বিশ্বনাথ রেইড
সিলেট সদর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১৪ কিলােমিটার দূরে বিশ্বনাথ অবস্থিত। বিশ্বনাথ সিলেট জেলার একটি থানা সদর। ১২ ডিসেম্বর লামাকাজীর দখল নিয়ে নিলেন মেজর মীর শওকত। পিছনে সমগ্র সুনামগঞ্জ এখন শত্রুমুক্ত কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ নেই। আর তা করতে গেলে বিপদের আশঙ্কা। তাই তাকে এখানেই থাকতে হবে। তার অধীন সৈন্যদের ভেতর থেকে আলাদা ১টি দল গঠন করলেন। নিযুক্ত করলেন একজন অধিনায়ক। তারপর পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দেন বিশ্বনাথে। দলটি সিলেট না এসে অন্য পথে বিশ্বনাথ প্রবেশ করে। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেন তারা। মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রােধ করার মতাে শক্তি, সাহস ও মনােবল কোনােটাই তখন। পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট ছিল না। রণেভঙ্গ দিয়ে তাই পালিয়ে যায় তারা। সহজেই শত্রুমুক্ত হলাে বিশ্বনাথ দখলে এল মুক্তিবাহিনীর।
সিলেট এমসি কলেজের যুদ্ধ
‘জেড’ ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিন) আটগ্রাম-কানাইঘাট হয়ে দরবস্ত পৌছে ১০ ডিসেম্বর। দরবস্ত পৌছে ইউনিটটি দরবস্ত-সিলেট সড়ক ব্যবহার না করে চা-বাগানের পথ ধরে সিলেটে যাত্রা শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজের উত্তর পাশে এসে পেীছে। ১৪ ডিসেম্বর ভােরের আলাে ফুটতেই ২০০ গজ দূরে টিলার ওপর এমসি কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন দৃষ্টিগােচর হয়। এমসি কলেজে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাম্প ছিল। সেদিকে মুখ করে ব্রাভাে কোম্পানি প্রতিরক্ষাব্যুহ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ডানের দিকে ডেলটা কোম্পানি। পিছনে চার্লি, আলফা কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন সদর। শহরের অভ্যন্তরে এত কাছাকাছি মুক্তিবাহিনী এসে গেছে, এটা শত্রুরা ভাবতেই পারেনি। মুক্তিবাহিনীর পরনেও শত্রুদের মতােই খাকি পােশাক, হাতে অনুরূপ চাইনিজ অস্ত্র। শত্রুরা উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় চিৎকার করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের পরিচয় জানতে চাইল। মুক্তিবাহিনী উত্তর না দিয়ে দ্রুত ট্রেঞ্চ খুঁড়ে চলেছে প্রতিরক্ষা নেয়ার জন্য। মুক্তিবাহিনীর নীরবতায় এবং শত্রুদের দিকে মেশিনগান তাক করে পজিশন নেয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেল শত্রুরা। দ্রুত সংগঠিত হয়ে শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা টিলার ওপর সুবিধাজনক অবস্থান থেকে আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রুদের ৪০জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
যুদ্ধের সময় যেহেতু মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নেয়া সম্পন্ন হয়নি, তাই মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলাে। ব্রাভাে কোম্পানির ৭জন শহিদ এবং ১৪জন। মারাত্মকভাবে আহত হলাে। খর্বাকৃতি বলে যাকে একদিন রিক্রুট করতে চায়নি, সেই সদাহাস্যময় সাহসী তরুণ যশােরের বন্দুক বিক্রেতার ছেলে মহিউদ্দিন শহিদ হলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের যােগ্যতম প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার ফয়েজ অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শহিদ হলেন। মেশিনগান ডিটাচমেন্টের সিপাহি বাচ্চু মিয়া ও নূর নবী শহিদ হওয়ার পর নায়েব সুবেদার হােসেন আলী সাহসিকতার সঙ্গে মেশিনগান চালিয়ে শত্রুদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। আহতদের পিছনে পাঠিয়ে দেন। ডাক্তার মজিবুর রহমান ফকির তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা এবং জীবনরক্ষাকারী ইনজেকশন দিয়ে কোনােভাবে বাঁচিয়ে রাখেন। দুপুরের দিকে মেজর রাওয়ের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর বেতার সংযােগ। পুনঃস্থাপিত হলাে। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক তাকে সামনের অধ্যক্ষ ভবনে অবস্থানরত শক্রদের ওপর বিমান হামলা চালাতে বললেন। কিছুক্ষণ পর মেজর রাও জানালেন, মিত্রবাহিনীর বিমান আসছে। আধা ঘণ্টা পর মিত্রবাহিনীর ২টি ফাইটার এসে সামনের পাকিস্তানি বাহিনীদের বাংকার ও দালানের ওপর প্রায় ১০ মিনিট ধরে রকেট নিক্ষেপ করে গেল। মুক্তিযােদ্ধারা আনন্দে চিল্কার করে ওঠেন। বিমান আক্রমণের শব্দই পদাতিক বাহিনীর মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রকেট হামলার পর পাকিস্তানি বাহিনীর আর কোনাে তৎপরতা দেখা যায়নি।
অস্ত্রশস্ত্রের অপর্যাপ্ততা, বহুবিধ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস, মনােবল, বীরত্ব, রণনৈপুণ্যের নিকট পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শহিদদের তালিকা। থেকে এ যুদ্ধে যে কয়জন শহীদের নাম পাওয়া গিয়েছে তারা হলেন: সিপাহি মাে. ফজর আলী, সিপাহি মাে. আজিজুল হক, সুবেদার মাে. ফয়েজ আহমেদ বীর-উত্তম, নায়েক মাে. আফসার আলী বীরবিক্রম, নায়েক মাে. নূর নবী, সিপাহি মাে. আবদুস সালাম, সিপাহি মাে. আবু তাহের, সিপাহি মাে. বাচ্চু মিয়া, সিপাহি মাে. মহিউদ্দিন, সিপাহি ফজর আলী, সিপাহি মাে. আজিজুল হক। বাকি শহিদদের নাম পাওয়া যায় নি। এমসি কলেজ এলাকার শহিদদের সে যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাহিত করা হয়।
সিলেটে যৌথবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযান ও সিলেট বিজয়
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধের অভিযান নতুন ও চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করে। মেঘালয় অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল গুল বক্স সিং গিল। তিনি সিলেটের উত্তর অংশের অপারেশন পরিচালনা করেন। যৌথবাহিনীর পরিকল্পনা অনুসারে ৪ ডিসেম্বরে সিলেটের পূর্ব দিক করিমগঞ্জ থেকে ভারতের ৮ মাউন্টেন ডিভিশন সিলেট অভিমুখে অভিযান শুরু করে। এ ডিভিশনের ২টি ব্রিগেড তথা ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড যথাক্রমে ধর্মনগর-কুলাউড়াফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট অক্ষে এবং শমসেরনগর-মৌলভীবাজার-সিলেট অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে। এদিকে ইকো সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকে তামাবিলজৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে। মিত্রবাহিনীর সাথে ‘জেড’ ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ‘জেড ফোর্স সদর দপ্তর (ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্স) ও ১টি আর্টিলারি ব্যাটারি আটগ্রাম-কানাইঘাট-সিলেট অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে। জেড ফোর্সের অন্য ইউনিট ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (অধিনায়ক মেজর এ কে এম আমিনুল হক) মিত্রবাহিনীর সাথে মৌলভীবাজারসিলেট অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে। অপরদিকে উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে ৫ নম্বর সেক্টর ট্রপস সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বালাট সাব-সেক্টরের ট্রপস ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহর দখল করে নেয় এবং ঐদিন ছাতকের ওপরও তীব্রভাবে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। সেক্টর অধিনায়ক মেজর শওকত ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি এবং শেলা সাব-সেক্টর টুপস নিয়ে ছাতক আক্রমণ করেন। ৭ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ছাতক শহর মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গােবিন্দগঞ্জ আশ্রয় নেয়।
এদিকে মেজর শাফায়াত জামিলের ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি ও গণবাহিনী কোম্পানিগুলাে ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রপসসহ রাধানগর নিয়ন্ত্রণে এনে (৩০ নভেম্বর) গােয়াইনঘাট হয়ে (৪ ডিসেম্বর) সালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লেফটেন্যান্ট নবীর নেতৃত্বে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণবাহিনীর কোম্পানি ৭ ডিসেম্বর সালুটিকর বিমানবন্দরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মিত্রবাহিনীর অগ্রগতি আশাতীত না দেখে ভারতীয় বাহিনী ৭ ডিসেম্বর থেকে সিলেট শহরের মিরাপাড়া এলাকায় (সুরমা নদীর উত্তরে) ও ধুবড়ি হাওরে (বর্তমান উপশহর) এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য (৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট) হেলিকপ্টারের সাহায্যে অবতরণ শুরু করে। এদিকে ‘জেড’ ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্ট (অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিন) আটগ্রাম-কানাইঘাট-দরবস্ত হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮৭ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন ব্রিগেডিয়ার কুলওয়ান্ত সিংয়ের নেতৃত্বে চরখাই-সিলেটের অভিযান অব্যাহত রাখে। ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টর টুপসসহ জৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষে অগ্রসর হয়ে ৮ ডিসেম্বরে হেমুতে পৌছায়। ভারতের ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড। ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট অক্ষে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ডিসেম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর শওকত গােবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গােবিন্দগঞ্জ ছেড়ে নদী পেরিয়ে লামাকাজীতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলে। এমতাবস্থায় মেজর শওকত মিত্রবাহিনীর কাছে বিমানসাহায্য চান। ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় ৩টি মিগ বিমান লামাকাজীতে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর বােমাবর্ষণ করে। এরপরই মুক্তিবাহিনী লামাকাজী দখলের জন্য অগ্রসর হতে চাইলে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে মেজর শওকতকে জানানাে।
হয় যে সেম সাইডের বিবেচনায় তার লামাকাজীতে থাকা উচিত। সেক্টর অধিনায়ক মেজর শওকত তার বাহিনী নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওখানেই রইলেন। মেজর শওকত সামনে অগ্রসর হতে না পেরে তার কিছু সৈনিককে। বিশ্বনাথে পাঠিয়ে দিলেন। ঐ বাহিনী বিশ্বনাথ দখল করে ১৫ ডিসেম্বর। ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ১ ডিসেম্বর থেকে কুলাউড়ায় আটকে থাকে। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর শত্রু নিধনের জন্য বিমান আক্রমণ পরিকল্পনা করলে কুলাউড়ার পতন হয়। ৯ ডিসেম্বর ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড মৌলভীবাজার পৌছায় এবং ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড (৬ রাজপুত) ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট অক্ষে ৪ ডিসেম্বরে মােগলা বাজারে পৌছায়। ৮১ ব্রিগেডের ৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ১১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার হয়ে শেরপুর-সাদিপুর ১১ ডিসেম্বর পৌছায়। এরপর কোর রিজার্ভ হিসেবে ৮১ ব্রিগেড (১টি ব্যাটালিয়ন ছাড়া) আগরতলায় সমবেত হয়। পাকিস্তানিরা সিলেট থেকে বেসামরিক লােকজন সরিয়ে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করে। পাকিস্তানি ২০২ ব্রিগেডের হাতে সিলেট শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। মৌলভীবাজার থেকে পাকিস্তানি ৩১১ পদাতিক ব্রিগেড এসে সিলেট গ্যারিসনে যােগ দেয়। ১৩ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট অক্ষে ৫৯ ব্রিগেড এবং মৌলভীবাজার-শেরপুর-সিলেট অক্ষে ৮১ ব্রিগেডের অগ্রবর্তী ব্যাটালিয়নগুলাে সিলেট শহরের দক্ষিণ উপকণ্ঠে পৌছায়।
ডাউকি থেকে দক্ষিণে ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টকে ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে আনা হয় এবং ৭ ডিসেম্বর জৈন্তাপুর-দরবস্ত-সিলেটের দিকে এগােতে শুরু করে। জৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৩ ডিসেম্বর হেমু-চিকনাগুল-খাদিমনগর হয়ে পাহাড়ি পথে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে পৌছায়। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়মিত ইউনিটের মধ্যে সর্বপ্রথম সিলেট শহর প্রবেশ করে। জৈন্তাপুর-সিলেট অক্ষে ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকে সেক্টর টুপসসহ হেমু শত্রুমুক্ত করে ১৫ ডিসেম্বর সিলেট শহরের নিকটবর্তী খাদিমনগরের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার মুখােমুখি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ ডিসেম্বর সিলেটে আসেন পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। তার জন্য স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা এক সভার আয়ােজন করে। ১৫ ডিসেম্বর সিলেট শহরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনী সবদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর ৪ ও ৫ সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী তামাবিল-সিলেট সড়কপথে সিলেটের এমসি কলেজের কাছে পৌঁছায়। তখন এমসি কলেজের গেইটের সামনে (বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে) পাকিস্তানি ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার হােসেন রানা যৌথবাহিনীর অধিনায়ক।
ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকের কাছে রিভলবার হস্তান্তর করেন। এটি ছিল সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতীকী অস্ত্রসমর্পণ। ঐ অনুষ্ঠানে মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে কাজী ফারুক আহমদ ও জয়ন্ত কুমার সেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বিবিসি’র সাংবাদিক (ফটো) গাড়ি ক্যামেরাসহ উপস্থিত ছিলেন। বিবিসি থেকে এ খবরটি প্রচারিত হয়। এদিকে ঐদিনই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ‘জেড’ ফোর্সের ফোর্স অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানসহ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটে প্রবেশ করেন। এদিকে ১৬ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ কর্নেল ওসমানী ভারতীয় বাহিনীর। ১টি রুশ হেলিকপ্টার নিয়ে সিলেটের দিকে রওনা হন। হেলিকপ্টারে অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব, ভারতের ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং কর্নেল ওসমানীর এডিসি লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল। দুর্ভাগ্যবশত ফেঞ্চুগঞ্জের ওপর দিয়ে উড্ডয়নকালে ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত গুলিতে হেলিকপ্টারটি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় ফেঞ্চুগঞ্জের বাজারের কাছে ধানক্ষেতে পড়ে যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব গুলিবিদ্ধ হন। কর্নেল ওসমানী। ঐ দিনই সিলেট শহরে আসেন। | ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় সিলেটের রাজনৈতিক নেতারা, মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকে, ব্রিগেডিয়ার কুইন, ‘জেড’ ফোর্সের ফোর্স অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান এবং ৪ ও ৫ সেক্টরের সেক্টর অধিনায়করা উপস্থিত ছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল মাঠে (বর্তমানে সিলেট ক্যাডেট কলেজ) পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করে। ঐ অস্ত্রসমর্পণের সময় ভারতের ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কে বি কৃষ্ণ রাও উপস্থিত ছিলেন। ঐদিন সিলেটে ৩জন ব্রিগেডিয়ারসহ ১০৭জন অফিসার এবং ৬,৫০০জন পাকিস্তানি সৈনিক আত্মসমর্পণ করে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড