চতুল অপারেশন
চতুল বাজার কানাইঘাট থানা থেকে ১০ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে কানাইঘাটদরবস্ত সড়কে অবস্থিত এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১০ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টরের সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গণবাহিনীর ১টি কোম্পানি কানাইঘাট থানার লালাখাল চা-বাগানে অবস্থান করে। স্থানীয় জনগণ তাদের জানান যে, কানাইঘাট থানার চতুল বাজারে অবস্থানকারী এক দল রাজাকার আশপাশের গ্রামগুলােয় অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শায়েস্তা করার জন্য একটি অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত হলাে, এতে অংশগ্রহণ করবে মুক্তিযােদ্ধা জয়ন্ত কুমার সেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা। পরিকল্পনা মােতাবেক চূড়ান্ত শক্র আক্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারা অবস্থান গ্রহণ করেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধারা সাথে সাথে তাদের অস্ত্রগুলাে থেকে আগুনের ফুলকি ঝরাতে শুরু করলেন। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ করে। কিন্তু তারা ১ ঘণ্টার বেশি টিকতে পারেনি। নিচুপ হয়ে যায় শক্ররা পালাতেও শুরু করে। তাদের পলায়নের আশঙ্কা করেই মুক্তিযােদ্ধারা ত্বরিত নদী পাড়ি দিতে থাকে ঘাটে বাধা নৌকায় চড়ে চটপট উঠে আসে আছারার দক্ষিণ তীরে রাজাকারদের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা পালাতে গিয়েও ৩জন ধরা পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। বন্দি হয় তারা। অন্যদের পিছু ধাওয়া করেও জীবিত ধরা সম্ভব হয়নি। তবে ২টি লাশ তারা তুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন এবং কোনােরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ রকম একটা সাফল্য নিয়ে ফিরে আসেন গন্তব্যস্থলে।
মালিগ্রাম রেইড
সিলেটের একেবারে উত্তরে কানাইঘাট থানা অবস্থিত কানাইঘাট থানা সদর থেকে ৩ মাইল উত্তর-পশ্চিমে মালিগ্রাম অবস্থিত। দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে গেছে কানাইঘাট-দরবস্ত সড়ক। কাঁচা সড়ক হলেও এর গুরুত্ব মােটেও কম নয়। কারণ থানা সদর থেকে সুরমা নদী অতিক্রম না করে জেলা শহরে প্রবেশ করার। এটাই একমাত্র রাস্তা। তাই সড়কটির স্থানে স্থানে পাকিস্তানি সৈন্য সার্বক্ষণিক প্রহরার ব্যবস্থা করেছে। মালিগ্রামের পাশেই এ সড়কের ওপর রয়েছে দুটি সেতু। একটি রাজারবন্দের সেতু, অপরটি নাপিত খালের সেতু। দুটি সেতুতেই রাজাকাররা পর্যায়ক্রমে পাহারা দিত পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায়ই রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঢুকে এ-বাড়ি ওবাড়িতে লুটতরাজ করতাে। জোর করে নিয়ে যেত গরু, ছাগল ইত্যাদি। তারপর তাদের দৃষ্টি পড়ে মহিলাদের ওপর। অনেক মা-বােন লাঞ্ছিত হন আর এসব সংবাদ সীমান্ত অতিক্রম করে পৌছে যায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এর প্রতিকার করার।
প্রণীত হয় একটি অপারেশন পরিকল্পনা স্থানীয় গণবাহিনী কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারা এ অভিযানের পরিকল্পনা করেন। ১৮ আগস্ট রাতে ২৪জন রাজাকার প্রহরা দিচ্ছে দুটি সেতু পার্শ্ববর্তী মালিগ্রামের কুতুবউদ্দিন, হাবিব আলী ও মরশ্বর আলীর বাড়িতে তখন অবস্থান। নিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রচুর গােলাবারুদ। আক্রমণের প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন, কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা আর আসছে না। অপেক্ষা তাদের সেতু প্রহরার ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা টহলে এলেই আক্রমণ করবে তারা। কিন্তু না পাকিস্তানি সৈন্যরা আর আসছে না। হয়তাে বা এ রাতে আর টহল দেবে না। তাই পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হলাে। রাজাকাররাই হলাে টার্গেট গভীর রাতে সেতু প্রহরারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধারা। রাজাকাররাও পাল্টা আক্রমণ করে। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলার পর রাজাকাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু সবাই তাে যেতে পারবে না। ততক্ষণে ২জন রাজাকারের দেহ মুক্তিযােদ্ধাদের বুলেটে নিথর হয়ে যায়। রাতের তখন শেষ প্রহর। মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে চললেন তাদের গন্তব্যপথে । সীমান্ত অতিক্রম করে পৌছে গেলেন তাদের ক্যাম্পে পরদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসে গ্রামে। ধরে নিয়ে যায় অনেক গ্রামবাসীকে। ২ দিন পর তাদের। অনেককে ছাড়লেও আনুমানিক ২৪জনকে হত্যা করে প্রতিশােধ গ্রহণ করে তারা।
তেলিবাজার সেতু ধ্বংস
সিলেট জেলার সদর থানাধীন একটি বাজারের নাম তেলিবাজার। স্থানটি সিলেট শহর থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের একটি খালের ওপর এ সেতুটি। ৪০-৫০ ফুট দীর্ঘ এ সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক যান চলাচল করে। সিলেট শহর থেকে দক্ষিণ দিকে যােগাযােগের একমাত্র পথ এ সেতুটি। তাই সিলেট শহর থেকে মৌলভীবাজার, ঢাকা বা অন্যান্য স্থানের সংযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই এটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়। তেলিবাজার সেতু অপারেশন পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমােদন পাওয়ার পর মাসিমপুর ক্যাম্প থেকে এক দল সাহসী তরুণ মুক্তিযােদ্ধাকে সেতু ধ্বংস করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের মধ্য থেকে অ্যাকশন পার্টি, সাপাের্ট পাটি, কাট অব পাটি প্রভৃতি গঠন করা হয়। প্রত্যেকে যার যার দায়িত্বও বুঝে নেন। অধিনায়কত্ব করেন মুক্তিযােদ্ধা গামা ও রফিকুল হক অন্যদের মধ্যে ছিলেন অতনু মাহমুদ খান, কাজল পাল, মিলু, ম. ই. মােক্তাদির, আজাহার আহমদ প্রমুখ। সঙ্গে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র, প্রচুর গােলাবারুদ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আর পথপ্রদর্শক ছিলেন মকসুদ ইবনে আজিজ লামা। যাত্রাকালে তাদের বিদায় জানান ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, সিলেট অঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রমুখ। সুতারকান্দি সীমানা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা দেশের ভিতর প্রবেশ করে হাওর প্রান্তর পাড়ি দিয়ে বহু কষ্টে তেলিবাজার এলাকায় এসে পৌছান। তেলিবাজারের একদিকে কাট অব পার্টি এবং অন্যদিকে সাপাের্ট পার্টি অবস্থান গ্রহণ করে। আর অ্যাকশন গ্রুপের আগে আগে সেন্ট্রি দমন গ্রুপ অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য, তারা লক্ষ্যস্থলকে নিরাপদ করবেন। সেতুর ওপর প্রহরারত রাজাকারদের তারা ধরে নিরস্ত্র করে ফেলেন।
তাদের নিকট থেকে ৪টি রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয় লক্ষ্যস্থলকে নিরাপদ করে সেন্ট্রি দমন গ্রুপ সংকেত দেওয়ার সাথে সাথেই অ্যাকশন গ্রুপ সেতুর ওপর উঠে প্লাস্টিক ডিনামাইট স্থাপন করতে লেগে যায় কিন্তু বিস্ফোরক স্থাপন করে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার আগেই অতর্কিত হামলার শিকার হয় মুক্তিবাহিনী। শত্রুর একটি বুলেটে মুক্তিযােদ্ধা কাজল পালের বুক বিদ্ধ হয়ে পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে বের হয়ে যায়। এরপরও মুক্তিযােদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটাতে সমর্থ হন ধ্বংস হয়ে যায় তেলিবাজারের সেতু। কাজল পালকে কাঁধে তুলে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়। তারপর তাকে আসামের মাছিমপুরে চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড