গােটাটিকর আক্রমণ
সিলেট সদরের অন্তর্গত গােটাটিকর গ্রামটি সুরমা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত। তেলিয়াপাড়া থেকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ ‘সি’। কোম্পানি নিয়ে ৪ এপ্রিল গােটাটিকর পৌছান। ৫ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী সিলেট শহর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এখান থেকে তারা সুরমা নদীর। দক্ষিণ তীরে গােটাটিকরে পৌঁছান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ প্রভৃতি বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত এ বাহিনীর সাথে যােগ দেন। স্থানীয় রাজনীতিক, ছাত্র ও যুবকেরাও। এঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন জেলা। ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক আব্দুল খালিক, ন্যাপ নেতা সাইদুর রহমান খান। মাহতাব ও আবুল খায়ের চোধুরী, কাকরদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসকর আলী, ছাত্রলীগ নেতা নূরুল ইসলাম সােহাগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। আব্দুল খালেক, যুবনেতা শফিকুল হক প্রমুখ। নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান গ্রহণ করার পর ক্যাপ্টেন আজিজ রেকি করলেন। পুরাে এলাকা। তৈরি করলেন তার রণ পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে সহযােগিতা করলেন তার অন্য সহকর্মীরাও এ সময় কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাকে গােপনে। শহরে পাঠানাে হয়। উদ্দেশ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আসা। এরপর কৌশলগত প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলে বাংকার খনন করার কাজ শুরু হয়। এ কাজে লেগে যায় ২ দিন। যাবতীয় কাজ অগ্রসর হচ্ছিল। পরিকল্পনামাফিক। অবশেষে নির্ধারণ করা হয় আক্রমণের দিনক্ষণ। ৭ এপ্রিল অধিনায়কের নির্দেশ এল শুরু হলাে আক্রমণ অভিযান। নদীর অপর পাড় থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও শুরু করে পাল্টা আক্রমণ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু এরপর তারা নিজেদের আরও বলীয়ান করে তােলার লক্ষ্যে সমাবেশ ঘটায় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের। পরিচালনা করে পাল্টা আক্রমণ। তারপর ২ দিন ধরে চলে। সুরমার উভয় তীর থেকে গুলি ও পাল্টা গুলি, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ। একসময় পাকিস্তানিরা বিপর্যস্ত হয়ে সালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে।
খাদিমনগর চা-বাগান রেইড
খাদিমনগর সিলেট জেলা সদরের অন্তর্গত সিলেট-তামাবিল সড়ক থেকে প্রায় ১ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলেট শহর থেকে ৫ মাইল দূরে এ চা-বাগান। বাগানের ব্যবস্থাপক আজিজ আহমেদ একজন অবাঙালি। বাংলাদেশ ও বাঙালি। বিরােধী এ লােক। ২৫ মার্চের পর সে অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ অপরাধকর্মে আজিজ ছিল সক্রিয়। তার তৎপরতায় খাদিমনগর চা-বাগানের দুই স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়। অনেক মহিলা শ্রমিক তাদের সম্ভ্রম হারিয়ে সিলেট ছেড়ে চলে যান বহু দূরে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘনিষ্ঠ সহযােগী বাগানময় ঘুরে ঘুরে কর্মকর্তা-কর্মচারী আর শ্রমিকদের ভীতি প্রদর্শন করতাে। পাকিস্তানের সংহতি বিরােধী কাজের পরিণতি সম্পর্কে অবহিত করতাে। কিন্তু নিজের বাংলােয় সে রাত কাটাতাে না। অন্যান্য অবাঙালিকে নিয়ে লাক্কাতুরা চা-বাগানে গিয়ে ঘুমাতাে তাই পাকিস্তানি বাহিনীর এ দোসরকে শায়েস্তা করার লক্ষ্যেই মুক্তিবাহিনী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। হাবিলদার খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এ দলটি বাগানে ঢুকেই গােপন যােগাযােগ করে একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির সাথে তিনি হলেন তমাল কান্তি নার্গ (কাঞ্চন)। তাঁর কাছ থেকেই সংগৃহীত হলাে গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় তথ্য। আজিজ আহম্মদ তখন তার বাংলােয়। সাথে লাক্কাতুরা চা-বাগানের অবাঙালি ব্যবস্থাপক। খাদিমনগর চা-বাগানের টিলা অফিসে অবস্থান করছে অবাঙালি চিফ মেডিক্যাল অফিসার।
এরা সবাই শত্রুদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী। হজরত শাহপরানের (র.) মাজারের অদূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে অবস্থিত এ বাগানের ভেতর মুক্তিযােদ্ধারা ২টি দলে বিভক্ত হন। হাবিলদার খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে ৩জনের ১টি দল ব্যবস্থাপকের বাংলােয় অবস্থান নেওার আগেই আজিজ ও তার সঙ্গী লাক্কাতুরায় পালিয়ে যায়। অন্য দলটি ততক্ষণে টিলা অফিস ঘেরাও করে কুখ্যাত মেডিক্যাল অফিসার ও ১জন পাঞ্জাবি চৌকিদারকে হত্যা করে নিরাপদে চলে আসে একই সময় পার্শ্ববর্তী দত্ত গ্রামের বাসিন্দারা অপর ১জন পাঞ্জাবি চৌকিদারকে ধাওয়া করে বাগানের মাঠের ভেতরকার একটি পুকুরে ফেলে লাঠিপেটা করে। তারও মৃত্যু হয় ঐ পুকুরের পানিতে সকাল ১০টার মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন সফল করে ফিরে যান। এ অপারেশনে তাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
সালুটিকর বিমানবন্দর রানওয়ে হামলা
সিলেট শহর থেকে উত্তরে ৬ কিলােমিটার দূরে সালুটিকর বিমানবন্দর অবস্থিত। ৭ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধারা সালুটিকর ছাড়া সমগ্র সিলেট শহর দখল করেন। সিলেট শহরের প্রায় ৮ কিলােমিটার পূর্বে খাদিমনগরে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল অবস্থান করছিল। ১০ এপ্রিল সালুটিকর থেকে এসে একই সাথে স্থল ও বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারা স্থল থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্য করে ৩ ইঞ্চি। মর্টার ব্যবহার করে। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করে বােমা। এত ভারী অস্ত্রের জবাব দেওয়া মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ, তাদের হাতে শক্তিশালী ও ভারী অস্ত্র ছিল না। এ রকম অবস্থায় পিছু হটা ছাড়া কোনাে গত্যন্তর ছিল না। মুক্তিযােদ্ধারা খাদিমনগর ছেড়ে প্রতিরক্ষাব্যুই রচনা করেন হরিপুরে এসে। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআর-এর সুবেদার বি আর চৌধুরী। সাথে নায়েক মােশাররফ হােসেন। শত্রুরা ইতােমধ্যে তাদের শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধি করে কয়েকগুণ। আর এ শক্তিবৃদ্ধির নেপথ্যের প্রধান মাধ্যম হয়ে। দাঁড়ায় সিলেট সালুটিকর বিমানবন্দর। বিমানে করে তারা বর্ধিত সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে এসে শক্তি বৃদ্ধি করে। তাই বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন মুক্তিযােদ্ধারা। ফলে শুরু হলাে প্রস্তুতি। দায়িত্ব গ্রহণ। করলেন হাবিলদার আব্দুল ওয়াহিদ ও নায়েক হাফিজউল্লাহ চৌধুরী। এ ২ সৈনিকের ২জনের নিয়ন্ত্রণে তখন ১টি মেশিনগান এবং অপরজনের অধীনে। মর্টার। ১৯ এপ্রিল রাতে মুক্তিবাহিনী আঘাত হানে সিলেট সালুটিকর। বিমানবন্দরের ওপর। রাতভর চলে গােলাবর্ষণ আর এ গােলাবর্ষণে গুরুতর। ক্ষয়ক্ষতি হয় রানওয়ের। সফল অভিযান শেষে রাতের দিকে মুক্তিবাহিনী ফিরে আসে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড