সিলেট টিবি হাসপাতাল আক্রমণ
সিলেট পৌরসভায় সিলেট টিবি হাসপাতালটি এমসি কলেজ থেকে ২ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। ২৫ মার্চের পর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য সিলেট শহর সংলগ্ন টিবি হাসপাতালে অবস্থান গ্রহণ করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার নূরুল হক, ইপিআর বাহিনীর নায়েব সুবেদার গােলাম হােসেন, নায়েব সুবেদার মােখলেসুর রহমান, হাবিলদার ওয়াহিদুল ইসলাম, হাবিলদার নূরুল ইসলাম ও হাবিলদার হাফিজউল্লা চৌধুরী একটি অপারেশন পরিচালনা করেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লড়াই হয়। উভয় পক্ষের সাধিত হয়। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের। ফলে তারা পালিয়ে যায় সালুটিকরের দিকে। মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নেন টিবি হাসপাতাল।
দুরবস্ত খাদ্য গুদাম আক্রমণ
সিলেট-তামাবিল সড়কেই দরবস্ত খাদ্য গুদাম অবস্থিত। সিলেট শহর থেকে দরবস্তের দূরত্ব উত্তর-পূর্বে ৪০ কিলােমিটার। ভারতের ডাউকি এলাকায় ৩১ মার্চ পর্যন্ত কয়েক হাজার শরণার্থী পৌছে যায়। মাথা গোঁজার জায়গা পেলেও তখনাে পর্যন্ত তাদের আহারের সংস্থান হয়নি। গভীর অনিশ্চিত অবস্থার ভিতরে তারা তখন। স্থানীয় নেতারাও চিন্তিত। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা আব্দুস সালাম জানান, দরবস্ত খাদ্য গুদামে প্রচুর খাদ্য মজুদ রয়েছে। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। ইপিআর বাহিনীর ১টি দল নিয়ে চলে গেলেন দরবস্ত খাদ্য গুদামে। সংগ্রহ করলেন এক ট্রাক চাল। রাস্তার বিভিন্ন দোকান থেকে আরও সংগ্রহ করলেন তেল, ডাল, নুন ইত্যাদি। কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও এসব সামগ্রী দান করেন। ৪ এপ্রিল আবার এলেন তারা খাদ্যের সন্ধানে। সাথে তাদের ৩টি ট্রাক। ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের সাথে ৩০জন ইপিআর। দরবস্ত খাদ্য গুদাম তখন ঘিরে রেখেছে স্থানীয় কিছু লােক। তারা চাল নিতে দেবে না। উত্তেজিত মানুষজনকে বােঝানাে সম্ভব হলাে না। এক দল পীড়িত ও দুস্থ মানুষ বাঁচানাের জন্যই যে খাদ্য নেয়া দরকার, সেটা তারা বুঝতে রাজি নয়। সে এক অসম্ভব উত্তেজনাকর এবং উভয় সংকট অবস্থা।
কিন্তু ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এ অবস্থার দ্রুত নিরসন চেয়ে গুদাম ঘিরে রাখা লােকজনকে সরে যেতে বললেন। গুলি করারও হুমকি দিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে শুরু করলেন ফাকা গুলিবর্ষণ। এবারে ফল হলাে। কিন্তু গুদাম রক্ষককে পাওয়া গেল না। অবশেষে একটি ছােটো ছেলের দেওয়া তথ্য অনুসারে একটি গােপন জায়গা থেকে ধরে আনা হয় তাকে। ৫জন ইপিআর তাকে ধরে নিয়ে এল । কিন্তু গুদামরক্ষক চাবি দিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে চাবি নিতে হলাে। চাবি পাওয়ার পর খােলা হলাে গুদাম। তারপর ৩ ট্রিপে ৯ ট্রাক চাল ও চিনি নিয়ে আসা হয় সংগ্রামপুঞ্জিতে। ফেরার সময় গুদামে তালা দিয়ে গুদামরক্ষককে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করতে না পারে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনাে দরবস্ত পৌছেনি। তাই নিরাপদে বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল মুক্তিবাহিনী, যার খুবই প্রয়ােজন ছিল শরণার্থী দুস্থ লােকজনের জন্য।
সিলেট কারাগার আক্রমণ
সিলেট কারাগারটি সিলেট জেলা সদরের অন্তর্গত। ৫ এপ্রিল ভােরবেলা। সিলেট শহর তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পুরােপুরি দখলে। সমস্ত শহরে তারা চালিয়েছে ভয়াবহ নৃশংসতা। নারকীয় উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে তারা। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারাও বসে নেই। শেরপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে মৌলভীবাজার থেকে ১টি বাহিনী। হরিপুরের দিকে সংগঠিত হলাে ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের দল। সংখ্যায় তারা ২১জন। অন্যান্য উল্লেখযােগ্য মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন আবুল কাশেম ও আব্দুল হাই প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধারা প্রত্যুষে রওনা দেন হরিপুর থেকে। সাথে প্রচুর বিস্ফোরক, সেফটি ফিউজ, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৭টি মেশিনগান এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়ি তীব্র বেগে ছুটছে শহরের দিকে। তখনাে আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা ফুটে উঠেনি। শহরের ৫ মাইল পূর্বে হজরত শাহ পরান। (র.)-এর মাজারের পাশে খাদিমনগর। এখান থেকে ১১জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের ধােপাদিঘির পাড়ে। নাইওরপুলে অবস্থান গ্রহণ করার নির্দেশ লাভ করেন তাঁরা। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মুত্তালিব বাকি ২জন মুক্তিযােদ্ধাসহ জিপে চড়ে গেলেন কালাগুলের দিকে। তারপর পায়ে হেঁটে বরজান চা-বাগানে। সেখানেই একটা সুবিধামতাে জায়গায় সমবেত হলেন তারা। আবুল কাশেম স্থাপন করলেন ৩ ইঞ্চি মটার। তাদের এখানকার প্রধানতম টার্গেট বিমানবন্দর। ওখানে রয়েছে ৪ হাজার গ্যালন। ধারণক্ষমতাসম্পন্ন তেলের ট্যাংকার।
এ ট্যাংকার থেকেই পাকিস্তানি বােমারু বিমানগুলাের জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। তাই ট্যাংকার ধ্বংস করে বিমান। হামলার আশঙ্কা কমানাে এবং শহরের সব জায়গা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের এ মুহূর্তে বিমানবন্দরে জড়াে করাই এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। আর তা হলেই শহরে একটি অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব হবে। সিলেট জেলা কারাগারে তখনাে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ শত শত লােক বন্দি। ২৫ মার্চের পর থেকে এদের খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না। শারীরিক নির্যাতনও করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নানাভাবে। মুক্তিযােদ্ধা আবুল কাশেমের ছােড়া প্রথম মর্টার শেলটি বিমানবন্দরের ট্যাংকার থেকে ১০ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। তারপর একমাত্র শেলটি বিস্ফোরিত হয় ট্যাংকারের ওপর। বিকট শব্দের সাথে সাথে ৩-৪ বর্গমাইল এলাকা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আগুন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায়। শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যস্ততা। ছুটতে থাকে তারা ঘটনাস্থলের দিকে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই শহরের সব পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে সমবেত হয়। ফায়ারিং শুরু করে আশপাশের এলাকা লক্ষ্য করে। ততক্ষণে মুক্তিবাহিনীর ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহরে প্রবেশ করেছেন। রৌদ্রস্নাত সকালে নয়াসড়ক চৌরাস্তায় ২টি, সওদাগরটুলা রাস্তার মােড়ে ২টি এবং ধােপাদিঘির দক্ষিণ পাড়ে ২টি মেশিনগান স্থাপন করে ১২জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ােজিত করা হয়। বন্দর বাজারের রাস্তার মােড়ে আরও ২জন মুক্তিযােদ্ধা ১টি মেশিনগানসহ অবস্থান নেন। বাকি মুক্তিযােদ্ধারা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ থেকে কিছু হাতিয়ার এনে কারাগারের ফটকে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। ৩ মিনিটের মধ্যে তা ধসে পড়ে। কারাগারে প্রবেশ করেন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। তারপর বের করা হয় ২ থেকে আড়াই হাজার নারী-পুরুষকে। মুক্ত হন সবাই। ২১জন মুক্তিযােদ্ধা এবারে ধুবড়ীর হাওর দিয়ে নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে সক্ষম হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড