কালিগঞ্জ বাজার আক্রমণ
জকিগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত কালিগঞ্জ বাজার থানা সদর থেকে ১৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। সিলেট জকিগঞ্জ সড়কের ৫৬ মাইল দীর্ঘ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। বেশ কিছু জায়গায় রাস্তার ওপর স্থাপন করেছে ছাউনিও। এসব ছাউনির কোনাে কোনােটিতে স্থায়ীভাবে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা। প্রতিটি ক্যাম্পেই তাদের সঙ্গে আছে এ দেশীয় সহযােগী রাজাকাররা। কালিগঞ্জ বাজারে ছিল এমনি একটি সেনাছাউনি। আশেপাশের গ্রামগুলাে থেকে যুবকদের ধরে এনে তাদের হাতে ১টি করে। রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে রাজাকারে পরিণত করা হয়েছে তাদের। আর এসব রাজাকারই তাদের সব কুকর্মের সহযােগী। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগসহ প্রতিটি অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হতে থাকে এদের। শেষ পর্যন্ত এরাও অভ্যস্ত হয়ে যায় এ জাতীয় অপরাধকর্মে। বাঙালির কলঙ্ক। এসব জাতিদ্রোহীকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া, রাজাকার বাহিনীতে তাদের যােগদান রােধ করা এবং সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখার জন্য প্রয়ােজন হয় একটি অপারেশনের। জালালাপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মাহবুবুর রব সাদি এ দায়িত্ব অর্পণ করেন মুক্তিযােদ্ধা আশরাফুল হকের ওপর। তিনি সংগ্রহ করেন সড়কপথ সংক্রান্ত তথ্যাদি। নির্ধারণ করেন যাতায়াতের সমস্ত রাস্তা, তারপর গঠন করেন। ১টি শক্তিশালী গ্রুপ। অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনাে একদিন ১৫২০জনের দলটি বাজারে উপস্থিত হয়ে একটি জায়গায় এসে অবস্থান নেয়। এখানে পৌছেই দলটির মূল গাইড সংগ্রহ করতে শুরু করেন তথ্যাদি।
জানা গেল, প্রতিদিন পাকিস্তানি সৈনারা এখানে এসে টহল দিয়ে যায়। টহল দেওয়ার এ সময়টায় তারা কিছুক্ষণ রাজাকারদের সাথেও কাটায়। রাজাকারদের সাহায্যে বাঙালি রমণীদের ধরে আনায় এখানে। তবে সুখের কথা, অপারেশনের ঐদিন। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে আসেনি। রাজাকাররা নিজেরাই জোর করে ধরে এনেছে কয়েকজন মহিলাকে ভােগ করছে তাদের বাংকারে নিয়ে গিয়ে। রাত ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে হানা দিয়ে পারিবারিক স্বার্থ চরিতার্থ করে ফিরে বাংকারে আসছে এসব রাজাকারদের কেউ কেউ। এদিকে একসময় মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয়। এবারে চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা। ঠিক সময় নির্দেশ এল অধিনায়কের। সাথে সাথেই চারদিকে ঘেরাও করে মুক্তিযােদ্ধারা গােলাবৃষ্টি শুরু করেন। ঝটিকা আক্রমণ প্রতিহত করার মতাে সুযােগ দেওয়া হলাে না তাদের কোনাে আত্মঘাতী প্রচেষ্টা না চালিয়ে তারা নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করল। তাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেল। ফেলে গেল ১৭টি চাইনিজ রাইফেল। ১৭টি চাইনিজ রাইফেলসহ মুক্তিযােদ্ধারা তাদের নিজেদের সাব-সেক্টরে ফিরে এলেন। এ অপারেশনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযােদ্ধা জসিম উদ্দিন, শামসুজ্জামান, বদিউদ্দিন, প্রদীপ, আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী বাবুল প্রমুখ।
সুন্দিসাইল-পশ্চিম আমুড়ার যুদ্ধ
সুন্দিসাইল-পশ্চিম আমুড়ার যুদ্ধ গােলাপগঞ্জ এলাকার মধ্যে একটি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ। সুন্দিসাইল গােলাপগঞ্জ থানা সদর থেকে ৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম আমুড়া এলাকার বিয়মাইল হাওরের পশ্চিম দিকে পাকিস্তানিদের অবস্থান ছিল। এ অবস্থানকে রেইডের মাধ্যমে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধারা বিয়মাইল হাওরের পশ্চিমে সুন্দিসাইল মােকামটিলায় অবস্থান গ্রহণ করেন। তখন ছিল অক্টোবর মাস, রােজার মাস অক্টোবরের মাঝামাঝি কোনাে এক সময় আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চিম আমুড়ায় শত্রুর অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মূলত এ অবস্থানে তারা ভাের হওয়ার পর পরই অবস্থান গ্রহণ করেন। সব দিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে আনুমানিক সকাল ৮টার সময় আক্রমণ কার্যক্রম শুরু হয়। আক্রমণের আকস্মিকতায় শত্রু বাহিনীও পাল্টা জবাব দিয়েছিল, কিন্তু তিন দিক থেকে অর্থাৎ দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ পরিচালিত হয়। এতে শত্রু বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি, তবে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে চুনু মিয়া, আব্দুল মােতালিব ও সমীর উদ্দিনসহ অনেকেই শহিদ হন।
গৌরীনগর অপারেশন
লেফটেন্যান্ট তাহের উদ্দিন আখঞ্জি ১৫ অক্টোবর ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পূর্বে নাজমুল আহসান মহিউদ্দিন আলমগীর নামে একজন অনারারী লেফটেন্যান্ট এ সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তৎকালীন বিঅ্যান্ডসি বিভাগের একজন প্রকৌশলী ছিলেন। ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের অনেক অপারেশনের মধ্যে গৌরীনগর অপারেশন। ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কোম্পানিগঞ্জ থানাধীন এ গ্রামটি সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১০ মাইল উত্তরে অবস্থিত। সেখানে পাকিস্তানিদের ১টি কোম্পানির অবস্থান ছিল এবং শত্রুদের ব্যাটালিয়ন। হেডকোয়ার্টার্স ছিল সালুটিকর বিমানবন্দরে। এখানে আঘাত হানা ও মােকাবিলার জন্য গৌরীনগর অবস্থান নেয়া উভয় পক্ষের জন্যই ছিল খুব। গুরুত্বপূর্ণ। গৌরীনগর সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ সড়কের ওপর অবস্থিত। লেফটেন্যান্ট আখঞ্জি অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গৌরীনগরে একটি অপারেশন পরিকল্পনা করেন। ১৮ অক্টোবর গৌরীনগর অভিযান শুরু হয়। ১০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে রাতের অন্ধকারে গৌরীনগর শক্রর অবস্থান আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
কিন্তু আধা মাইল কাছে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের ওপর হঠাৎ শত্রুর আক্রমণ শুরু হয়। এতে তারা হতবাক হয়ে পড়েন। তুমুল গুলিবর্ষণের ভেতর তারা যে যেখানে পারেন, অবস্থান নেন এবং শত্রুর সঙ্গে পাল্টা গুলিবিনিময় শুরু করেন। সেই সঙ্গে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে আরও মুক্তিযােদ্ধা পাঠানাের জন্য জরুরি। ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠান। ওই নতুন দলকে তাদের অবস্থান নেয়ার জন্য যখন খবর পাঠানাে হলাে, তখন রাত প্রায় ৩টা। সারারাত গুলিবিনিময় চলে। কিন্তু অন্ধকারে কেউ কাউকে পরাভূত করতে পারছিল না। এভাবে ভাের হয়ে যায় ভােরের আলােয় দেখা গেল মুক্তিযােদ্ধারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। ১০-১২জন ছাড়া কারও সংবাদ নেই তাদের অবস্থান তখন খােলা মাঠের মাঝখানে সঙ্গে সঙ্গে বর্ণি গ্রামে অবস্থানরত নতুন দলকে লেফটেন্যান্ট তাহের উদ্দিন আখঞ্জি খবর পাঠান, দ্রুত গৌরীনগর শত্রুর পিছন থেকে আক্রমণ করার জন্য তিনি এদিকে ১০-১২জনের মুক্তিযােদ্ধা দল। নিয়ে শত্রুর সাথে গুলিবিনিময় চালিয়ে গেলেন, যাতে শত্রুর দৃষ্টি তাদের দিকেই নিবদ্ধ থাকে ইতােমধ্যে তাঁর সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচজন তিনি তখন তাদের নিয়ে কাছাকাছি একটি বিলের কচুরিপানার আড়ালে আশ্রয় নেন। বেলা তখন ৩টা। তাদের দিক থেকে কোনােপ্রকার গুলির শব্দ না পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা উল্লাসভরে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসে কেউ জীবিত আছে কি না, তার সন্ধান করতে মুক্তিযােদ্ধাদের সৌভাগ্য যে শত্রুরা তাদের দেখতে পায়নি। এদিকে গৌরীনগর শত্রুর নতুন দলটির প্রায় সারাদিন লেগে যায়। সন্ধ্যার দিকে তারা গৌরীনগরে শক্রর অবস্থানের ওপর পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ অতর্কিত আক্রমণে শত্রু হতভম্ব হয়ে যায়।
গৌরীনগরে যখন নতুন দলের আক্রমণ চলছিল, তখন লেফটেন্যান্ট তাহের উদ্দিন আখঞ্জি এবং তার সাথের চার-পাঁচজন দ্রুত ঐ স্থান ত্যাগ করেন এবং নতুন দলের সাথে যােগ দেওয়ার জন্য রওনা হন। কিন্তু পথে বিলকুর গ্রামে পৌছে দেখেন, তাদের গত রাতের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলের ৮০জন মুক্তিযােদ্ধা তাদের সহযােদ্ধাদের মৃতদেহ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের দেখে তারা নতুন করে সাহস ও শক্তি পেলেন। তাড়াতাড়ি তাদের সংগঠিত করে গৌরীনগরের পিছনের দিকে দলের সাথে যােগদান না করে বর্ণিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান বর্ণিতে অবস্থানরত ৫০জন পাকিস্তানি সৈন্যের মধ্যে ১১জন এ অতর্কিত হামলায় নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। দুদিন যুদ্ধ চলার পর গৌরীনগর ও বর্ণি উভয় গ্রাম তাদের দখলে আসে। কিন্তু গৌরীনগরে পরদিন সালুটিকর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সাহায্যকারী দলের প্রচণ্ড আর্টিলারি শেলিংয়ের জন্য টিকে থাকতে পেরে সবাই বর্ণিতে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও প্রচুর আহত হয়। ২জনকে বন্দি করেন মুক্তিযােদ্ধারা তাছাড়া ৪টি বড়াে নৌকা বােঝাই এলএমজি, এসএমজি, ওয়্যারলেস সেট, গােলাবারুদ ও রসদ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। এসব মালামালসহ নৌকা ৪টি সিঙ্গার খাল নদী থেকে গৌরীনগরের পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য সিলেট থেকে পাঠানাে হয়েছিল। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে হতাহত হয়েছিলেন ১৫জন বিপদসংকুল এবং পরাজয়ের মুখােমুখি পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েও যে যুদ্ধের মােড় ঘােরানাে যায়, বিজয় নিশ্চিত করা যায়, গৌরীনগর যুদ্ধ তার দৃষ্টান্ত।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড