You dont have javascript enabled! Please enable it!
সিলাম রেইড
সিলেট শহর থেকে সিলাম গ্রামটি ৫ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেট সদর থানাধীন সিলাম ইউনিয়নের একটি বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল অবস্থান গ্রহণ করে এ বাড়িতে তাদের জন্য শীতের কাপড়, সিগারেট ও নগদ টাকা নিয়ে রাত ২টায় ১জন লােক আসবেন। তারা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কিন্তু তার আগেই সেখানে রাজাকারদের আগমন ঘটে। তারা অবশ্য জানতাে না যে, মুক্তিযােদ্ধারা এখানে অবস্থান নিয়েছে এর আগে এ বাড়িরই একটি যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল দালালেরা। কিন্তু এসব ঘটনা প্রায় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেও এর প্রতিকার করতে পারেননি।
মুক্তিযােদ্ধারা, শুধু নিজেদের ও গ্রামবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। তবুও মুক্তিযােদ্ধাদের আগমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। মােগলবাজার ইউনিয়নের শান্তি কমিটির আহ্বায়ক উদ্যোগী হয়ে এই মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে ৫০-৬০জন রাজাকারের সাথে মাত্র ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযােদ্ধারা ওত পেতে বসে রাস্তার পাশে। শান্তি কমিটির কাছে যে ব্যক্তি। মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রামে উপস্থিতির খবর পৌছে দিয়েছিল, এ দলে সেও ছিল একসময় সে নাম লিখিয়েছিল মুক্তিবাহিনীতে পরে পালিয়ে এসে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দেয় বাড়ি তার হাজিগঞ্জ গ্রামে অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শকও ছিল একজন পাকিস্তানি দালাল তাই সে নিয়ে যায় তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের পড়তে হয় পাকিস্তানি বাহিনীর পেতে রাখা ফাঁদে একজন রাজাকার গােপন স্থান থেকে বের হয়ে জাপটে ধরে মুক্তিযােদ্ধা আব্দুন নূরকে পিছিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন সুবলচন্দ্র পাল গুলি করতে পারলেন না আব্দুন নূর সেই কাজ করে অন্যরা রাজাকাররা পাল্টা জবাব দেয়। শুরু হয় সংঘর্ষ কিন্তু আব্দুন নূরকে মুক্ত করা সম্ভব হলাে না। আহত হয় ৪জন রাজাকার অবশেষে মুক্তিযােদ্ধারা বিকল্প পথে স্থান ত্যাগকরতে বাধ্য হয়। আব্দুন নূরকে শত্রুরা পাঠিয়ে দেয় কারাগারে তাই প্রাণ রক্ষা পায় তার এক পর্যায়ে সাধারণ বন্দিরা কারাগার ভেঙে বাইরে নিয়ে আসে। আব্দুন নূরকে। মুক্তিযােদ্ধা আব্দুন নূরের মুক্তির সংবাদ শুনেই আত্মহত্যা করে সেই কুখ্যাত রাজাকারটি।
লামনিগাওয়ের যুদ্ধ
লামনিগাও সিলেট জেলার অন্তর্গত কোম্পানিগঞ্জ থানার একটি গ্রাম। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে লামনিগাঁও গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। কোম্পানিগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধার ১টি প্লাটুন বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা লামনিগাঁওয়ের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এ সংবাদ সাব-সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট আখঞ্জির নিকট পৌছলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার বাহিনী নিয়ে লামনিগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হন পথে পাকিস্তানিরা তাঁর দলকে অ্যামবুশ করে। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের পক্ষে ২জন রাজাকার বন্দি ও কয়েকজন হতাহত হয় এবং অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। লেফটেন্যান্ট আখঞ্জি দ্রুত লামনিগাঁও পৌছে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেন এ আক্রমণে পাকিস্তানিরা লামনিগাও ছাড়তে বাধ্য হয়। লেফটেন্যান্ট আখঞ্জি ও মুক্তিযােদ্ধারা পরবর্তীকালে এ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখেন।
খন্দকারের বাজার রেইড
৪ নম্বর সেক্টরের অধীন বারপুঞ্জি সাব-সেক্টরের ৪৪জন যুক্তিযােদ্ধা দেশের ভেতর সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক নিযুক্ত হন ইপিআর-এর ল্যান্স নায়েক নূরউদ্দিন। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁরা বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে করিমগঞ্জ হয়ে সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। দেশের ভেতরে প্রবেশ এবং গন্তব্যস্থলে পৌছার ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরি বিভিন্ন লােকের সাথে যােগাযােগ করে আহার, বাসস্থান ইত্যাদির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তঙ্কালীন। কমিউনিস্ট ও কৃষকনেতা সাংবাদিক ও আইনজীবী তবারক হােসেইন পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন কালােবাজারি তার নৌকা দিয়ে পুরাে বাহিনীকে সুতারকান্দি সীমান্ত থেকে শেওলা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে। পায়ে হেঁটে ভাদেশ্বর হয়ে সিলেট সদর থানাধীন জালালপুর পৌছান তারা কিন্তু এখানে আসতে বেশ কদিন লাগে তাদের। রাতের অন্ধকারে হাঁটা শুরু করে ভােররাত পর্যন্ত একজন নির্দিষ্ট পথপ্রদর্শকের পিছনে পিছনে তাঁরা।
হাটতেন। চোখ-কান থাকতাে সদাজাগ্রত। গ্রেনেড আর বেয়নেট পকেটে এবং আঙুল থাকতাে স্টেনগানের ট্রিগারে বসানাে। কোথা থেকে কখন শত্রু আক্রমণ। করে বসে কে জানে। না জানি কখন মুখােমুখি হতে হবে শক্রর। দিনের বেলায় জানালােনা কোনাে বিশ্বস্ত লােকের বাড়িতে অথবা বনবাদাড়ে লুকিয়ে থাকতেন তারা। সন্ধ্যায় আঁধার নামার সাথে সাথেই আবার পথে নেমে পড়তেন। হয়তাে তখন নতুন আরেকজন পথপ্রদর্শকের ওপর দায়িত্ব বর্তেছে। ৪৪ সদস্যের এ বাহিনী জালালপুর পৌছলে তাদের আহার, বাসস্থান ও পরিকল্পনা তৈরির কাজে সহায়তা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জমসেদ আলী ন্যাপ নেতা সেনাহর আলী ও ন্যাপ নেতা পীর হাবিবুর রহমানের বাগরখলাস্থ বাড়ি এবং রায়খালি, সেনগ্রাম ও কাজিপুর প্রভৃতি গ্রামে তারা ১-২ দিন করে কাটান। তবারক হােসেইনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ হয় সিলেটের ন্যাপ নেতা আবদুল হামিদের। তিনিই এ বাহিনীর প্রয়ােজনীয় টাকা, সিগারেট ও কাপড়চোপড় ইত্যাদি সরবরাহ করেন। জালালপুরের পাশেই কুশিয়ারা নদীর পাড়ে বালাগঞ্জ থানার দেওয়ান বাজার ইউনিয়নের খন্দকারের বাজার। ছােট বাজারটি এ ইউনিয়নেই অবস্থিত বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে বড়ভাঙ্গা নদী প্রবাহিত। বাজারে তখন অবস্থান করতাে কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর এক বিরাট দল। এ থানার কুখ্যাত দালাল মওলানা নূরউদ্দিনের বাড়ি ছিল ঐ এলাকাতেই তারই নির্দেশে চলতাে রাজাকাররা লুটপাট, খুন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে এমন কোনাে অপরাধ নেই যা তারা। করেনি। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ এর বিহিত ব্যবস্থা করতে মুক্তিবাহিনীকে অনুরােধ জানায়, গৃহীত হয় পরিকল্পনা। সেই অনুসারে রমজান মাসের এক গভীর রাতে মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা বাজার আক্রমণ করতে রওনা হন। রাজাকাররা সারারাত কুকর্ম সম্পাদন করার পর তখন সুখদ্রিায় নিমগ্ন। তবে তাদের পাহারাদার ছিল।
বাঁশের লাঠি হাতে সতর্ক প্রহরায় নিযুক্ত এরা। মুক্তিবাহিনী বড়ভাঙ্গা নদী অতিক্রম করার সময় পাহারাদাররা দেখে ফেলে এবং রাজাকারদের ব্যাপারটি জানিয়ে দেয়। মুক্তিবাহিনীর আগমন সংবাদ শুনে ভীত রাজাকাররা বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা নদী অতিক্রম করে বাজারে ঢােকার আগেই এরা গা ঢাকা দেয়। তবুও জওয়ানরা ৩জন রাজাকারকে ধরতে সমর্থ হন। এরা পালাচ্ছিল। পিছন থেকে দৌড়ে তাদেরকে পাকড়াও করা হয়। ধৃত রাজাকাররা বাস্তবে ছিল নিরীহ প্রকৃতির লােক নূরউদ্দিন ও অন্য দালালেরা ভয় দেখিয়ে তাদের রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিতে বাধ্য করে। এসব জানার পর পাকিস্তানিদের আর কখনাে সহাযােগিতা না করা এবং এমন অপকর্ম না করার শর্তে এদের মুক্তি দেওয়া হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!