও আক্রমণ করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনীকে এখান থেকে হটানাে সম্ভব হয়নি। তাদের কিছু কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও ঘাঁটি থেকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পুরােপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। অথচ এখান থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে না পারলে মুক্তিযােদ্ধাদের সুনামগঞ্জে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। তাই আবারও পরিকল্পনা তৈরি করা হলাে বেরিগাঁও আক্রমণের জন্য। এবার নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন বালাট সাব-সেক্টরের সহকারী। অধিনায়ক সদর উদ্দিন চৌধুরী। প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১টি দল গঠন করা হয়। বিভিন্ন স্থানে ছােটখাটো অপারেশন পরিচালনা ও পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে আগস্ট মাসে গ্রুপটি বেরিগাঁওয়ের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করে। মাত্র ২ কিলােমিটারের মধ্যেই ছিল আমপাড়া ও বাগমারা প্রভৃতি গ্রাম। এসব গ্রামে এসে প্রবেশ করেন মুক্তিযােদ্ধারা।
তাদের সম্বল মাত্র স্টেনগান, লাইট মেশিনগান, .৩০৩ রাইফেল, বেয়নেট, গ্রেনেড ও ৩ ইঞ্চি মর্টার। গ্রামের লােকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করলাে। এভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে তারা এগিয়ে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান এলাকা থেকে এরাই বহুবিধ তথ্য সংগ্রহ করে দিয়েছিল। আক্রমণ পরিকল্পনার প্রাথমিক প্রস্তুতিতেও তারা সাহায্য করে। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। বেরিগাঁওয়ের তিন দিক থেকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা একসাথে আক্রমণ শুরু করলে পাকিস্তানিরাও প্রাণপণে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। ফলে বেধে যায় প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধে অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ হারায়, আহতও হয়। বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসী তাদের লরি ভর্তি করে হতাহতদের সরিয়ে নিতে দেখেছে। অবশেষে বেরিগাঁও ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। বেরিগাও মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। শত্রুপক্ষের প্রচুর অস্ত্র ও রসদ মুক্তিবাহিনীর ভাণ্ডারে জমা হয়। অবশেষে সুনামগঞ্জ শহরের প্রবেশপথ নিষ্কণ্টক হয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর জন্য এ যুদ্ধে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। শহিদ হন শাসু ও নিতাই। তাদের মৃতদেহ ওখানেই দাফন করা হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড