ছাতক অপারেশন
সুনামগঞ্জ জেলার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছাতক উপজেলা বিভাগীয় সদর সিলেট শহর থেকে মাত্র ৪৫ কিলােমিটার দূরে সুরমা নদীর কূল ঘেঁষে অবস্থিত। সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত এ নদীবন্দরটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। ভারত সীমান্ত থেকে ১০-১২ কিলােমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। যুদ্ধের পটভূমি। গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ছাতকের গুরুত্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। কাছে ছিল অনেক বেশি। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ছাতক শহর মুক্তিবাহিনীর দখলে। ছিল। ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানিরা এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ছাতকের পতন ঘটলে এলাকার মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পশ্চাদপসরণ করে ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী বাঁশতলা এলাকায় গিয়ে একত্র হন। সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। ২২ মে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার জোয়াই নামক এক নিভৃত পার্বত্য এলাকায় এ অঞ্চলের সর্বপ্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে বিএসএফ অফিসারদের নির্দেশে অপারেশন পরিচালিত হয়। অবশেষে গারাে পাহাড় এলাকা থেকে ‘জেড’ ফোর্সের ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১২ অক্টোবর। বাঁশতলায় এসে ৫ নম্বর সেক্টর এলাকায় অপারেশন পরিচালনার জন্য যােগ দেয়। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে যােগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ সেক্টরটি। প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে যুদ্ধের সংগঠন ১. মুক্তিবাহিনী ক, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। খ. ছাত্র কোম্পানি। গ. গণবাহিনী কোম্পানি। পাকিস্তানি বাহিনী ক. ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। খ. ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ইপিসিএফ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থান ছিল ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায়। এ ছাড়া পাকিস্তানিদের ১টি কোম্পানি বিভিন্ন টিলা ও বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছিল। ছাতকের সাথে গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ পয়েন্ট যেমন: মাধবপুর, গােবিন্দগঞ্জ ও দোয়ারা বাজারের টেংরাটিলায় পাকিস্তানিদের মােটামুটি সুদৃঢ় অবস্থান ছিল।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা
১২ অক্টোবর বিকালের দিকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ কর্নেল ওসমানি বাশতলা ক্যাম্পে আসেন এবং সেক্টর অধিনায়ক কর্নেল মীর শওকত আলীর সেক্টর কার্যালয়ে এসে ১৪ অক্টোবর ছাতক অপারেশনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। অতঃপর মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গুলবক্স সিং গিল এবং সেক্টর অধিনায়ক অপারেশন পরিচালনার বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন এবং অপারেশনাল অর্ডার প্রদান করেন।
ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের অপারেশনাল অর্ডার
১২ অক্টোবর আনুমানিক বিকাল ৫টায় ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল ছাতক অপারেশনের যে অপারেশনাল অর্ডারটি দিয়েছিলেন তা নিম্নরূপ: ১. ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মূল আক্রমণে যাবে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের ‘এ’ কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আকবরের ‘বি’ কোম্পানি এবং সাথে রৌমারী থেকে আসা অধিনায়ক আখতারের নেতৃত্বাধীন ছাত্র কোম্পানি। দোয়ারা বাজারের টেংরাটিলা অবস্থানে কাট অব পার্টি হিসেবে অপারেশনটিতে যাবে মেজর মােহসীনের ‘সি’ কোম্পানি। মাধবপুর ও গােবিন্দগঞ্জ অবস্থানে কাট অব পার্টি হিসেবে অপারেশনটিতে যাবে লেফটেন্যান্ট নবীর ‘ডি’ কোম্পানি এবং ‘ই’ কোম্পানিদ্বয়। ৪. সুবেদার মেজর হারিসের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নে সদর দপ্তর কোম্পানি রিয়ারের দায়িত্বে থাকবেন। সেক্টর সদর দপ্তর বাঁশতলায় অবস্থান নিয়ে ইনি সার্বক্ষণিকভাবেই আক্রমণকারী দলগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলবেন। ‘ডি’ ও ‘ই’ কোম্পানি ভােলাগঞ্জ অবস্থান থেকে মাধবপুর গােবিন্দগঞ্জের কাট অব পার্টি হিসেবে পরিচালিত অপারেশনটির জন্য গমন করবে। ভােলাগঞ্জ থেকেই প্রয়ােজনীয় নৌকা ও গাইড সংগ্রহ করে নেবেন। প্রয়ােজনীয়সংখ্যক গণবাহিনীও ঐ ক্যাম্প থেকেই সংগ্রহ করে নেবে। ৬. ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ কোম্পানি প্রয়ােজনীয়সংখ্যক গণবাহিনী, গাইড ও নৌকা বাঁশতলা এলাকায় অবস্থানরত গণবাহিনী কোম্পানিগুলাে থেকেই সংগহ করে নেবেন। ‘ডি’ ও ‘ই’ কোম্পানিকে রাতের মধ্যেই ভােলাগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। ৮, ১৪ অক্টোবর ভােররাতেই প্রতিটি কোম্পানি নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে।
পৌছে যাবেন এবং অপারেশন পরিচালনায় অংশ নেবেন। ৯, যেহেতু প্রয়ােজনীয় রেকি করা সম্ভব হয়নি, তাই প্রতিটি কোম্পানি নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌছার জন্য স্থানীয় গাইডদের সাহায্য নেবেন। ১০. শক্রর অবস্থান, জনবল ও অস্ত্রবল সম্বন্ধে যেহেতু কোনাে সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই, তাই নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশল প্রয়ােগ করতে হবে। ১১. অস্ত্র ও গােলাবারুদ পুনরায় সরবরাহের ব্যাপারে যেহেতু কোনাে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, সুতরাং সতর্কতার সঙ্গে গােলাবারুদ খরচ করতে হবে। ১২. এলাকাটি নতুন বলে অগ্রাভিযান, অগ্রাভিযানের অক্ষ এবং প্রত্যাহারের অক্ষ- এগুলাের ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কোনাে অভিজ্ঞতা নেই। এসব বিষয়ে স্থানীয় গাইডদের সাহায্য ও সহযােগিতার ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। ১৩. নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যাপারে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হবে। রণক্ষেত্রের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শত্রুকে নির্মূল করতে গিয়ে নিজেরাই নিমূল হয়ে আসার মধ্যে কোনাে সার্থকতা নেই। এলাকাটি আমাদের কারােরই পূর্বপরিচিত নয় এবং এখানকার লােকজনের আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের জানা নেই। আর সে কারণেই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ফেলতে হবে। ১৪, হাওরের মধ্য দিয়ে দিক নির্ধারণে অসুবিধা হবে। সে কারণে ছাতকের। প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক আলাের প্রতি লক্ষ্য রেখেই পথ চলতে হবে। সীমান্তের উচু পর্বত এবং আকাশের তারাগুলাের সাহায্য নিতে হবে। ১৫. আমরা এক অসম যুদ্ধ এবং আত্মঘাতী অপারেশনে যাচ্ছি। শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধনই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতিকে যত দূর সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাবেন।
১৬. নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলােকে এবং স্থানীয় গাইডদের সহযােগিতায় নিজেরাই যার যার অগ্রাভিযান, অগ্রাভিযানের অক্ষ এবং প্রত্যাহারের অক্ষ ঠিক করে নেবেন। ১৭. সম্মুখ সমাবেশ এলাকা এবং এফইউপি নির্ধারণের ব্যাপারেও নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় গণবাহিনীর সাহায্য নেবেন। ১৮, আক্রমণের প্রকার কী ধরনের হবে, এ ব্যাপারেও লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি গিয়েই নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলােকে ঠিক করে নিবেন। ১৯. অ্যাসল্ট ফরমেশন কী ধরনের হবে, তাও উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিক করে নেবেন। ২০. কোম্পানিগুলাে নিজেরাই নিজেদের পাসওয়ার্ড ঠিক করে নেবেন। ‘এ’, ‘বি’ ও স্টুডেন্ট কোম্পানির পাসওয়ার্ড যৌথভাবে নির্ধারিত হবে। ‘সি’, ‘ডি’ ও ‘ই’ কোম্পানির পাসওয়ার্ড হবে ভিন্নতর। ২১. শত্রু বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে আপনাদের ওপর আঘাত হানতে পারে। এ ব্যাপারে আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিজস্ব অবস্থানের গোপনীয়তা যতদূর সম্ভব রক্ষা করবেন। যখনই কোনাে নতুন অবস্থানে যাবেন, সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। ১ ঘণ্টার জন্যও কোনাে অবস্থানে থাকতে হলে সেখানে বাংকার খননের কাজটি করতে যেন ভুল না। হয়। এ এলাকায় আমাদের আগমন হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে যে-সব অবস্থানে আপনাদের পাঠানাে হচ্ছে, সেগুলােও সম্পূর্ণভাবেই অপরিচিত। যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নিজস্ব রেকির মাধ্যমে সবকিছু জেনে নেয়ার কোনাে সুযােগ আমরা পাইনি। এ রকম। পরিস্থিতিতে সর্বাবস্থায় সতর্ক থাকা ছাড়া আপনাদের কোনাে বিকল্প ২২. ৭৭ নেই। ২৩. আল্লাহ আপনাদের সহায় হােন। আপনারা সবাই সুস্থ দেহে ফিরে আসুন, এ কামনাই করছি। জয় বাংলা, খােদা হাফেজ।
যুদ্ধের বিবরণ
১৩ অক্টোবর প্রতিটি কোম্পানি নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে যাত্রা করে। ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মহসিন যাত্রার প্রাক্কালে খবর নিয়ে জানিয়েছিল যে, দোয়ারা বাজারে কোনাে পাকিস্তানি বাহিনী নেই। কিন্তু খবরটা ছিল ভুল। ফলে দোয়ারা বাজারের নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা অতর্কিত আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন মহসিনের ৪টি নৌকাই ডুবিয়ে দেয়। এতে ‘সি’ কোম্পানির কিছু সৈনিক শহিদ হয়, অন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সমস্ত সরঞ্জাম পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং ক্যাপ্টেন মহসিন নিজে সুরমা নদী।সাঁতরিয়ে দোয়ারা বাজারের দক্ষিণে দোহালিয়া গ্রামে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি একজন প্রবাসীর সাহায্যে ৪ দিন পর কোনােমতে শেলা সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে ফিরে যেতে সক্ষম হন। অপর দিকে ‘ডি’ কোম্পানি নিয়ে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী গােবিন্দগঞ্জে অগ্রসর হওয়ার পথে জাউড়া বাজারের ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হন। ফলে তাঁর পক্ষে গােবিন্দগঞ্জে আর প্রতিরােধ নেয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, সকল প্রকার অসুবিধা অতিক্রম করে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের ‘এ’ কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আকবরের ‘বি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন হেলালের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানি যুদ্ধ করতে করতে ছাতকের সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত দখল করেন। ক্যাপ্টেন আনােয়ারের ‘এ’ কোম্পানি সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে অবস্থান নিয়ে ছাতক বাজার ও সুরমার অপর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি গােলাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল।
এ সময় সিমেন্ট ফ্যাক্টরির সামান্য পিছনে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন আকবরের ‘বি’ কোম্পানি লক্ষ্য করে যে, তাদের পিছন দিক থেকে গুলি আসছে। এতে ক্যাপ্টেন আকবর বুঝতে পারেন যে, শত্রুপক্ষ নিশ্চয় দোয়ারা বাজার হয়ে এগিয়ে এসে পিছন দিক থেকে তাদের ঘিরে। ফেলছে। তিনি তার কোম্পানিকে নিয়ে এ আক্রমণের পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেন এবং সারাদিন যুদ্ধ করে কোনােমতে নিজেদের টিকিয়ে রাখেন। তাঁদের কাছে ২ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি ও রাইফেল ছাড়া অন্য কোনাে ভারী হাতিয়ার ছিল না। তাদের অবস্থানের মাটি এত নরম ছিল যে, মর্টার ব্যবহার করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। ঐ দিন সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাপ্টেন আকবর হােসেন তার কোম্পানির সৈন্যদের একটা টিলায় একত্র করে। অপর দিকে সম্মুখযুদ্ধরত ‘এ’ কোম্পানি তখনাে জানতাে না যে, তাদের পিছনে শত্রু বাহিনী বেষ্টনী গড়ে তুলেছে এ সময় ক্যাপ্টেন আকবর ভাবলেন যে এভাবে সীমিত শক্তি নিয়ে সামনে-পিছনে শক্রবেষ্টিত অবস্থায় যুদ্ধ করে পেরে ওঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। বরং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই নিশ্চিহ্ন হতে হবে। তাই ক্যাপ্টেন আকবর একত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের কাছে খবর দিয়ে লােক পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু ঘন অন্ধকারের মধ্যে অথৈ পানি পেরিয়ে কেউ যেতে সাহস করছিল না। তখন ক্যাপ্টেন আকবর নিজেই তাঁর রানারকে সাথে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের সাথে দেখা করেন। যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের সঙ্গে আলাপ করে এ ও ‘বি’ কোম্পানি নিয়ে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর নজর এড়িয়ে পিছু হটে আসেন। এ ও ‘বি’ কোম্পানি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার অবস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর না পেয়েও ক্যাপ্টেন হেলাল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা অনুধাবন করে তার ছাত্র ও মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানিকে নিয়ে কোনােমতে পাকিস্তানি বাহিনী শেলা সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে ফিরে যান।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধে রক্তক্ষয়ী ছাতক অপারেশনের সমাপ্তি হয়। যুদ্ধের ফলাফল ছাতক অপারেশনটি পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙে দিতে সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর। ভূমিকা পালন করে। ছাতক অপারেশনে উভয় পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়, যা নিম্নরূপ: | ১, মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে প্রায় ৭০-৮০জনের মতাে শহিদ হন। ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মােহসিনের কপাল ঘেঁষে ১টি বুলেট চলে গেলে তিনি সামান্য আহত হন। পাকিস্তানিদের প্রচুর হতাহত হয়। এ অপারেশনে যাওয়ার কারণে ক্যাপ্টেন মােহসিনের ‘সি’ কোম্পানিটি সম্পূর্ণরূপেই যুদ্ধের জন্য অযােগ্য বিবেচিত হয়। অতর্কিত আক্রমণের মুখে কোম্পানির অধিকাংশ সৈনিকই নদীতে নিজ নিজ অস্ত্র ফেলে দিয়ে সাঁতরে এসে কোনােরকমে প্রাণে বেঁচে যায়। ‘সি’ কোম্পানির পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০-৩৫জনের মতাে। ‘সি’ কোম্পানির শতকরা ৬০ ভাগ অস্ত্রই নদীতে পড়ে যায়। পাকিস্তানিদের পক্ষে অস্ত্রবলের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। ৫-৬ দিন ধরে। ওরা মৃত লাশগুলাে সালুটিকর বিমানঘাঁটি এলাকায় বহন করে নিয়ে যায়। বাক্সভর্তি এসব লাশ বিমানে করে পাকিস্তানে পাঠানাে হয়। লাশগুলাে পাকিস্তানি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ ছাতক অপারেশন ছিল একটি ত্রুটিযুক্ত পরিকল্পনার ফল।
এ অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর ব্যর্থতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সফলতার সম্ভাব্য কারণগুলাে নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনীর ব্যর্থতার কারণ: ক, পর্যাপ্ত রেকি ও পরিকল্পনার অভাব: ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের প্রচলিত ধারার আক্রমণ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য এ ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় প্রায় কিছুই করা হয়নি। প্রথাগত যুদ্ধের সাধারণ নিয়মটি পর্যন্ত এ অপারেশনে মানা হয়নি। যার কারণে ক্যাপ্টেন মােহসিনের পুরাে ‘সি’ কোম্পানিটিকেই ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখােমুখি হতে হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী ‘ডি’ কোম্পানির ৪টি প্লাটুনের মধ্যে ২টি প্লাটুন এবং অধিনায়ক রশিদের পুরাে গণবাহিনী কোম্পানিকেই হাওরের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আক্রমণের লক্ষ্য, দিক ও প্রকার নির্ধারণ না করা: কনভেনশনাল পদ্ধতির যে-কোনাে আক্রমণের আগে থেকেই আক্রমণকারী দলগুলাের লক্ষ্যস্থির করে নিতে হয়। শত্রুর অবস্থানের এবং তাদের জনবল ও অস্ত্রবল সম্বন্ধে সঠিক খবরাখবর নিয়ে পূর্ব থেকেই আক্রমণের প্রকার ঠিক করে নিতে হয়। ছাতক অপারেশনে এসব ব্যাপারে কিছুই করা হয়নি। গ, জনবল বৃদ্ধি এবং পুনরায় সরবরাহ পরিকল্পনার অভাব: সীমান্ত থেকে আনুমানিক ২৫-৩০ কিলােমিটার অভ্যন্তরে এবং বিশেষ করে হাওর-বাঁওড়-বিলে ভর্তি এলাকায় একটি কনভেনশনাল পদ্ধতির আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন ছিল অস্ত্র, গােলাবারুদ ও জনবল সরবরাহের পূর্বপরিকল্পিত কার্যকর ব্যবস্থা।
এলাকার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রয়ােজন ছিল বেইজ সাপ্লাই পয়েন্ট, ইন্টারমিডিয়েট সাপ্লাই ও ফরওয়ার্ড সাপ্লাই পয়েন্টের ব্যবস্থা করা এবং এসবের তত্ত্বাবধানে যােগ্য লােক নিয়ােগ করা। রিলে সিস্টেমে এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহ করার প্রয়ােজন ছিল। জনবল বৃদ্ধির জন্য প্রয়ােজনীয় রিজার্ভ ফোর্স রাখার প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু ছাতক অপারেশনের ব্যাপারে এসবের কোনাে কিছুই করা হয়নি। যার ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ শত্রুর আক্রমণের মুখে ২ দিনের বেশি নিজ নিজ অবস্থানে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। যােগাযােগ মাধ্যমের অভাব: কনভেনশনাল পদ্ধতির যে-কোনাে আক্রমণের পূর্বশর্ত হচ্ছে আক্রমণকারী দলগুলাের নিজেদের মধ্যে আশপাশের ইউনিট ও সদর দপ্তরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু রাখা। অথচ ছাতকের মতাে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে এ নিয়মটি মানা হয়নি। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকারী দলগুলাের কাছে পর্যাপ্ত ওয়্যারলেস সেট ছিল না। নিজেদের মধ্যে যােগাযােগের একমাত্র বাহন ছিল রানার। জলমগ্ন হাওর এলাকায় নৌকার সাহায্যে রানার পাঠিয়ে যােগাযােগ রক্ষা করাটা ছিল খুবই কঠিন কাজ। সদর দপ্তরের যােগাযােগ রক্ষার জন্য কোম্পানির কাছে যে ওয়্যারলেস সেটটি ছিল, সেটি অচল হয়ে পড়েছিল। ফলে রিয়ার সদর দপ্তরের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছিল না।
ঙ. ফায়ার সাপাের্ট পরিকল্পনার অভাব: কনভেনশনাল পদ্ধতির যে কোনাে আক্রমণের জন্য প্রয়ােজন পর্যাপ্ত বিমান ও গােলন্দাজ সাপাের্ট। অথচ ছাতক অপারেশনের জন্য এ ব্যাপারে কোনাে কার্যকর পরিকল্পনা ছিল না। মূল আক্রমণকারী দল এ’, ‘বি’ ও ছাত্র কোম্পানির জন্য প্রয়ােজন ছিল ৪.২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের ফায়ার সাপাের্ট, যা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। ২. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সফলতার কারণ: ক, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত জনবল থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। খ, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরদার ছিল বিধায় নিজস্ব অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ওপর কার্যকর ফায়ার আনতে সক্ষম হয়। সঠিক সময় রি-ইনফোর্সমেন্ট আসায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনােবল বৃদ্ধি পায় এবং পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব বিমান ও গােলন্দাজ ফায়ার সমর্থন মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা ও আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যাহত করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরােধ গড়ে তােলা সহজসাধ্য হয়। ঙ. যােগাযােগ মাধ্যম ভালাে হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি অবস্থানের | ওপর পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়। তথ্য সংগ্রহ এবং সঠিক সময় সংবাদ সংগ্রহ পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সফলতা লাভে সহায়তা করে।
উপসংহার
ছাতক অপারেশন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থানিক পরিবেশ মুক্তিবাহিনীর কিছুটা অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ও তড়িঘড়ি করার কারণে এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। এলাকার পরিচিতি, যুদ্ধের প্রয়ােজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ এবং সর্বোপরি সুষ্ঠু ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা যে-কোনাে যুদ্ধে সফলতা অর্জনে অপরিহার্য এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাহস ও বীরত্বের পরিচয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং স্বাধীনতা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড