জামালগঞ্জ রেইড
সুনামগঞ্জ সদরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত জামালগঞ্জ থানা। জামালগঞ্জ থানায় নদীপথই যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম। এর সাচনা বাজার বিখ্যাত নদীবন্দর। পাকিস্তানি বাহিনী জামালগঞ্জে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। জামালগঞ্জকে মুক্ত না। করতে পারলে এ অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল ছিল অসম্ভব তাই জামালগঞ্জকে মুক্ত করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে ৩। দলে বিভক্ত হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ রচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৯ জুলাই, বিকালে প্রতি দলে ৪০জন করে মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে মােট ১২০জনের ১টি দল গঠন করা হয়। কোম্পানি অধিনায়ক প্রতি নৌকায় ২০জন করে মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে অগ্রসর হবেন বলে স্থির করা হয়। প্রথম কোম্পানি অধিনায়ক ইপিআর-এর সৈনিক আব্দুল হাই এক নৌকায় ওঠেন। অপর নৌকায় সিরাজ মিয়া ওঠেন। তাদের দায়িত্ব ছিল উত্তর দিক থেকে সাচনা বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে অতর্কিত আক্রমণ করা। এ দলে বেশির ভাগ ছিল ইপিআর-এর সৈনিক দ্বিতীয় দলে ছিল জগৎজ্যোতি দাস তিনি কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে ২০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে এক নৌকায় ওঠেন এবং সহ-অধিনায়ক হিসেবে আলী আমজাদ অপর ২০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে দ্বিতীয় নৌকায় যাত্রা শুরু করেন। এঁদের মধ্যে আবুল হােসেন, জিয়াউদ্দিন, জুবায়ের চৌধুরী, আতাউর রহমান, বদিউজ্জামান, ইলিয়াস, রমিজ উদ্দিন, আশক আলী প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধার নাম উল্লেখযােগ্য তাদের দায়িত্ব ছিল জামালগঞ্জ সিও অফিস ও হাই স্কুলের পিছনের দিক থেকে জামালগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করা। তৃতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন মুজাহিদ মিয়া এবং সহ-অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন ইব্রাহিম খলিল। তারাও ২টি নৌকায় করে যাত্রা শুরু করেন।
তাদের মধ্যে ছিলেন মুজিব, মণীন্দ্র চন্দ্র, সাইফুদ্দিন, আলাল, আব্দুল বাছিত, শাহানুর, আ. রউফ প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা। তাদের দায়িত্ব ছিল তেলিয়া শাহপুরের দিক থেকে জামালগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে পর্যদস্ত করা এবং সুরমা নদী দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর যাতায়াত ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা। এভাবে জামালগঞ্জ আক্রমণের সব প্রস্তুতি শেষ হলে আলী ইউনুছ অ্যাডভােকেট অভিযাত্রী দলগুলােকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, রসদপত্র ও আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে টেকেরঘাট ট্রলি লাইনের উপস্থিত ওয়েটব্রিজের উত্তর-পূর্ব দিকের নৌকাঘাট থেকে বিদায় জানান রাতের গভীর অন্ধকারের যবনিকা ঠেলে মুক্তিবাহিনীর ৩টি কোম্পানি নির্বিঘ্নে নির্ধারিত স্থানে পৌছে যায়। রাতের অন্ধকারের প্রথম সুযােগেই ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করা হয় এবং গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিটি অস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীও বাজারস্থ নিশি বাবুর ঘরের কাছের বাংকার, হাই স্কুল ও থানার নিকটস্থ বাংকার থেকে অবিরাম গােলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে। সারারাত ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। ভােররাতে আব্দুল হাই কোম্পানির সহ-অধিনায়ক সিরাজ পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারে গ্রেনেড চার্জের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রেনেড চার্জকালে সাচনা বাজার পুলের কাছে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন।
কিন্তু ঐ গ্রেনেড চার্জের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সাচনা বাজার ঘাটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, জগৎজ্যোতির প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী জামালগঞ্জের বাংকার ছেড়ে পলায়ন করতে থাকে দক্ষিণ দিক থেকে মুজাহিদ তার বাহিনী নিয়ে সুরমা নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে দুর্লভপুর অভিমুখে পালিয়ে যায়। এ অপারেশনে সাচনা ও জামালগঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। এলাকাবাসী দীর্ঘদিন পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আব্দুল হাই কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারাও এসে পড়েন। তারা শহিদ মুক্তিযােদ্ধা সিরাজের লাশ নিয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে যান এবং সেখানে যথাযােগ্য মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
বিরামপুর অপারেশন
সুনামগঞ্জ সদর থানার ডালারপার একটি গ্রামের নাম। সেখান থেকে ১ প্লাটুন। মুক্তিযােদ্ধা ২৭ জুলাই সকাল ৬টার দিকে রওনা হয় বিরামপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে। সহকারী প্লাটুন অধিনায়ক মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় ২ কিলােমিটার দূরে বিরামপুর গ্রামে পৌছাতে দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। বালাট সাব-সেক্টরের এ মুক্তিযােদ্ধা দলটি ২টি নৌকায় করে বিরামপুর। গ্রামে পৌছে অবস্থান গ্রহণ করতে না করতেই অন্তত ৫০জন পাকিস্তানি হালুয়াঘাট থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিটি হাতিয়ারও প্রচণ্ড শব্দে গর্জে ওঠে। কিন্তু ১৫ মিনিট পরই উভয় দিক থেকে গােলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এ ফাকে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে আনুমানিক ৩ কিলােমিটার পিছনে সফেরগাঁও গ্রামে সরে যান। অত্যন্ত হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই এ প্রতিরােধ লড়াইয়ে মুক্তিযােদ্ধারা কমপক্ষে ৭জন পাকিস্তানিকে হত্যা করেন। এ যুদ্ধে ৩জন মুক্তিযােদ্ধাও শহিদ হন। তবে শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
দিরাই সার্কেল অফিস রেইড
সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি থানা দিরাই, যা সুনামগঞ্জের দক্ষিণে অবস্থিত টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে ৩টি দল পৃথক পৃথকভাবে দিরাই অভিমুখে রওনা হয়। দল ৩টির জনবল ছিল যথাক্রমে ৩০, ৬০ ও ৭৫জন। দলগুলাের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে সুধীর কুমার দাশ, দুলন কুমার পান্ডে, সুবাশ কুমার দাশ। সাকিদপুর ও নওয়াগাঁও-এ এসে তারা পেীছেন ২ দিন পর। অতঃপর সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্পের অবস্থান ছিল তৎকালীন দিরাই সার্কেল অফিসারের কার্যালয়ের ভেতর। পাকিস্তানি ও রাজাকার মিলিয়ে মােট জনবল ছিল প্রায় ৬৫জনের মতাে শুভাংশু চৌধুরী এখান থেকে কৌশলে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি, রসদ, জনবল ইত্যাদির হিসাব নিয়েই একটি খসড়া পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে পরদিন অগ্রসর হয় চরনার চর ও রাজানগর হয়ে। দিরাই সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর অপর তীরে অবস্থিত ডরারগাঁওয়ে তারা সৃষ্টি করে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ সমস্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত, এবার আক্রমণের পালা রাতের শেষ প্রহর তখনাে সূর্য ভালােভাবে ওঠেনি। ঠিক সে-সময় মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। একই সাথে গর্জে ওঠে সব কয়টি আগ্নেয়াস্ত্র। পাকিস্তানিরাও পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এভাবে ৭-৮ ঘণ্টা অবিরাম যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানিরা ক্রমেই পিছু হটতে থাকে। এ যুদ্ধে ৪জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড