সুন্দিসাইল রেইড
সিলেট জেলার গােলাপগঞ্জ থানার আমুড়া ইউনিয়নের পূর্ব প্রান্তের একটি গ্রাম সুন্দিসাইল। গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ছােট হাওর এবং সমগ্র গ্রামটি টিলাময়। এ গ্রামের ২৫জন যুবক ২৫ মার্চের পর পরই ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেন। গ্রামে যারা ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা, পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তাদেরকে সরবরাহ করা ইত্যাদি কাজে ব্যাপৃত থাকেন। সুন্দিসাইলের একটি লােকও পাকিস্তানি বাহিনীর দালালি করেননি কিংবা রাজাকার, আলবদর বাহিনীতে যােগ দেননি। এ ছাড়া গ্রামটি চারদিকে হাওরবেষ্টিত ও টিলাময় হওয়ায় একদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার উপযুক্ত স্থানে পরিণত হয়। মুক্তিবাহিনীর একটির পর ১টি দল সুন্দিসাইলে প্রেরণ করে। আর তারা এখান থেকেই বিভিন্ন স্থানে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে। ২৪ অক্টোবর আমুড়া গ্রামের এক রাজাকার ইমান আলী সুন্দিসাইলে প্রবেশ করে। তার পরিচয় জানতে পারেনি কেউ। ছদ্মবেশে সে গ্রামের সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় পাকিস্তানিদের কাছে। ঐদিনও মুক্তিবাহিনীর ১টি দল সুন্দিসাইলে অবস্থান করছিল। বিভিন্ন টিলায় তারা অবস্থান করত এবং টিলার ওপর থেকে শক্রর চলাচলও প্রত্যক্ষ করা সম্ভব ছিল। এক রাতেই মুক্তিবাহিনীর বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে ৩৬জন মুক্তিযােদ্ধার আরেকটি দল রওনা হয়। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাখাওয়াত আলী এবং তাঁর সহকারী ফারুক আহমদ। পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন আফতাব আলী ও আবদুল হক। মুড়িয়া হাওরের উত্তর পাড় দিয়ে তারা কাকরদিতে ওঠেন। সেখান থেকে শীলহট দিয়ে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে ভােরে সুন্দিসাইল গ্রামে পৌছেই তারা একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কিন্তু সকাল ১০টার মধ্যেই গ্রামটি চারদিক থেকে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত হয়ে যায়।
বিয়ানীবাজার থেকে ১জন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে বিরাট ১টি বাহিনী গ্রামটির পূর্ব দিকে তরুহালের হাওরে অবস্থান গ্রহণ করে। গ্রামের উত্তর কাজিমপুরের হাওরে অবস্থান গ্রহণ করে চারখাই থেকে আগত পাকিস্তানি বাহিনী। গােলাপগঞ্জ ও সিলেট থেকে আগত পাকিস্তানি বাহিনী অগ্রসর হয় দক্ষিণে আমুড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রায় ১০টায় শুরু করে তারা আক্রমণ। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ হতে থাকে গ্রামের ওপর। এদিকে গ্রামভর্তি নিরস্ত্র জনতা বৃদ্ধ-শিশু-মহিলাসহ গ্রামবাসীর কথা চিন্তা করে মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ থেকে আপাতত বিরত থাকেন। ঘন্টা খানেক গুলিবর্ষণের পর সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে খুঁজতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের মুক্তিযােদ্ধারা ততক্ষণে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিকতা প্রত্যক্ষ করছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে হিংস্র আক্রোশবশত পাকিস্তানি বাহিনী এবার নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরতে শুরু করে। একে একে বহু বাড়িতে হানা দিয়ে সমস্ত লােকজনকে ধরে নিয়ে যায়। ধৃত ১৭জন লােককে তারা মােকামটিলায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। এক সারিতে সবাইকে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়তে উদ্যত হলে অদূরেই একটি জঙ্গলময় টিলায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযােদ্ধারা এ ঘটনার মুখে সাড়া না দিয়ে পারেননি। হঠাৎ করেই গর্জে ওঠে তাদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। শুরু হয় তুমুল লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শত্রু সংখ্যায় বেশি অস্ত্র এবং গােলাবারুদও তাদের প্রচুর। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা একটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় পাকিস্তানি বাহিনীর। ৭০-৮০টি মৃতদেহ শত্ৰু কনভয়গুলাে এখান থেকে নিয়ে যায় বলে অনেকের ধারণা এদের অধিকাংশই রাজাকার বাহিনীর সদস্য।
অন্যদিকে, ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তাঁরা হলেন দেউন্দি চা-বাগানের শ্রমিক অনীল ও বড়ধামাই চা-বাগানের শৈলেশসহ আরও একজন গুরুতর আহত হন সহকারী অধিনায়ক ফারুক আহমদ তিনি একটি উঁচু গাছের ডালে বসে শক্রদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ অবস্থায় গুলি লাগলে গাছ থেকে পড়ে মুখে গুরুতর আঘাত পান। পাকিস্তানি বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা শেষ পর্যন্ত ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে থাকেন। ৪৫ মিনিটে সারি-গােয়াইন রাস্তার ওপর টুকেরবাজার ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। এ স্থানে প্রহরারত রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে ১টি ৩০৩ রাইফেলসহ ৪জন রাজাকার আটক করা হয়। কিন্তু ফেরার পথে মুক্তিযােদ্ধা দলটি পাকিস্তানিদের অ্যামবুশের আওতায় পড়ে যায়। শত্রুর মধ্যে মিলিশিয়া বাহিনী ছিল। শত্রু সৈন্যরা চারদিক থেকে মুক্তিযােদ্ধা দলটিকে ঘিরে ফেলেছিল এ অবরুদ্ধ অবস্থায় এবং প্রচণ্ড গােলাগুলির মাঝেও অসীম সাহস, উন্নত কৌশল ও উপস্থিত বুদ্ধির জোরে মুক্তিযােদ্ধারা শবেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মিলিশিয়াদের মােট ১১জন সৈন্য মুক্তিযােদ্ধার হাতে নিহত এবং ৪জন রাজাকার আহত হয়। ভারতীয় বিএসএফ-এর ১জন সুবেদারসহ ৩জন, ১জন পুলিশের এএসইই এবং কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
ধলইয়েরগাঁও এলাকার যুদ্ধ
সিন্দ্রেগাঁও গ্রামটি সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ সড়কের কাছে অবস্থিত। কোম্পানিগঞ্জ সদর থেকে এর দূরত্ব ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি শত্রুদল ১ কোম্পানি জনবল নিয়ে কোম্পানিগঞ্জ থানার সিন্দ্রেগাঁও গ্রামে অবস্থান নেয়। আর ঐ সময় মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলেন ধলইয়েরগাঁও গ্রামে। সম্পূর্ণ গ্রামটিতে মুক্তিযােদ্ধারা চতুর্মুখী প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। কোম্পানি অধিনায়ক মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে ১৪০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। যুদ্ধের দিন ভাের ৫টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। আনুমানিক ৩-৪ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড ফায়ারের মুখে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ৪০-৪৫জন আহত হন। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্ত্র ও জনবল বৃদ্ধি করে, যার ফলে তাদের প্রচণ্ড ফায়ারের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড