টুকেরবাজার ও দক্ষিণ বুড়দেওয়ের যুদ্ধ
বর্তমান কোম্পানিগঞ্জ থানা সদর (১৯৭১ সালে ছাতক থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল) সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। জুন মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী কোম্পানিগঞ্জ থানার লামাডেক্সি গ্রামের হাজি মােকদ্দর আলীর বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। শত্রুরা তাদের ক্যাম্প থেকে টুকেরবাজারের দিকে রওনা দেয় গ্রামের সাধারণ মানুষকে ধরে আনার জন্য। আর এ খবর পেয়ে ভােলাগঞ্জে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে গণবাহিনী কোম্পানি অধিনায়ক ইয়ামীন চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩৫জনের ১টি দল বিকাল ৪টার দিকে টুকেরবাজারের দিকে রওনা হয়। ঐ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি দল ঐ গ্রামের কিছু বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। টুকেরবাজারে পৌছে মুক্তিযােদ্ধারা উত্তর দিক থেকে ২ ভাগে ভাগ হয়ে শত্রুদের ওপর প্রচণ্ডরূপে ফায়ার করেন। এতে শত্রুরা টিকতে না পেরে টুকেরবাজার থেকে রবিউল্লাহ, মনা মিয়া ও তাহের মিয়াকে ধরে নিয়ে ধলই নদী দিয়ে পালাতে থাকে। কিন্তু নদীর পাড় থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড গুলিতে তারা শেষ পর্যন্ত ঐ ৩ জনকে বুড়দেও এলাকায় ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে টুকেরবাজারের ১জন সাধারণ লােক শহিদ হন।
জৈন্তাপুর অপারেশন
জৈন্তাপুর সিলেট থেকে ৪০ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে সিলেট-তামাবিল সড়কে অবস্থিত। জুলাই মাসের ৮ তারিখ ডাউকি ক্যাম্প থেকে মুক্তিযােদ্ধারা সিলেট তামাবিল সড়কে অবস্থিত জৈন্তাপুরে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব ও ছাত্র অধিনায়ক জয়ন্ত কুমার সেনের যৌথ নেতৃত্বে অপারেশন পরিচালনা করেন। বেশ আগে থেকেই এ অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী জৈন্তাপুর অপারেশন পরিকল্পনায় সহায়তা করে অবশেষে ৭ জুলাই শেষ রাতে ডাউকি থেকে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল রওনা হয়। ভােরবেলা এসে তারা অবস্থান গ্রহণ করে জৈন্তাপুরের আশপাশে তারপর সুবিধামতাে পরিচালনা করা হয় আক্রমণ অতর্কিত আক্রমণে হতভম্ব হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরােধ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সামনে বারবার নাজেহাল হতে থাকে তারা এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তের ওপার থেকে মর্টারের গােলাবর্ষণ দ্বারা সাহায্য করে। ফলে যুদ্ধের পুরাে পরিস্থিতিটাই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে চলে আসে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য এখানে নিহত হয়। জৈন্তাপুর যুদ্ধে ক্যাপটেন মুত্তালিব আহত হন। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলংয়ে।
সারি নদীর সেতু ধ্বংস
সিলেট-তামাবিল-শিলং সড়কের বুক চিরে সারি নদী প্রবহমান। ডাউকি মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে তখন শত শত মুক্তিযােদ্ধা। ডাউকি থেকে সড়কপথে সিলেটের সাথে যােগাযােগের একমাত্র বাহন সিলেট-তামাবিল-শিলং সড়ক। পথে সারিঘাট। সারি নদীর ওপর অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। সিলেট শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলােমিটার। সাবেক জৈন্তা রাজ্যের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করছে সারি নদীর ওপর অবস্থিত এ সেতু। সেতুটি উড়িয়ে দিলে জৈন্তা, গােয়াইনঘাট ও কানাইঘাটের এক বিরাট অংশ দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র, গােলাবারুদ, রসদ ও সৈন্য প্রেরণ ব্যাহত হবে, ভেঙে যাবে তাদের মনােবল এবং মুক্তিবাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কেও লাভ করবে তারা সম্যক ধারণা তাই একটি অপারেশন পরিকল্পনার কথা চিন্তা করেন ডাউকিতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা। সারি নদীর অপারেশন সফল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সেতু ধ্বংসের জন্য গঠিত হয় ১টি দল। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এতে নেতৃত্ব দেন। সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কাট অব পার্টি এবং প্রয়ােজনে সাহায্য করতে রিজার্ভ পাটিও প্রস্তুত থাকে। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ছিল অতি সাধারণ এসএমজি, রাইফেল, গ্রেনেড, বেয়নেট আর বিস্ফোরক। আর এমনই অপর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনী সদস্যরা নৌকায় চড়ে বসেন। সন্ধ্যার পর পরই রওনা দেন তাঁরা। বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথে কখনাে নদী হয়ে, কখনাে হাওর দিয়ে, কখনাে আবার লােকালয়ের পাশ ঘেঁষে।
আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এ রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিতরই একসময় সারি সেতুর কাছে পৌছে যায় তারা। ১০ জুলাই রাত তখন প্রায় ১২টা। সেতুটির এক পাশে কয়েকজন রাজাকার নিযুক্ত ছিল সেতু প্রহরার কাজে কিছুক্ষণ পর পরই পাকিস্তানিরা তাদের টহল দিয়ে যায় হয়তাে কিছুক্ষণ আগেও টহল দিয়ে চলে গেছে জৈন্তা অভিমুখে সম্ভবত তারা ফিরে আসবে অল্পক্ষণের ভেতরই সুতরাং ত্বরিত কাজ সমাধা করতে হবে প্রতিটি গ্রুপ স্ব স্ব দায়িত্বে নিয়ােজিত হলাে অতি দ্রুত গােপনে অ্যাকশন পার্টি স্থাপন করল বিস্ফোরক দ্রব্য রাজাকাররা এর কিছুই টের পেল না বিস্ফোরক দ্রব্য স্থাপন করার পর মুক্তিযােদ্ধারা এবারে চলে যান নিরাপদ দূরত্বে সেখান থেকে অগ্নিসংযােগ করতেই বিধ্বস্ত হলাে সারি নদীর সেতু। মুক্তিযােদ্ধারাও নিরাপদ দূরত্বে সুতরাং একটি গুলিও ব্যয় করে নির্বিঘ্নে অপারেশন সমাপ্ত হলাে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড