You dont have javascript enabled! Please enable it!
রঘুরচক রেইড
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে জকিগঞ্জ থেকে ১৫ কিলােমিটার উত্তরে একটি জায়গার নাম রঘুরচক এর পূর্ব দিকে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী সুরমা। তারপরই ভারতীয় ভূখণ্ড। নদীর তীর বরাবর ভারতীয় বাহিনীর একটি সীমান্ত ফাঁড়ি অবস্থিত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আটগ্রামে ১জন লেফটেন্যান্টের নেতৃত্বে সৈন্য তখন সেখানে অবস্থান করছে। পাশাপাশি এখানকার ডাকবাংলাে বাজার এবং বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান করছে পাকিস্তানিদের দল গ্রামের অসহায় রমণীদের জোরপূর্বক ধরে এনে তারা তাদের অবস্থানগুলাে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় হত্যা করে বহু লােককে এ ছাড়া আশপাশের এলাকাগুলােতেও সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব। এদের বিরুদ্ধে বেশ কয়টি অপারেশন করেও মুক্তিযােদ্ধারা ব্যর্থ হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উৎখাত করার জন্য জুলাই মাসের শেষ দিকে গঠিত হয় আরেকটি গ্রুপ এবার এ গ্রুপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন ন্যাপ নেতা সাইদুর রহমান খান মাহতাব, সহকারী ছিলেন ছাত্রনেতা কায়সার প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধার গ্রুপটি ২ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, গ্রেনেড ও রাইফেল ইত্যাদি অস্ত্রে সজ্জিত হয়। ১ আগস্ট সন্ধ্যায় তারা পৌছে যায় জালালপুর ক্যাম্পে এখান থেকে ছাত্রনেতা নিজামউদ্দিন আহমদ এবং আরেকজন সহকারী হিসেবে মূল দলে যােগ দেন।
এদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছিল। অবিরাম সেই বর্ষণ থামাথামির নাম নেই। পথঘাট কর্দমাক্ত মুক্তিযােদ্ধারা ভিজে জবজবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে অসুস্থ মুক্তিযােদ্ধাদের এখানে রেখে ৬০-৭০জন রাত ১০টায় নাতমপুর পৌছান। এবার সুরমা নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার কথা আগের দিন অপারেশনে এসে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সেখানে অবস্থান করছিলেন। তারাও এ গ্রুপের সঙ্গে যােগ দেন। বহু কষ্টে নৌকা জোগাড় করা হয় অস্ত্রশস্ত্রও নৌকায় ওঠানাে হয়। এবার পারাপারের পালা বৃষ্টি ঝরছিল তখনাে আকাশে গুড়গুড় শব্দ। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার সেই সাথে কনকনে ঠান্ডা। সম্পূর্ণ প্রতিকূল আবহাওয়া তবুও সুরমা পাড়ি দিতে হবে সন্তর্পণে কোনাে আলাে ব্যবহার করা যাবে না। অতি ধীরে নৌকা এগােচ্ছে বাংলাদেশের তীর বরাবর অকস্মাৎ গর্জে ওঠে শক্রদের হাতের অস্ত্র এক ঝাঁক গুলি এসে বিধে নৌকার সামনে ও পিছনে ফলে ৩৪ জন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতর আহত হন। তবুও মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটেননি লক্ষ্য স্থির করে নৌকা থেকে নেমে উঠলেন তীরে বাম দিক দিয়ে অগ্রসর হলেন সাইদুর রহমান খান, ডান দিক দিয়ে কায়সার মুহূর্তে তাঁরা দুই দিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেলেন প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আক্রমণ রচনা করা হলাে। একবার ডান তারপর বাম দিক থেকে গুলি করে ঘায়েল করা হলাে শত্রুদেরকে অদম্য সাহস নিয়ে শত্রু নিধনে অগ্রসর হতে থাকেন বশির আহমদ, সালামত আলী, জামাল উদ্দিন, আবদুস শুকুর, আবদুল খালিক, ইলকাস আলী, মােহাম্মদ কামাল, আবদুল লতিফ, নােমান আহমদ ও আমীর আলীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা কিছুক্ষণ পর আকাশ আলাে করে উঠল সূর্য কিন্তু তখন তাদের ১জন প্রিয় সহযােদ্ধা রফিক আহমদের দেহ নিথর। স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মাহুতি দিয়ে তিনি হয়েছেন শহিদ ভােরবেলা গ্রামে তার জানাজা ও দাফন হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদেরও বেশ কিছু মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ যুদ্ধের পর আর কখনাে রঘুরচরে পাকিস্তানি বাহিনী আসার সাহসও করেনি।
গােয়াইনঘাট থানা আক্রমণ
গােয়াইনঘাট সিলেট জেলার একটি থানা সিলেট থেকে ৩২ মাইল উত্তরে গােয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত থানা সদর। নদীর পশ্চিম পাড়ে বাজার ও পুলিশ স্টেশন। পূর্ব পাড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এখান থেকেই। তারা চারপাশে চালাচ্ছে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট ইত্যাদি অপর পাড়েও তারা এ পাশবিকতা প্রসারিত করার উদ্যোগ নেয়। তাদের এ উদ্যোগের সমর্থনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘনিষ্ঠ সহযােগীর ভূমিকায় স্বেচ্ছায় আবির্ভূত হয়। তার অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চললাে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে  পাল্লা দিয়ে মানুষজন তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর ১জন কুরিয়ার শওকত আলীর মাধ্যমে অত্যাচারের এ সংবাদ পৌছে যায় ডাউকি ক্যাম্পে তারপর ক্যাম্প তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশে তিনি রেকি করলেন স্থানটি। পুরাে একটি মানচিত্র তৈরি করে দেওয়ার পর শুরু হলাে পরিকল্পনা। সে অনুসারে জুলাই মাসের শেষের দিকে প্রণীত হয় একটি অপারেশন পরিকল্পনা। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাবিলদার মােশাররফ হােসেনের নেতৃত্বে ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা অপারেশনের জন্য তৈরি হন। সন্ধ্যার পর পরই খাওয়া-দাওয়া করে রওনা দিলেন তারা। পথপ্রদর্শক সেই শওকত আলী, তার বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন তাঁরা। বিশ্রাম শেষে গােয়াইন নদী ধরে এগিয়ে চললাে মুক্তিযােদ্ধাবাহী কয়েকটি নৌকা যাত্রা শেষে গভীর রাতে নৌকা এসে ভিড়ল ছাতারগাঁওয়ে এখান থেকে যেতে হবে পায়ে হেটে  দলনেতা বুঝিয়ে দিলেন প্রত্যেকের দায়িত্ব জহির আলী, খলিলুর রহমান। ও হারিস আলীর দায়িত্ব ছিল পিছন দিক দিয়ে থানায় ঢুকে সেন্ট্রিকে কাবু করা।
কিন্তু পিছন দিকের কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে তার অবস্থানের কাছে যাওয়ার আগেই সেন্ট্রি তাকে দেখে ফেলে। তাই সেন্ট্রিকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়তে হয়। গুলির শব্দ পেয়ে ১জন দারােগা তার অফিস থেকে বের হয়ে গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ইতােমধ্যে অপর পাড় থেকে তখন পাকিস্তানি সেনারা বৃষ্টির । মতাে গুলি ছুড়ছে। মুক্তিযােদ্ধারাও জবাব দিচ্ছেন সমানে। কিন্তু এ রকম গােলাবর্ষণের ভিতরেই ৩জন মুক্তিযােদ্ধা জহির, খলিল ও হারিস তাদের প্রতিরক্ষায় অটল। তারা পাকিস্তানের সহযােগী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবশেষে গ্রেফতার করেন। তাদের অন্য সহযােদ্ধারা তখন ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। কারণ, একত্র হতে হবে তাদের ছাতারগাঁওয়ে। এবারে সমূহ বিপদের ঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযােদ্ধারা কুখ্যাত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে চললেন। ভাসিয়ে দিলেন নৌকা ছাতারগীওয়ের উদেশ্যে।
টুকেরবাজার যুদ্ধ
টুকেরবাজার সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ থানার (বর্তমানে) ইসলামপুর ইউনিয়নের একটি বাজার  মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ৫ নম্বর সেক্টরের প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল এখানে অবস্থান করছিল। কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর তারা বেশ কিছু গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেছেন ইতােমধ্যে। শত্রুদের পৈশাচিক অত্যাচার থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালিকে রক্ষার দায়িত্বও পালন করেছেন তারা কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় দালালদের মাথাব্যথা শুরু হয়। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের সংবাদটা সালুটিকরে অবস্থানরত পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌছে দেয়। দেশের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের এ ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী এদিকে রাজাকার ও শান্তিকমিটির লােকজনও তাদের হীন স্বার্থে পাকিস্তানিদের সহযােগিতা করতে যায়। পাকিস্তানিদের ব্যবহৃত হবে এমন নৌকাও তারা সংগ্রহ করে। তেলিখালের আতাউর রহমান ও তার সাথী। দালালদের ছিল এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা। এদের সহযােগিতায় শক্ররা টুকেরবাজার রওনা হয়। শতাধিক নৌকায় সৈন্য ও রাজাকার ভর্তি করে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি বিরাট বহর সালুটিকর থেকে যাত্রা করে। ৬-৭ মাইল অতিক্রম করে বাজারটি ঘেরাও করতে চেষ্টা করে।
পথিমধ্যে তারা ২জন বেসামরিক লােককে হত্যা করে বাজারের পূর্ব পাশ দিয়ে ধলই নদী প্রবাহিত। ১২টার দিকে সেই নদী দিয়ে বাজারে ওঠার চেষ্টা করে তারা। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও তখন প্রস্তুত শত্রুরা পাড়ে উঠে আসার আগেই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। ফলে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাদের সবাই তখনাে তীরে উঠতে পারেনি। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে ২টি নৌকা নিয়ে পালানাের চেষ্টা করে কিছু পাকিস্তানি সেনা মূল বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে কেবল মাঝ নদীতে তাদের নৌকা ভেসেছে, অমনি গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্রগুলাে নৌকাগুলাের তলা ফেটে পানি প্রবেশ করতে থাকে দ্রুত ফলে তলিয়ে যায় নৌকাগুলাে। আরোহী শত্রু এবং তাদের এ দেশীয় দোসররাও ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ধলই নদীর অগাধ জলে কেউ কেউ কাঠের টুকরাে, নৌকার ভগ্নাংশ ইত্যাদি আঁকড়ে ধরে ভাসতে চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে এরাও পানিতে মৃত্যুবরণ করে। এ ২টি নৌকায় কয়েকজন রাজাকারও ছিল। তারা সাঁতার দিয়ে কূলে আসতে চাইলে তাদেরও প্রাণ হারাতে হয়। এরপর চলতে থাকে শত্রু নিধনের পালা নদীর উভয় তীর থেকে ঘেরাও হয়ে যায় তারা মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরােধ করার মতাে কোনাে শক্তি ও সুযােগ তাদের অবশিষ্ট নেই তাই তারা প্রাণ হাতে করে পালাতে চেষ্টা করে। যে যেদিকে পারে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রাজাকারদের পিছু পিছু পালিয়ে যায় তাদের অনেকেই এ সময় গুরুতর আহত হয়। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রায় ১০০ নৌকাই মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। ভিতরে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদও পাওয়া যায়। এ যুদ্ধের ২ দিন পর ভাটির দিকে অনেক পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের লাশ ভেসে যেতে দেখা যায়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!