You dont have javascript enabled! Please enable it! জাফলং যুদ্ধ,মুড়িয়ার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
জাফলং যুদ্ধ
১৩ জুলাই নয়াপাং নদীর তীরে মুক্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান করছিলেন। স্থানটি সিলেট জেলার গােয়াইনঘাট থানাসংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত গ্রামটি সীমানা নির্ধারণকারী রেখার কাছে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলংয়ের শােভা উপভােগ করতে প্রতিদিন আসতাে হাজার হাজার মানুষ কিন্তু যুদ্ধের জন্য সে স্থানটিও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ভূলুণ্ঠিত। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের ডাউকি ক্যাম্প থেকে ১টি গ্রুপ ভিতরে ঢুকে জাফলং গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে। এরা সবাই ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। নদীর অপর তীরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালাল আজিরউদ্দিনের বাড়ি। সেখানেই এখন আশ্রিত পাকিস্তানি সৈন্যরা দালালরাই মুক্তিবাহিনীর সংবাদ সরবরাহ করে তাদেরকে প্রতিরােধ করার কথা বলে এখানে নিয়ে এসেছে রাত ৮টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে বসে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে। তারা অমিত শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর। ২ ঘণ্টা ধরে চলে তুমুল যুদ্ধ হঠাৎ গােলাগুলি থেমে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেমন, তেমনি মুক্তিবাহিনীর ঘায়েল করার কৌশল খুঁজতে থাকে এভাবে রাত কেটে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে মুক্তিবাহিনী দ্রুত রণকৌশল নির্ধারণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে নতুন করে আক্রমণের অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু ভাের ৫টায় তারও অবসান ঘটলাে এবার অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রু আক্রমণ করে বসে মুক্তিবাহিনীর ওপর। মুক্তিযােদ্ধারাও ছিল প্রস্তুত তারাও ঘুরে দাঁড়ান মুক্তিবাহিনীর হাতে হালকা অস্ত্র হলেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তারা ঘণ্টা খানেকের ভিতরই মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারাতে হয় প্রায় ৫জন পাকিস্তানি সেনাকে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা এমনকি লাশগুলােও নিয়ে যেতে পারেনি তারা। অপরদিকে এ যুদ্ধে আহত হন ২জন মুক্তিযােদ্ধা।
মুড়িয়ার যুদ্ধ
সীমান্ত থেকে আড়াই কিলােমিটার পশ্চিমে এবং বিয়ানীবাজার থেকে ৫ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে কুশিয়ারা নদীর পাশে মুড়িয়া অবস্থিত। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। বারপুঞ্জি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক তৎকালীন ক্যাপ্টেন আবদুর রব বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড দখল করার সংকল্প ঘােষণা করেন। কোম্পানি অধিনায়ক বাবরুল হােসেন বাবুলের অধীনে ৩ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা (এফএফ) ৩জন প্লাটুন অধিনায়কের নেতৃত্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সন্ধ্যার আবছা আঁধারেই তারা সশস্ত্র হয়ে ট্রাক্টরে আরােহণ করেন। লাতুবাজারে নেমে প্রায় আড়াই মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে হেঁটে সারপার বাজারে পৌছাতে রাত ৯টা বেজে যায়। তারপর অধিনায়কের নির্দেশে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত পজিশন নিয়ে চুপচাপ থাকলেন সবাই সারপার বাজারে তখনাে শত্রুদের স্থায়ী কোনাে ক্যাম্প নেই। বিয়ানীবাজার ও লাতু বাজার থেকে এরা রাজাকারসহ টহল দিতে আসতাে সারপারে বিয়ানীবাজার থেকে এখানে আসতে হলে আভঙ্গি, তাজপুর কিংবা দুবাগ হয়ে বিরাট মুড়িয়া হাওর পাড়ি দিতে হয়। পরে লাতু বাজার থেকেও সােনাই নদী অতিক্রম করে আসতে হবে। তাই সারপার এলাকা দখলে রাখতে হলে এ রাস্তাগুলাের কর্তৃত্ব কায়েম করতে হবে। বিনা বাধায় যেভাবে সারপার, নয়াগ্রাম, বাড়ুদা, আভঙ্গি, ঠেকইকোনাে, তাজপুর প্রভৃতি ৫ বর্গমাইল এলাকা দখলে চলে আসে, সেভাবে কিন্তু এখানকার দখল বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না, এটা বােঝা যায়। ফলে বিভিন্ন প্লটুনকে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে হয়। 
পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। মুড়িয়া হাওরের দক্ষিণ পাড় দিয়ে শত্রুপক্ষের আগমন ঠেকানাের জন্য তাজপুর। গ্রামে ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান নেন। প্লাটুনের অধিনায়ক ছিলেন মতিউর রহমান উত্তর দিকে দুবাগ এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাতু থেকে আক্রমণ ঠেকানাের জন্যও ভিন্ন প্লাটুন মােতায়েন করা হয়। দখলিকৃত এলাকায় পুতে রাখা হয় অসংখ্য মাইন পাকিস্তানি বাহিনীও বসে থাকেনি। সারপার পুনরায় দখলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা আক্রমণ রচনা করে বিভিন্ন দিক মুক্তিযােদ্ধারা প্রথম রাতেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে কোদাল সংগ্রহ করে এলাকায় খনন করেন অনেক পরিখা কিছু কিছু বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন তাঁরা। বাংকারগুলাে তখন বৃষ্টির পানিতে ভর্তি পানিতে থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করছেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে কোনাে মুক্তিযােদ্ধাই জানতেন না কোথায়, কীভাবে কত দিন থাকতে হবে তাই খাদ্য, বস্ত্র কিংবা অস্ত্র পর্যাপ্ত পরিমাণ ছিল না। এক বস্ত্রে, অনাহারে থেকেও হালকা অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মােকাবিলা করতে থাকেন তারা, অথচ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্র। ২ দিন পর কিছু কিছু কাপড় ও গােলাবারুদ জোগান দেওয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তখন লাতু থেকে গােয়ালী এসে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করতাে মুড়িয়া হাওরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে বিয়ানীবাজার থেকে অগ্রসর হয়ে কোনগ্রাম থেকে অন্য ১টি বাহিনী আক্রমণ রচনা করতাে।
প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। প্রায় সারারাত চলত গােলাগুলি দিনের পর দিন অনাহারে-অদ্রিায় ও কাদা-পানিতে থেকে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেও মুক্তিযােদ্ধারা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। অপরপক্ষে প্রতিদিনই শক্তি বৃদ্ধি করছে পাকিস্তানি সেনারা। আসছে নতুন নতুন অস্ত্রের চালান একপর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল কমতে থাকে। এ অবস্থায় একদিন তাজপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ১জন যুবক বেপরােয়া এলএমজি চালাচ্ছিলেন ফলে অপরদিক থেকে ভারী মেশিনগানের গুলি তাকেই লক্ষ্য করে আসতে থাকে। তখনই দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এলএমজিটি বন্ধ হয়ে যায়। বহু চেষ্টা করেও এলএমজিটি খুলতে পারা যাচ্ছিল না। এ সময় একটি গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায় সাথে সাথেই তিনি শাহাদতবরণ করেন। পরে গ্রামবাসীর সহযােগিতায় তাজপুরের উত্তর দিকের গােরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এখানে দীর্ঘ ১৪ দিন পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার পর মুক্তিযােদ্ধারা হতাশায় ভেঙে পড়েন। বিপুল অস্ত্রসজ্জিত শত্রুদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা লাগাতার যুদ্ধের এ পর্যায়ে একেবারেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে অবস্থান ছেড়ে তারা পিছু হটতে থাকেন। উত্তর দিকে অবস্থান নেয়া মুক্তিযােদ্ধারাও তখন চলে গেছে। শত্রু সেনা সে সুযােগে ২ ভাগ হয়ে সারপার পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
এ সময় শত্রু ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করে। সারপার বাজারে মুক্তিবাহিনীর ব্যবহারের জন্য স্থাপিত টেলিফোন মারফত তারা চতুরতার সাথে ভারতের কাছ থেকে সাহায্য চান সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় অধিনায়করা মুক্তিবাহিনীর আবেদন মনে করে তাদের কথামতাে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। শুরু হয় বিপর্যয়। চারদিকে থেকে আক্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকে তারা। প্রাণ রক্ষা করতে হবে কোনােক্রমে তাজপুরে অবস্থানরত প্লাটুন অধিনায়ক মতিউর রহমান ও আবদুর রহমান অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। তখন শত শত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার অগ্রসর হচ্ছে। তাদের অনেকেই হতাহত হতে থাকে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে একা মতিউর রহমানের গুলিতেই নিহত হয় প্রায় ৭জন পাকিস্তানি সেনা হাওরের কাদা-পানি অতিক্রম করে মুক্তিযােদ্ধারা ছুটে যান সারপার বাজারের দিকে অন্যদিকে, নিরস্ত্র মানুষের ঢল নামে তারা ছুটছে আশ্রয়ের খোজে তারা তখনাে জানতাে না যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাজারে অবস্থান নিয়েছে। গুলি বর্ষিত হতে থাকে ঐ মিছিলের ওপরও অবশেষে এক বৃদ্ধ প্রাণপণে ছুটে এসে এ সংবাদ জানান। মুক্তিযােদ্ধারা টেকইকোনা হয়ে ভারতের দিকে এগােতে থাকেন। এ সময় সেই বৃদ্ধও গুলিবিদ্ধ হন। আর মুক্তিবাহিনী আক্রান্ত হয় ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে নিক্ষিপ্ত মর্টারের গুলিতে। তারপর বহু কষ্টে সাঁতরে নদী পার হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে তারা পৌছে এ যুদ্ধে দুই পক্ষের তরফের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড