You dont have javascript enabled! Please enable it!
দিরাইগামী লঞ্চ আক্রমণ
মুক্তিযােদ্ধারা আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে ফিরছিলেন। টেকেরঘাট যাওয়ার জন্য কালনী নদী হয়ে নিজস্ব ক্যাম্প রাজানগর থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। নদীপথে চলার সময় মাঝনদীতে হঠাৎ করেই একটি ধাবমান লঞ্চের শব্দ শােনা যায়। একসময় দেখতে দেখতে লঞ্চটি আরও সামনে চলে আসে। লঞ্চটি বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থেকে দিরাই হয়ে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার অভিমুখে যাচ্ছিল। কিন্তু এ সময় এ পথে কোনাে লঞ্চ থাকার কথা নয়, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযােদ্ধাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে একসময় লঞ্চ থামানাের সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু লঞ্চটি থামলাে না। এবার সামান্য হাঁকডাকের সঙ্গে থামতে বললে লঞ্চটি পালানাের চেষ্টা করে। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চটির ওপর গুলি করতে শুরু করলেন। শুরু হয়ে যায় সংঘর্ষ। পাল্টা গুলি আসতে থাকে লঞ্চ থেকে যা সন্দেহ করা হয়েছিল, তা-ই সত্য হলাে। এবার পুরাে শক্তি নিয়ে আক্রমণ করতেই লঞ্চটি নােঙর করে। মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত উঠে পড়েন লঞ্চে। লঞ্চে গিয়ে প্রথমেই তারা হস্তগত করে, ২টি .৩০৩ রাইফেল ও ১টি এস এল আর লঞ্চে চালক এবং ১জন আরােহী ব্যতীত অন্য কেউ ছিল না। এরা ছিল সবাই রাজাকার। এরা ডাকাতি করে ৩-৪ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল ময়মনসিংহ অভিমুখে তারা ঐ অঞ্চলেরই লােক। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ায় তাদের লুষ্ঠিত সব টাকা ও অস্ত্র হারাতে হয়। শুভাংশু চৌধুরী ঐ টাকা এবং অস্ত্র টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে জমা দেন।
টুকের বাজার রেইড
টুকের বাজার ভারতীয় সীমান্তের উত্তর দিকের একটি ছােটো বাজার। মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ৫ নম্বর সেক্টরের প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধার ১টি বিরাট দল এখানে অবস্থান করছিল। এ বাজার থেকেই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ওপর খুব কাছ থেকে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে বিভিন্ন সময়ে তারা পাকিস্তানিদের ওপর আচমকা আক্রমণ করে শত্রুর ওপর প্রবল কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানিদের পৈশাচিক অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে মুক্তিযােদ্ধাদের এ বিশেষ দলটির আগমন ঘটেছিল। এখানে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ফলে এদেশীয় দালালেরা বেশি সুবিধা করতে পারছিল।
কারণ মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতিতে তারা শত্রু বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, আবার স্বার্থপর পাকিস্তানিরাও তাদের এ নিশ্ৰুপ আচরণ মেনে নিতে পারছিল না। তাই উপায়ান্তর না দেখে তারা আত্মগােপন করে থাকতে বাধ্য হয়। দেশের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান এবং একটি বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ করার সংবাদ তাদের অজানা ছিল না। কিন্তু দালালদের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তাদের কাজকর্মকে আরও উৎসাহিত করার জন্য পাকিস্তানি দোসররা একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের এ ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এদিকে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লােকজনও তাদের হীন স্বার্থে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত নৌকাও তারা সগ্রহ করে দেয়। তেলিখালের আতাউর রহমান ও তার সাথী দালালদের ছিল। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা এদের কাঁধে ভর করেই তারা টুকের বাজার রওনা হয়। শতাধিক নৌকায় ততােধিক রাজাকার ও দালাল ভর্তি করে পাকিস্তানি বাহিনীর এক বিরাট বহর সালুটিকর থেকে যাত্রা করে এবং ৬-৭ কিলােমিটার অতিক্রম করে বাজারটি ঘেরাও করার চেষ্টা করে। এর আগেই নদী দিয়ে। বাজারে ওঠার চেষ্টা করে তারা। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও তখন প্রস্তুত। পাকিস্তানিরা নদীর পাড়ে উঠে আসার আগেই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করে।
ফলে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি নৌকাগুলাে তখনাে তীর স্পর্শ করতে পারেনি, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তাদের কোনাে কোনাে নৌকা পালানাের চেষ্টা করে। অমনি আবারও গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতের অস্ত্র । নৌকাগুলাের তলা ফেটে পানি প্রবেশ করতে থাকে ফলে তলিয়ে যায় নৌকাগুলাে। কেউ কেউ কাঠের টুকরাে, নৌকার ভগ্নাংশ ইত্যাদি আঁকড়ে ধরে ভাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের মাথার খুলি উড়ে যেতে থাকে মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্যভেদী গুলিতে। কয়েকজন রাজাকার সাঁতার দিয়ে কূলে আসতে চাইলে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তাদেরও প্রাণ হারাতে হয়। নদীর উভয় তীর থেকে ঘেরাও হয়ে যায় তারা। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরােধ করার মতাে কোনাে শক্তি ও সুযােগ তাদের অবশিষ্ট ছিল না। তাই তারা প্রাণ হাতে করে পালাতে চেষ্টা করে। যে যেদিকে পারে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের অনেকেই এ সময় গুরুতর আহত হয়। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রায় ১০০টি নৌকাই মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। ভেতরে কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাওয়া যায়। এ যুদ্ধের ২ দিন পর ভাটির দিকে অসংখ্য রাজাকারদের লাশ ভেসে যেতে দেখা যায়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!