You dont have javascript enabled! Please enable it! টিলাগড় অ্যামবুশ: সিলেটে প্রথম প্রতিরােধ,আখালিয়ায় সশস্ত্র প্রতিরােধ,আখালিয়ায় সশস্ত্র প্রতিরােধ - সংগ্রামের নোটবুক
টিলাগড় অ্যামবুশ: সিলেটে প্রথম প্রতিরােধ
সিলেট শহরের পূর্ব দিকে টিলাগড় অবস্থিত। ২৫-২৬ মার্চের গভীর রাতে খাদিমনগর থেকে সিলেট শহরের দিকে ১টি সামরিক জিপ (৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) এগিয়ে আসতে থাকে। রাস্তা জনমানবশূন্য। গাড়ির গতি স্বাভাবিক কারণেই ক্ষিপ্র। উদ্দাম গতিতে এগােচ্ছে সামনে অদূরেই টিলাগড় চৌরাস্তা। বিপরীত দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছেন আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এম এ মুত্তালিব। একসময় হাঁটতে হাঁটতে তিনি এসে পৌছালেন টিলাগড়ে। ঠিক তখনই তিনি ১টি সামরিক জিপকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। ডানে-বাঁয়ে আবাসিক এলাকা। সামনে দাড়িয়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারীচাদ মহাবিদ্যালয়। তার পশ্চিম পাশ দিয়েই একটি রাস্তা চলে গেছে। শাপলাবাগ আবাসিক এলাকার দিকে। চার রাস্তার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে সামরিক যানটিকে লক্ষ্য করেন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। হঠাৎ রিভলবারটি হাতে নিয়ে পাশের খালে শুয়ে পড়লেন তিনি। পর মুহূর্তেই গাড়িটা চৌরাস্তায় এসে একটু গতি কমিয়ে ডান দিকে মােড় নেয়। তারপর আবার গতি বাড়াতে যাবে কিন্তু সেটা আর চালকের পক্ষে সম্ভব হলাে না। মােড় নিতে না নিতেই খাল থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। ডান হাতে রিভলবার। আঙুল ট্রিগারে। একটু চাপ দিতেই উড়ে গেল চালকের মাথার খুলি । গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে পড়ে যায়। অন্য আরােহীর বুকে তখন বিদ্ধ হয়েছে আরেকটি বুলেট। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ২জন পাকিস্তানি সৈন্য। ছুটে গিয়ে তাদের সাথে রক্ষিত ২টি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। মুরারীচাদ মহাবিদ্যালয়ের সীমানা দেওয়াল ডিঙিয়ে চলে যান নিরাপদ স্থানে। তারপর বিভিন্ন স্থান ঘুরে লােকজন সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার কাজে নিয়ােজিত হলেন তিনি। ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের এ কার্যক্রমের মাধ্যমে সিলেটে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হয়।
আখালিয়ায় সশস্ত্র প্রতিরােধ
সিলেট শহর থেকে আখালিয়া ৩ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। আখালিয়ায় ইপিআর ১২ নম্বর উইংয়ের সদর দপ্তর । আখালিয়ায় ইপিআর সদস্যরা ২৮ মার্চ সশস্ত্র প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। এখানে কর্মরত অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা ২৫ মার্চের পর পরই পালিয়ে যায়। ঐ অঞ্চলের মােশাররফ হােসেন আর্মি সাপ্লাই কোরের সৈনিক ছিলেন। মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে ছিলেন। এ রকম পরিস্থিতির মুখে তিনি চাকরিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেন। চলে আসেন আখালিয়ায়। আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর ১৫-১৬জন সদস্যও যােগ দেন তার সাথে। সবাই। মিলে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধের পরিকল্পনা করতে থাকেন। মােশাররফ হােসেন নতুনদের দিতে থাকেন প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ। ঠিক এ সময় শােনা যায় যে, সালুটিকর থেকে যে-কোনাে মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী আখালিয়ার ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে। পুলিশের সাহায্য প্রয়ােজন। যােগাযােগ করা হলে তারাও অনুকূল সাড়া দেয়। ২৮ মার্চ ৩টার দিকে ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন ৫৬জন পাকিস্তানি সৈন্যসহ আখালিয়ায় রেকি প্যাট্রল করতে আসেন। রেকি করে যাওয়ার পর ইপিআর সদস্যরা দ্রুত সংগঠিত হতে থাকেন। তাদের হাতে যেসব হালকা অস্ত্র ছিল, তাই নিয়েই প্রতিরােধে প্রস্তুত হলেন তারা। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আগেই সন্ধ্যার সাথে সাথে পাকিস্তানি।
সৈন্যরা আখালিয়া আক্রমণ করে। টিলাময় স্থানটির প্রতিটি সুবিধাজনক জায়গাই তারা দখল করে নেয়। আর সেখান থেকে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। ছেলেরাও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। মুহূর্তে তারা পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে। প্রচণ্ড গােলাগুলি বিনিময় হয়। তবে বাগবাড়ি থেকে পুলিশ বাহিনীর আক্রমণ করার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। জানা যায়, তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে সরে পড়লে তাদের পক্ষে কোনাে সাহায্য করা সম্ভব হয়নি। এদিকে একটানা ৬ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর রাত ১২টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাহায্যে অতিরিক্ত আরও ২ গাড়ি সৈন্য আসে। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এসব সেনাসদস্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। ইতােমধ্যে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। তাদের চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হালকা অস্ত্র ও সামান্য সৈন্যদল দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপুল সৈন্য ও অস্ত্রের মােকাবিলা সম্ভব নয়। তাই মুক্তিযােদ্ধারা। কৌশলগত কারণে স্থান পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। পিছন দিকে। টুকেরবাজারে সরে গিয়ে রচনা করেন তারা প্রতিরক্ষাব্যুহ। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটলেও পাকিস্তানি বাহিনীর ৩জন সদস্য মারা যায় এবং আহত হয় ১০১২জন।
জাফলং বাজারের অপারেশন
জাফলং বাজারটি বল্লাঘাট নদীর তীরে অবস্থিত। সিলেট থেকে শিলংয়ের পথে ৪২ মাইল দূরে ভারতীয় সীমান্ত। এপারে তামাবিল। অন্যদিকে ডাউকি। ভারতীয় এলাকায় বিশাল বিশাল পাহাড়। উঁচু-নীচু, ছােটো-বড়াে অসংখ্য পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে বল্লাঘাট নদী। এ নদী ডাউকি বাজারের পাশ ঘুরে জাফলংয়ে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে সংগৃহীত হয় কোটি কোটি টাকার পাথর। ভিতরের দিকে তৎকালীন ইপিআর-এর একটি ফাঁড়ি অবস্থিত। এখানেই সমবেত তখন সর্বসমেত ৩০জন ইপিআর সদস্য। বিপরীত দিকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ডাউকি বাজারে বিএসএফ-এর অবস্থান। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা বাঙালি দেশত্যাগ করতে থাকে। পুলিশ ইপিআর, মুজাহিদ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করেন। এ অঞ্চল দিয়েই। সীমান্ত অতিক্রমকারী বহু লােকজন তখন ডাউকিতে। এঁদের মধ্যে আছেন বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র, যুবকসহ শ্রমিকও। শুরু হলাে এঁদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। এ সময়ই শােনা গেল, জাফলং বাজারের ইপিআর ফাড়ির বাঙালি সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। ইপিআর সুবেদার পাঞ্জাব প্রদেশের গুল খানকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া এবং অস্ত্র সংগ্রহের তাগিদে সঙ্গে সঙ্গেই একটি অপারেশন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।  ভারতীয় মেজর রাওয়ের তত্ত্বাবধানে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মুসলিমনগরের জনৈক ডাক্তারকে স্থানটি রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তারপর সীমানা থেকে আধা মাইল ভেতরে অবস্থিত ঐ ফাাঁড়িটি আক্রমণের জন্য। ৩৩জনকে নিয়ে ১টি দল গঠন করা হয়। এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ইপিআর সুবেদার মােশাররফ হােসেন। আর তাকে সহযােগিতা করেন ইপিআর সদস্য গােলাম হােসেন, হাবিলদার হারিস আলী, মােশাররফ আলী, আব্দুল গনি, মজিবুর রহমান, ড. খুরশিদ আলম প্রমুখ। ইপিআর সদস্যরা এ অভিযানে সক্রিয় ছিলেন। ৩০ মার্চ রাত প্রায় ১১টায় ডাউকি বাজার থেকে এ দলটিকে বিদায় জানান ডাউকি মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ভারতীয় মেজর রাও এবং সহকারী গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী। তখন মুক্তিযােদ্ধা তালিকাভুক্ত সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৩০০। সবাই এ অপারেশনে যেতে আগ্রহী। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ মুক্তিযােদ্ধার প্রয়ােজন ছিল না বলে মাত্র ৩৩জন রাতের আঁধারে বল্লাঘাট নদী অতিক্রম করেন। সাথে তাদের খুবই সাধারণ কিছু অস্ত্র । মুসলিমনগরের সেই ডাক্তার পথ দেখিয়ে চললেন আগে আগে। ডাউকিকে পিছনে রেখে মুক্তিযােদ্ধারা পূর্ব দিকে অগ্রসর হলেন। তারপর যথাস্থানে এসে। একটি মসজিদের পাশে তারা অবস্থান গ্রহণ করলেন। রাতের তখন শেষ প্রহর। একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফাড়ি আক্রমণ করেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। পাল্টা জবাব এল প্রচণ্ড বেগে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় এ রকম গােলাগুলির এক ফাকে শক্রদের অনেকেই তখন ক্যাম্প। ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে একপর্যায়ে সুবেদার গুল খান একা হয়ে যান। ১টি এসএমজিসহ তাকে জীবিত ধরে ফেলেন মুক্তিযােদ্ধারা। এ সময় আরেক পাকিস্তানি সৈন্যের প্রাণহীন দেহ ধুলােয় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তার দেহের পাশেই একটা সিভিল গান পাওয়া যায়। বাকি সবাই তখন অস্ত্রসহ পলাতক। অবশেষে মুক্ত হলাে জাফলং বাজারের ফাড়ি। মুক্তিবাহিনীর সংগ্রহে এল কিছু অস্ত্র  এ অপারেশনে শহিদ হন ১জন মুক্তিযােদ্ধা।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড