You dont have javascript enabled! Please enable it! গােলাপগঞ্জ খাদ্য গুদাম দখল,বইটিকর অ্যামবুশ, সুতারকান্দির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
গােলাপগঞ্জ খাদ্য গুদাম দখল
সিলেট শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত গােলাপগঞ্জ সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা। এর উত্তর-পশ্চিমে সুরমা নদী আর দক্ষিণ-পূর্বে কুশিয়ারা নদী প্রবাহিত। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধাদের আহার জোগানাের জন্য সংগঠকরা গােলাপগঞ্জ খাদ্য গুদাম থেকে খাদ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সংগঠকরা অনেকেই নিজ নিজ গােলা থেকে চাল সরবরাহ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রণয়ন করা হলাে খাদ্য সংগ্রহের বাস্তব পরিকল্পনা সিদ্ধান্ত হলাে, গােলাপগঞ্জ খাদ্য গুদামে অপারেশন পরিচালনা করার। আর সে অনুযায়ী সে সময়কার ন্যাপ নেতা কফিলউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১টি দল গেল গুদাম আক্রমণে কিন্তু বেশি বেগ পেতে হলাে না। গুদামরক্ষক নিজেই চাবি হস্তান্তর করে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। তারপর ৪ ট্রাক চাল ভর্তি করে নিয়ে আসা হলাে কফিলউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে। এখান থেকেই পরে প্রয়ােজনে চাল সরবরাহ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে।
বইটিকর অ্যামবুশ
বইটিকর বাজার সিলেট জেলার গােলাপগঞ্জ থানাধীন একটি ছােটো বাজার। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন আজিজ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি (‘সি’ কোম্পানি) নিয়ে কুলাউড়া-শেওলা-সুতারকান্দি-গােলাপগঞ্জ অতিক্রম করে শহর অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। গােলাপগঞ্জ থানা সদরকে পিছনে রেখে আরও একটু সামনে এগিয়ে আসেন তিনি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৮ মাইল দূরে বইটিকরে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাস্তার উত্তর পাশে প্রবাহিত হচ্ছে স্রোতস্বিনী সুরমা দক্ষিণে ফুলবাড়ি মাদ্রাসা। সড়কের সাথেই বইটিকর প্রাথমিক বিদ্যালয় এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে সাময়িকভাবে মার খেয়ে সিলেট শহরে অবস্থান নেয়ার পর অবস্থান সংহত করে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এপ্রিল মাসের মধ্যেই তারা বিভিন্ন সীমান্ত ফাড়ি দখল করে নেয়ার পর জকিগঞ্জ সড়ক ধরে অগ্রসর হয় মুক্তিবাহিনীকে মােকাবিলা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে এগােতে থাকে তারা সুরমার উভয় পার থেকে একযােগে তারা ভারী অস্ত্রসহ আক্রমণ চালায় বইটিকরের ওপর। পাকিস্তানি বাহিনীর এ অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালায় মুক্তিযােদ্ধারা বলা যায়, এটি ছিল তাদের মরিয়া পাল্টা আক্রমণ অভিযান কিন্তু হালকা অস্ত্র এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণের অভাবের ফলে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ৫ ঘণ্টার বেশি সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেননি। পিছু হটে যেতে বাধ্য হন তারা পাকিস্তানি বাহিনী গােলাপগঞ্জ পর্যন্ত এগিয়ে পুনরায় পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে অন্যদের সাথে সাহসী ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযােদ্ধা তােতা মিয়া, রসিব আলী, শামসুদ্দিন, আরমান আলী, শামসুল হুদা, আলতাফ মিয়া, শফিক আহমদ, আব্দুস সামাদ, আবুল কালাম, হারুন, সৈয়দ মােস্তফা কামাল ও আব্দুল জব্বার।
সুতারকান্দির যুদ্ধ
চরখাই-শেওলা-জকিগঞ্জ সড়ক এবং জকিগঞ্জ থেকে ১২ কিলােমিটার পশ্চিমে বিয়ানীবাজার থানায় সুতারকান্দি অবস্থিত। ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর। প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিল গােলাপগঞ্জে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তা সরিয়ে নিতে হয় বড়গ্রাম বিওপিতে। গড়ে ওঠে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান। শেওলাঘাট দিয়ে কুশিয়ারা নদী অতিক্রমকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার একটি পরিকল্পনা ছিল মুক্তিবাহিনীর। বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ তখনাে মুক্ত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি দল এসে শেওলা ফেরিঘাটে অবস্থান নেয়। বিয়ানীবাজার থানায় এ ফেরিঘাট অবস্থিত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রব বড়গ্রাম থেকে মাঝেমধ্যে তাঁর দলবল নিয়ে শেওলায়। অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলেও বড়াে ধরনের কোনাে সংঘর্ষ হয়নি। এ অবস্থায় ২৯ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুশিয়ারা নদী। অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকে ধীরে ধীরে। তারা তখন মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কেও অবগত। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২টি কোম্পানি নিয়ে এগিয়ে আসে ক্যাপ্টেন রবও মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে প্রস্তুত শত্রুরা তাদের অস্ত্রের পাল্লার ভেতরে আসামাত্র ক্যাপ্টেন রব মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি ছােড়ার নির্দেশ দেন। 
গুলিতে বাধাপ্রাপ্ত হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা কিন্তু অল্পক্ষণ পরই তারা আর্টিলারি এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানিদের ১ কোম্পানি সুতারকান্দি এবং অপর কোম্পানি বড়গ্রাম আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ছিল অপেক্ষাকৃত কম তাঁদের সদস্য সংখ্যা ১ কোম্পানির মতাে ঐ শক্তি নিয়েই তারা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিকল্পিত আক্রমণ রচনা করেন। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যদের বেশকিছু হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনী দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখে মাত্র ১টি এলএমজি দিয়ে। পাকিস্তানি বাহিনী সকাল সাড়ে ৭টায়। ডান দিক থেকে শক্তিশালী আক্রমণ রচনা করে সকাল ১০টা পর্যন্ত বীরত্বের সাথে সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে যায় মুক্তিবাহিনী তারপর গােলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে আসে তাদের কোনাে দিক থেকে সাহায্যও আসেনি। তাই দুপুর ১২টার দিকে পিছু হটতে শুরু করে মুক্তিবাহিনী এতৎসত্ত্বেও সুতারকান্দির যুদ্ধে মারা যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের আনুমানিক ৩৯জন সদস্য এবং বন্দি হয় ২জন। অপরদিকে শত্রুদের হাতে ধরা পড়েন ২জন মুক্তিযােদ্ধা আর আহত হন কয়েকজন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড