সুনামগঞ্জ জেলার প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরােধ
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ সিলেট শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত টিলাগড়। টিলাগড় চৌরাস্তায় ২জন পাকিস্তানিকে রিভলবারের গুলিতে হত্যা করার মধ্য দিয়েই সিলেট অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরােধের শুরু। বিদ্যুৎ গতিতে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের সারা দিন ধরে চলে প্রস্তুতি। ২৭ মার্চ ছিল সুনামগঞ্জ মহকুমার জন্য একটি ভয়াবহ দিন। শহরের অলিগলিতে ভাের হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে-কোনাে সময় শহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা। চলে আসতে পারে আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানি সৈন্যদের মােকাবিলারও প্রস্তুতি চলছিল সমানতালে। একসময় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে জলপাই রঙের সামরিক কনভয় আসতে দেখা গেল সেই কনভয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সদস্যের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন মাহবুব লক্ষ্যস্থল তাদের সুনামগঞ্জ থানা দখল করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা শহরে তখন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে তাই সমগ্র সুনামগঞ্জ শহরে কায়েম হয়েছে এক ত্রাসের রাজত্ব মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানিদের এ আক্রমণ প্রতিহত করতে আনসার ক্লাবের ৫০টি রাইফেল ও ২ হাজার বুলেট নিয়ে আসে মালদার আব্দুল হাসিম, জসিম উদ্দিন, তারা মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মােহাম্মদ রহিম, সুব্রত চক্রবর্তী, আব্দুল জব্বার, আবুল হােসেন প্রমুখ ৫০জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করে আশ্রব আলী ও নবাব আলী। আনসার অ্যাডজুটেন্ট এম এ মােকাব্বিরের সহায়তায় সংগঠিত হয় আনসার বাহিনী। আসে পুলিশ এবং শেষে ইপিআর সদস্যরাও। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে গােলাম রব্বানী।
কিন্তু প্রস্তুতি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সংগ্রাম পরিষদের তরুণ সদস্যরা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিল মনােয়ার বখৃত নেক, আবুল হােসেন ও তারা মিয়া। ২৭ মার্চ রাত থেকে ২৮ মার্চ দুপুর পর্যন্ত গােলাগুলি হওয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বাধ্য হয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেয়। এ সময় কলেজ থেকে হুমায়ুন কবির চৌধুরী ও নজির হােসেনের নেতৃত্বে আসে ছাত্র মিছিল। অন্য একটা মিছিল আসে সুরমা নদীর অপর পাড় থেকে। ঐ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় সন্ধি। ফর্মুলা। প্রহৃত হয় মহকুমা প্রশাসক মােকাম্মেল হােসেন কারণ, তিনি সন্ধি ফর্মুলা কার্যকর করার চেষ্টা করছিলেন।
পরে সুনামগঞ্জের সমস্ত সীমান্ত চৌকি থেকে ইপিআর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিলে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণভার চলে যায় তাঁদের হাতে। বিকালে শুরু হয় বৃষ্টি। এ অবস্থায় ২৯ মার্চ ভােরে ক্যাপ্টেন মাহবুব তার দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। পিছনে পড়ে থাকে তাদের ২জন আহত সৈনিক। উত্তেজিত জনতা পরে এদের হত্যা করে। এ যুদ্ধে ২৮ মার্চ আনসার অধিনায়ক আবুল হােসেন এবং রিকশাচালক গণেশ শহিদ হন। আর ২৯ মার্চ শাহাদতবরণ করেন ইপিআর-এর ১জন নায়েক। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে তাহিরপুর থানাটি অত্যন্ত নিরিবিলি জনপদ। যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন এ এলাকাটি ছিল গেরিলা যুদ্ধের জন্য খুবই ভালাে জায়গা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে এ এলাকার জনগণও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। প্রতিরােধ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞে ক্ষণিকের জন্য শঙ্কিত হলেও পর মুহুর্তেই এ এলাকার সর্বস্তরের জনগণ সশস্ত্র প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তড়িঘড়ি করে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। যাতে জলে ও স্থলে পাকিস্তানিরা তাহিরপুর এলাকায় না আসতে পারে, এ জন্য নবগঠিত মুক্তিবাহিনী স্থানে স্থানে সশস্ত্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক সদস্য সুনামগঞ্জ শহর পুনর্দখলে সেখানকার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অপারেশনে অংশ নিতে ছুটে যান।
স্থানীয় এমএনএ আব্দুর জহুর এখানকার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হিসেবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। সীমান্তবর্তী এলাকা টেকেরহাটে এপ্রিল মাসেই স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে এ টেকেরহাটকেই সাব-সেক্টরের মর্যাদায় উত্তীর্ণ করে এখান থেকে পুরাে ৯ মাস অত্র এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। ২৮ এপ্রিল থানার ওসি শফিকুর রহমান, ইপিআর-এর সুবেদার আব্দুল হাই ও চুনাপাথর প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়। ওসি শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কথা চিন্তা করে কয়েক দিন পর সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ, টেকেরহাট শাখা গঠন করা হয় এ সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিতে ছিল আব্দুর জহুর এমএনএ, বাবু সুরঞ্জিত সেন এমপিএ, হােসেন বখত, আলী ইউনুছ, জহির হােসেন প্রমুখ রাজনৈতিক নেতারা বাবু সুরঞ্জিত সেনের নেতৃত্বে কিছুদিনের মধ্যেই আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সংখ্যক ছুটে আসা লােকদের একত্র করে এক বিরাট বাহিনী গড়ে তােলা হয়। স্থানীয় যুবকদের স্বল্প সময়ের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বাহিনীর শক্তিকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। ২৯ জুলাই সাচনা জামালগঞ্জ বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ছাতক থানাটি সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে সােজা পূর্বে অবস্থিত। বাণিজ্যসফল এ অঞ্চলটি সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। জাতীয় পরিষদের সদস্য আব্দুল হক সাহেবের সার্বিক নেতৃত্বে ছাতক থানায় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরােধ সংগ্রাম পরিচালিত হয়।
২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ছাতক শহরটি মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ছাতকের পতন ঘটলে এ এলাকার মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পশ্চাদপসরণ করে ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী বাঁশতলা এলাকায় গিয়ে পুনরায় একত্র হন। সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। মুজাহিদ বাহিনীর অধিনায়ক শহিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এ এলাকায় সর্বপ্রথম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ দুই বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর টেংরাটিলা অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। মাত্র ১১টি .৩০৩ রাইফেল, ১টি স্টেনগান, ১টি পিস্তল, ৬টি গ্রেনেড এবং ৬০-৭০টি ৩০৩ রাইফেলের গুলি ছিল এ সম্মিলিত বাহিনীর সর্বমােট অস্ত্রবল। ২২ মে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার জওয়ান নামক নিভৃত পার্বত্য । এলাকায় এ অঞ্চলের সর্বপ্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র ২৮ দিনের প্রশিক্ষণের পর মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের ৩টি কোম্পানিতে বিভক্ত করে জুন মাসের শেষের দিকে বালাট, সেলা ও ভােলাগঞ্জ এ ৩টি স্থানে পাঠানাে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শহিদ কোম্পানি, ইদ্রিছ । কোম্পানি এবং সামছউদ্দিন কোম্পানি নাম দিয়ে এদের সংঘবদ্ধ করা হয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত কোনাে সাব-সেক্টর অধিনায়ক না থাকায় এ কোম্পানিগুলাে বিচ্ছিন্নভাবে ভারতীয় বিএসএফ অফিসারদের নির্দেশে অপারেশন পরিচালনা করে।
বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের শহর নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী ধর্মপাশার অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর খালবিলে ঘেরা জনপদটি সুনামগঞ্জ জেলা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা শহর। মহেশখলা ছিল ভারত সীমান্তে গারাে ও খসিয়া পাহাড়ের সঙ্গমস্থলে। মধ্যনগর থানাটিও ছিল পাশাপাশি। ধর্মপাশা, মধ্যনগর ও মহেশখলা নিয়েই ছিল ধর্মপাশা মহেশখলা’ সাব-সেক্টর। সুনামগঞ্জ, কিশােরগঞ্জ ও নেত্রকোনা পাকিস্তানের দখলে চলে যাওয়ার পর মহেশখলা নদীর দুই পাড়ে সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য যুবক ও নারী-পুরুষ একত্র হতে শুরু করেন। আনসার, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যও এখানে একত্র হন। এখানে উৎসাহী যুবকদের সংগঠিত করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার দায়িত্বে ছিলেন আবদুল হেকিম চৌধুরী, খলিলুর রহমান চৌধুরী, ড. আখলাকুর রহমান, আবদুল খালেক, আবদুল কাদের এমপিসহ অনেকে। মহেশখলা কেন্দ্র থেকে ধর্মপাশা, মােহনগঞ্জ, বারহাট্টা, মদন, নেত্রকোনা প্রভৃতি অঞ্চলে গেরিলা পদ্ধতিতে খণ্ড খণ্ড অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ জুন এ অঞ্চলে স্থানীয় আনসার অধিনায়ক কাজী আলমের নেতৃত্বে ২৫০ সদস্যের ১টি শক্তিশালী চৌকস মুক্তিবাহিনী দলের সমন্বয়ে প্রথম প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু হয়। এদিন কাজী আলমের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী ধর্মপাশা অভিমুখী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে বসে। ১জন মেজরসহ পাকিস্তানিদের ২০জন সৈনিক এতে হতাহত হয়। কিন্তু দক্ষ সংগঠিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিহামলার মুখে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। ফলে ধর্মপাশা ঐদিনই পাকিস্তানিদের দখলে চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় মহেশখলায় ফিরে এসে নিজেদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।
২ জুলাই মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সৈনিক তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার কাছাকাছি একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল তখন ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তিযােদ্ধা দলটি। স্থানীয় লােকজনের সহায়তায় চলতাে তাদের দৈনন্দিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। মুক্তিযােদ্ধাদের সেই অপেক্ষায় ছেদ পড়লাে অচিরেই। ২ জুলাই পাকিস্তানি সেনাদের ১টি গ্রুপ টহল দিতে আসে ঐ গ্রামে। তবে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কথা জানা ছিল না তাদের। তাই তারা নির্দ্বিধায় গ্রামে ঢুকে পড়ে। এ সুযােগের অপেক্ষায় ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। গ্রামে ঢুকতেই গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে বসেন পাকিস্তানি দলটির ওপর। মুক্তিযােদ্ধাদের এ অতর্কিত আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পুরাে পাকিস্তানি বাহিনী। এ ঘটনার প্রতিশােধমূলক জের হিসেবে পরবর্তীকালে সমস্ত গ্রামটিতে পাকিস্তানিরা লুটপাটের অভিযান চালায় ও অগ্নিসংযােগ করে। এমনকি তাদের ঐ হামলা থেকে মুসলিম লীগ ও পিডিপি নেতাদের বাড়িঘরও রক্ষা পায়নি। এ সময় মুক্তিবাহিনী বালাগঞ্জ থানার শেরপুরের কাছে একটি সেতু ধ্বংস করতেও সমর্থ হয়েছিল। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণের থানা ছিল এ দীরাই ও শাল্লা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এ অঞ্চলের স্বাধীনতাপ্রিয় মুক্তিকামী জনগণও ঘরে বসে থাকেনি, বরং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এ অসহযােগ আন্দোলনের ডাকে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কর্তৃক ঢাকায় মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ থেকেই এখানকার সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র প্রতিরােধ আন্দোলনে অংশ নিতে এগিয়ে আসে।
নৌপথে পাকিস্তানিদের ঢাকার পথে বৃহত্তর সিলেটের যােগাযােগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আর এ স্থানটিই ছিল দিরাই আর শাল্লায় একমাত্র নৌপথ, যার মাধ্যমে তাদের এ দুই স্থানের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার মতাে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। অত্র এলাকার জনপ্রতিনিধি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সার্বিক নেতৃত্বে দিরাই শাল্লায় প্রাথমিক প্রতিরােধ সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল। ৫ জুলাই সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে শাল্লা ও ধীরাই আক্রমণ পরিচালনার মধ্য দিয়ে এ এলাকার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক নায়েক আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর ওপর এ ২টি থানায় আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত এ এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা। বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, জগন্নাথপুর ও হবিগঞ্জ এলাকার বিস্তৃত অঞ্চলে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন চালিয়ে যান। ৬ আগস্ট নদীপথে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা পাকিস্তানিদের ১টি বার্জ ডুবিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রথম সফল অভিযান পরিচালনা করেন। ২৮ আগস্ট দিরাই, শাল্লা পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্তবর্তী এলাকা টেকেরঘাট থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পরবর্তী অপারেশনগুলাে পরিচালনা করেন। আর এভাবেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৪ মাস সময়ে পুরাে ৫ নম্বর সেক্টর বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে পরিচালিত হয়েছিল। ভাঙ্গাডহর ছিল দিরাই থানাধীন সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রাম। সুরমা নদীর ওপাড়ে এ থানার অবস্থান, যা সুনামগঞ্জ সদর শহর থেকে প্রবাহমান। জনমানবশূন্য এ গ্রামে মিলিত হলেন মুক্তিযােদ্ধা ছালেহ চৌধুরী ও আব্দুল কুদ্ছ। পরিকল্পনা তৈরি করলেন তারা একটি অপারেশনের। তাঁদের সাথে ছিল ১২জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল। প্রত্যেকের হাতে ছিল ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থেকে উঠিয়ে আনা প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ।
এ অস্ত্র দিয়ে তারা দিরাই থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। দিরাইয়ে তখনাে পাকিস্তানি সৈন্য আসেনি। তবে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় কিছু দালাল পাকিস্তানিদের এখানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু এর আগেই সালেহ চৌধুরী ও আবদুল কুদ্স তাদের এ চেষ্টা প্রতিহত করতে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন। ৬ জুলাই রাত ১২টায় দিরাই থানার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনীর এ গ্রুপটি রওনা হয় ভাঙ্গাডহর গ্রাম থেকে দিরাই পৌছতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা।
নৌকাগুলাে পথ অতিক্রম করে একসময় এসে ভিড়লাে বাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে। এবারে একটি ক্ষীণকায় খাল দিয়ে কালনি নদীতে নামতে হবে। তারপরই দিরাই থানা। নৌকাগুলােকে ভাগ করা হয় পরিকল্পনামাফিক। একটিতে বােঝাই করা হলাে সমস্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদ তারপর দলনেতা সালেহ চৌধুরী নৌকায় উঠে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অন্য ২টি নৌকায় করে মুক্তিযােদ্ধারা চুপিসারে এগিয়ে গেলেন থানার দিকে। এক এক করে প্রহর গুণছেন অধিনায়ক। তারপরই নিস্তব্ধতা। একজন মুক্তিযােদ্ধা এগিয়ে এসে জানালেন তাদের অপারেশন সফল হওয়ার সংবাদ জানালেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও একজন দালালকে হত্যা করার সংবাদ। অবশেষে সমস্ত অস্ত্র ১টি নৌকায় বােঝাই করে বালাটে পাঠানাে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের পক্ষে এসব অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করেন তকালীন এমপিএ দেওয়ান। ওবায়দুর রাজা চৌধুরী। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক ধরে ১০ কিলােমিটার অগ্রসর হলেই সদরগড়। পাগলা ও জয়কলসের মধ্যবর্তী স্থান। এখানে রয়েছে একটি সেতু। সেতুটি ধ্বংস করার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের অবস্থান সুনামগঞ্জের সাথে সিলেট শহরের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করা হয়। এ অভিযান পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ টেকেরহাট সাব-সেক্টর। ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন টেকেরহাট সাব-সেক্টর থেকে পরিচালিত হবে এ অভিযান। দলের সদস্য। সংখ্যা নির্ধারিত হয় ৩০জন। সকলের আলাদা আলাদা দায়িত্বও নির্ধারিত হয়। এভাবেই চলে সুনামগঞ্জের প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরােধ। (সুনামগঞ্জ জেলার প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরােধের নকশাটি দেখুন ৮৫৫ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড