You dont have javascript enabled! Please enable it! কালিগঞ্জ সেতু ধ্বংস,বরজান চা-বাগান অপারেশন,বরজান চা-বাগান অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
কালিগঞ্জ সেতু ধ্বংস
জকিগঞ্জ থানার সীমান্ত এলাকার ৪ কিলােমিটার পূর্বে এবং আটগ্রাম থেকে সাড়ে চার কিলােমিটার পশ্চিমে সুরমা নদীর তীরে কালিগঞ্জ সেতু। মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে ভারতীয় শহর বদরপুরের অদূরে জালালপুরে ১টি সাবসেক্টর স্থাপিত হয়। ইকো ৪ নামের এ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা মাহবুবুর রব সাদি। এখান থেকে পরিচালিত অপারেশনগুলাের ভেতরে কালিগঞ্জ সেতু ধ্বংস এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বসারত হত্যার ঘটনা অন্যতম। কালিগঞ্জ সেতুতে অপারেশন করার পরিকল্পনা গৃহীত হয় ক্যাম্প স্থাপনের পর পরই। শুরু হয় রেকি করার কাজ, তথ্যাদি সংগ্রহ ও পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করার কাজও শেষ হয়। সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে আনুমানিক ১৫-২০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে গঠিত হয় ১টি গ্রুপ, নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুক্তিযােদ্ধা আশরাফুল। হক। তাদের লক্ষ্য কালিগঞ্জ সেতু ধ্বংস করা। কালিগঞ্জ ৫৬ মাইল দীর্ঘ সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এ সেতু ধ্বংস করা গেলে জকিগঞ্জের সাথে জেলা সদরের যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে জকিগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের অস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহও বন্ধ হয়ে যাবে। আর সে কারণে এ অপারেশনের পরিকল্পনা। সাথে তাদের ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনসহ প্রচুর বিস্ফোরক ও হালকা অস্ত্র। ক্যাম্প থেকে রওনা হয়ে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে রাত ৩টা বেজে যায়। সেতুটির দুই পাশে অসংখ্য কাঁচা-পাকা বাংকার। রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্য মিলিয়ে প্রতিটি বাংকারে অবস্থান করছে ৬-৭জন করে। এ রকম অবস্থার ভেতর দিয়েই অগ্রসর হয়ে সেতু ধ্বংস করতে হবে।
একসময় বিস্ফোরক স্থাপন করতে এগিয়ে গেলেন আবুল কাশেম রফিকুল হক, আশরাফউদ্দিন চৌধুরী বাবুল, শামসুজ্জামান, আতাউর রহমান ও জসিম উদ্দিন। আর অ্যাকশন পার্টিকে নিরাপদ করতে সেতুর দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করে ২টি কাট অব পার্টি। বিস্ফোরক স্থাপন করে সেতুটি উড়িয়ে দেওয়ার কালেই চারদিক থেকে শুরু হয় গােলাবৃষ্টি শত্রুরা তাদের প্রতিটি ছাউনি থেকে আক্রমণ রচনা করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে অগ্রসর হন। একপর্যায়ে ১জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গােলায় সামান্য আহত হন। পরদিন ভােরে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসরমাণ ১টি পাকিস্তান সামরিক জিপ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মারা যায় পাকিস্তানি বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বসারত ও ৩জন সৈন্য এ ঘটনার পর তাদের প্রতিশােধস্পৃহা চরিতার্থ করতে শত্রুরা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে পুড়িয়ে দেয় এবং মানুষজনের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন।
বরজান চা-বাগান অপারেশন
গুলনি, বরজান, কালাগুল, খাদিমনগর প্রভৃতি চা-বাগানগুলাে পাশাপাশি অবস্থিত। ডাউকি ক্যাম্প থেকে ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বরজান বাগানে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। পায়ে হেঁটে ও নৌকায় করে এতদূর এসেছে, তারা। প্রত্যেকেই বহন করছেন মাইন। নিরাপদ স্থানে অবস্থান করে প্রতি রাতে বাগান এলাকায় মাইন স্থাপন করছেন। বাগানের ভেতর স্থানে স্থানে এম-১৬ মাইন স্থাপন করে রাখছেন। আর প্রধান সড়কে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। রাতের আঁধারে রাজাকার ও পাহারাদারদের চোখকে ফাকি দিয়ে এসব কাজ করে যাচ্ছেন মুক্তিযােদ্ধারা ২ রাত অতিবাহিত হয়। প্রচুর মাইন পুতেছেন তারা। এ সময় কোনাে বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। রাজাকার কিংবা শত্রুরাও টের পায়নি মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি। অবস্থানস্থলও প্রকাশ পায়নি। তৃতীয় দিন ভােরে মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে যান নিরাপদ আবাসস্থলে এ সময় প্রচণ্ড শব্দে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। মুক্তিযােদ্ধারা শুনতে পান সে শব্দ উৎসাহিত হন তারা আনন্দে আত্মহারা হন সবাই কিন্তু আত্মগােপনে অবস্থান করছেন তারা। ঘণ্টা দুয়েক পরই সংবাদ পাওয়া গেল বিস্ফোরণ ঘটেছে বরজান বাগানের রাস্তায় এদিক দিয়ে টহল দিয়ে ফিরছিল পাকিস্তানি ১জন সেনা আফসার ও তার সঙ্গীরা ঐ রাস্তায় মুক্তিযােদ্ধারা ক্রস সিস্টেমে মাইন পুঁতে রেখেছেন। এর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয়ে মারা যায় তারা। এখানে মাইন পুঁতেছিলেন মাে. নূরুল হক ও মজিবুর রহমান।
হরিপুর আক্রমণ
সিলেট-জৈন্তাপুর সড়কের পাশেই হরিপুরের অবস্থান। জৈন্তা থানার অন্তর্গত হরিপুর সিলেট শহর থেকে ২২ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক মিলিয়ে ভারতের সংগ্রামপুঞ্জিতে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে তখন ৪ হাজার লােক । ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন মুত্তালিব চিকনাগুল এলাকায় পাকিস্তানিদের ওপর একটি অপারেশনের। পরিকল্পনা করেন। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে অপারেশনের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের ভেতর থেকে বেছে বেছে ১টি কোম্পানি গঠন করা হয় ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের নেতৃত্বে। সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে সন্ধ্যার আবছা আঁধারে রওনা হয়ে তারা আসেন তামাবিলে। তামাবিল থেকে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়িতে চিকনাগুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
যেতে যেতে পথে পড়ল খান চা-বাগান। কিছুক্ষণের জন্য এখানে যাত্রাবিরতি করা হলাে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার অগ্রসর হতে থাকে গ্রুপটি আরও একটু এগিয়ে যেতেই পড়ে কাহারগড়। স্থানটি চিকনাগুল নামেই বেশি পরিচিত। মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান তৈরির জন্য তহসিল অফিসের চারপাশে বাংকার খনন শুরু করেন। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত এ সময় খান চাবাগানের রেস্ট হাউজেই অবস্থান করছিলেন। চিকনাগুল নামক স্থানে পৌছলে। হঠাৎ করেই ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের সামনে এসে পড়ে মর্টারের একটি শেল। ল্যান্স নায়েক আব্দুল খালেকের পর্যবেক্ষণ মতে, গােলাটি বর্ষিত হয়েছে পিছন দিক থেকে অর্থাৎ তারা সামনে পিছনে উভয় দিক থেকেই আক্রান্ত সামনের দিকে সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান। আবার বিকল্প পথে পিছন দিক থেকেও তারা গােলাবর্ষণ করে চলেছে। পরে জানা যায়, ফতেহপুরের এক দালাল মদরিস আলী মুক্তিবাহিনীর আগমন সংবাদ পৌছে দেয় সালুটিকরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে। তার ফল হিসেবে মুক্তিবাহিনী কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী পশ্চিম ও পূর্ব দিক থেকেও অবরুদ্ধ হয়ে। পড়ে। এ পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব নতুন কৌশল নির্ধারণ করেন। তিনি নির্দেশ দেন, এক মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে অগ্রসর হওয়ার পর ডান দিকে ঘুরে হাওরে নামতে হবে। তারপর পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগানের গুলির আওতা। থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কিন্তু সেটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অসম্ভব। ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব এসব জানা সত্ত্বেও এগিয়ে এলেন ২জন বীর মুক্তিযােদ্ধা। এঁরা প্রত্যেকেই স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে এবং তাদের প্রাণপ্রিয়।
বাহিনীকে রক্ষা করতে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত শেষ পর্যন্ত হাবিলদার আব্দুল মালেক ও আব্দুর রবকে এ গৌরবময় কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা অবস্থান নিলেন নির্দেশমতাে নির্দিষ্ট স্থানে। ইন্টেলিজেন্সের ১জন হাবিলদার তার অধীন ১৬জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন। হলেন এবং সরাসরি সংগ্রামপুঞ্জি অভিমুখে রওনা দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রাত ৪টার সময় হরিপুরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে তাদের সবাইকে প্রাণ দিতে হয়। এদিকে মূল বাহিনীকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযােগ করে দিতে সারারাত মালেক ও রব গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখেন  অবশেষে তারা ২জনও স্বাধীনতার বেদিমূলে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করলেন। অবাধ্য ১৭জন মুক্তিযােদ্ধা চলে যাওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন মুত্তালিব সােয়া ২০০ সহযােদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে হরিপুরের হাওরে নেমে যান। এক হাঁটু কাদা-জল মাড়িয়ে ২০ মাইল পথ হেঁটে এসে ওঠেন চতুল বাজারে। ওয়্যারলেসে যােগাযােগ করা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে  আর খবর পেয়েই প্রয়ােজনীয় আহার ও অস্ত্রসামগ্রী নিয়ে ২০-৩০জন মুক্তিযােদ্ধা ১টি ট্রাকে করে চতুল বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব শক্রদের। আক্রমণের জন্য ১টি জিপে মেশিনগান স্থাপন করে ৫জন মুক্তিযােদ্ধাসহ হেমুর দিকে অগ্রসর হন।
সাথে ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং ২টি মেশিনগান। সন্ধ্যার আগেই ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের জিপ এসে পৌছায় খরিসের পুলের কাছে। এর ডান পাশের গ্রাম হেমুতে অবস্থান করছে তখন পাকিস্তানিরা। পাকিস্তানি এ দলটিই কৌশলে অ্যামবুশ পেতে ২ দফায় হত্যা করেছে ২০জন মুক্তিযােদ্ধাকে অতি দ্রুত গতিতে তখন জিপটি পুলের কাছে পৌছে দেরি না করে মুহূর্তেই পিছন দিকে ঘুরে যায়। এবারে চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে এ ফাঁকেই ৫জন মুক্তিযােদ্ধা মটারসহ নেমে যান জিপ থেকে গাছের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেন তারা। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে ৩৫জন পাকিস্তানি সৈন্যর অবস্থান ও গতিবিধি গাছতলায় মর্টার স্থাপন করেন আবু তাহের, আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল হাসেম। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মুত্তালিব পর্যবেক্ষণ শেষে নির্দেশ দিলেন ‘ফায়ার’। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে মাত্র কয়েক মিনিটের ভেতর নিক্ষিপ্ত হলাে অসংখ্য গােলা আর মুক্তিবাহিনীর নিক্ষিপ্ত এই গােলার আঘাতেই মারা যায় প্রতিটি পাকিস্তানি সৈন্য। এ যুদ্ধে হাবিলদার গােলাম রসুল, হাবিলদার আব্দুল মালেক ও হাবিলদার আব্দুর রব নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে সহযােদ্ধাদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড