You dont have javascript enabled! Please enable it!
সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ
সূচনা
মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলার সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল ৫ এপ্রিলে সাদিপুরশেরপুরের যুদ্ধ। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান সাদিপুর-শেরপুরের পতন হয় এবং তারা সিলেটে সরে আসতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে স্বাধীনতাকামী কিন্তু অসংগঠিত মুক্তিবাহিনী নিয়ে প্রশিক্ষিত ১টি পাকিস্তানি ইউনিটের বিরুদ্ধে শেরপুরের যুদ্ধে বিজয় ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট মাইলফলক এটি সাধারণ জনগণ, ইপিআর, প্রাক্তন সৈনিক, সেনাবাহিনী ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত সাহসী প্রয়াস, যা সিলেটের জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধগুলােয় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর হলাে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সংযােগস্থল। সড়কপথে ঢাকা বা অন্য যে-কোনাে জেলার সাথে যােগাযােগ রক্ষায় শেরপুর ফেরি অতিক্রম করা ছিল অপরিহার্য। নৌপথেও এখান থেকে দেশের যে-কোনাে স্থানের সঙ্গে যােগাযােগ করা যায়। এসব কারণে শেরপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পাকিস্তানি ও মুক্তিবাহিনী উভয় পক্ষের কাছেই বিবেচিত ছিল। শেরপুর কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত যা সিলেট শহর থেকে ৪০ কিলােমিটার দক্ষিণে ও মৌলভীবাজার থেকে ২২ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। সাদিপুর শেরপুর থেকে ৩ কিলােমিটার উত্তরে সাদিপুর খালের তীরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে কুশিয়ারা নদী ও সাদিপুর খালের ওপর ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা ছিল (বর্তমানে নদী ও খালের ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে)। যুদ্ধের পটভূমি।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকায় গণহত্যা ও পরবর্তী সময় সিলেটে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে হবিগঞ্জ শহরে অবস্থানরত আওয়ামীলীগের নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রব ও মানিক চৌধুরী অন্য নেতাদের সাথে নিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। হালকা অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, ছাত্র, মুজাহিদ, শ্রমিক ও কৃষকসহ আপামর জনতাকে এ কাজে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে সচেষ্ট হলেন। তাঁদের এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ির পুলিশেরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসেন। সীমান্ত ফাড়িগুলাের বাঙালি ইপিআর সদস্যরাও হাতের অস্ত্রসহ যােগ দেন মুক্তিফৌজে। এভাবেই হবিগঞ্জ এলাকায় অল্প সময়ে গড়ে ওঠে বেশ বড়াে এক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ রেজিমেন্টের একজন মেজর ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। ১৯৭১-এর জানুয়ারি মাসে ৯০ দিনের ছুটি নিয়ে | তিনি বাড়ি আসেন। ২৫ মার্চের পর কাজে যােগদান করার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে যােগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। হবিগঞ্জে গঠিত মুক্তিবাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব নেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত সিলেট মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি মুক্তিবাহিনী নিয়ে সিলেট অভিমুখে অভিযান পরিকল্পনা করেন। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার থেকে সিলেটের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাদিপুর-শেরপুরে অবস্থিত পাকিস্তানি ঘাঁটি তাই শেরপুর দখল অনিবার্য হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাদিপুর-শেরপুরের গুরুত্ব। সিলেট শহরকে দখলদার পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত এ বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের ওপর। মেজর দত্ত ১ এপ্রিল রশিদপুর থেকে সদর দপ্তর মৌলভীবাজারে স্থানান্তর করেন। তিনি পরিকল্পনা করেন সিলেট আক্রমণের। মৌলভীবাজার ছিল যােগাযােগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সিলেট থেকে সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা কিংবা ঢাকার দিকে যেতে হলে পাকিস্তানি বাহিনীকে অবশ্যই মৌলভীবাজার হয়ে যেতে হতাে। আবার মৌলভীবাজার থেকে আক্রমণ করা রণকৌশলগত দিক দিয়েও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সিলেটের বিভিন্ন থানার সাথে নৌযােগাযােগের  ক্ষেত্রে শেরপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিধায় পাকিস্তানিরা এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করে। যে-কোনাে মূল্যে শেরপুর দখল রাখার ব্যাপারে তারা ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সিলেট শহরের দখল নিতে হলে শেরপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আগেই বিতাড়িত করা প্রয়ােজন। আর সেই প্রয়ােজন থেকে মৌলভীবাজারে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর নেতারা সর্বাগ্রে শেরপুর আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিলেট দখলের জন্য সাদিপুর-শেরপুর দখল করা যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সংগঠন ১. পাকিস্তানি বাহিনী: ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল সিলেটের খাদিমনগরে। যুদ্ধ শুরু হলে সিলেট রক্ষার জন্য ইউনিটটি সাদিপুর ও শেরপুর এলাকায় ১টি কোম্পানি মােতায়েন করে ।
২. মুক্তিবাহিনী: মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের সার্বিক নেতৃত্বে মােট ৩জন অধিনায়কের অধীনে মুক্তিবাহিনীর ৩টি দল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন, যাদের মধ্যে ছিল সেনাসদস্য, সীমান্ত ফাঁড়িগুলাের বাঙালি ইপিআর এবং হালকা অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার বাহিনীর সদস্য, মুজাহিদ, পুলিশ, শ্রমিক ও কৃষকসহ আপামর জনতা। মুক্তিবাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষিত অংশ ছিল কিছু সংঘবদ্ধ সেনাসদস্য ও ইপিআর বাহিনী। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব সীমান্তে গিয়ে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের একত্র করে মৌলভীবাজার পাঠান। মানিক চৌধুরী অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করেন। মুক্তিবাহিনী সংগঠনে রশীদপুর। এলাকার চা-বাগানের ম্যানেজাররা ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন। অবস্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনী: সিলেট শহরকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা সংযােগস্থলে অবস্থিত শেরপুরে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নেয়। মৌলভীবাজার-সিলেট সড়কের শেরপুরে পাকিস্তানের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের যথাক্রমে ২ প্লাটুন ও সাদিপুরে ১ প্লাটুন। সৈন্য অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ শেরপুর ও সাদিপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, শেরপুরে ইতােপূর্বে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। ২. মুক্তিবাহিনী: হবিগঞ্জ থেকে মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ প্রথম অস্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপন করেন। রশীদপুর চা-বাগানে।
এরপর মেজর দত্ত রশীদপুর থেকে সরে এসে মৌলভীবাজারে ঘাঁটি স্থাপন করেন। মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র ও জনবল বৃদ্ধি পায়। মৌলভীবাজার থেকে শেরপুরের দিকে মুক্তিবাহিনী যাত্রা করে ৪ এপ্রিল। ঐ দিন রাত ৮টায় মুক্তিবাহিনী শেরপুরের কাছে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের সাথে সমন্বয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেরপুর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করলে স্থানীয় নেতারা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে সংবাদ পাঠান। এদিকে মেজর দত্ত (মৌলভীবাজার থেকে) শেরপুর আক্রমণের কথা সাদিপুর-শেরপুরের স্থানীয় নেতাদের জানান। স্থানীয় নেতারা মহিলাসহ আশেপাশের লােকজনকে নিরাপদ স্থানে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীনতাকামী স্থানীয় নেতারা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সাদিপুর-শেরপুর এলাকার ছাত্রনেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মণিন্দ্রলাল পােদ্দার, খলিল উল্লা, ময়না মিয়া, সুনীল ভৌমিক, মতিন চৌধুরী, কবির উদ্দিন আহমদ, এখলাস উদ্দিন, এমদাদ গনি প্রমুখ। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মুক্তিবাহিনী সংগঠনে প্রাথমিক দিনগুলাে রশীদপুর এলাকার চা-বাগানের ম্যানেজার ও চা শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন।
মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল মুক্তিবাহিনী সংগঠনে গিয়াস উদ্দিন, তােয়াবুর রহীম, আজিজ, ড. আলী, আলতাফ ইলিয়াস এবং চা-বাগানের ম্যানেজার মােস্তফা ও আজিজের অবদান উল্লেখযােগ্য। যুদ্ধ পরিকল্পনা। ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনার প্রধান দিক ছিল শেরপুর ও সাদিপুরে অবস্থান নিয়ে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ থেকে সিলেটগামী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করা। এখানে উল্লেখ্য যে, এ সড়কপথে শেরপুর কুশিয়ারা নদী ও সাদিপুর খালের ওপর ২টি ফেরির নিয়ন্ত্রণ তাদের অধীনে ছিল। ১জন অফিসারের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেরপুর ও সাদিপুরে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তােলে। তারা সাধারণ জনগণের আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কোনাে সাধারণ নৌকাও চলাচল করতে দেয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেরপুরে আসার পরই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ মুক্তিকামী ব্যক্তিদের খোঁজ করতে থাকে। তারা স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। মুক্তিবাহিনী: শেরপুর যুদ্ধ ছিল সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর প্রথম পরিকল্পিত যুদ্ধ। ৪ এপ্রিল রাত ১০টায় মেজর দত্ত আক্রমণকারী বাহিনীর অধিনায়কদের নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন। আক্রমণের তারিখ, অধিনায়ক, মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা ইত্যাদি চূড়ান্ত করার পর মুক্তিবাহিনীকে ৩ ভাগে বিভক্ত করে ৩জন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। মেজর দত্ত পরিকল্পনা করেন যে, ডানে ও বামের সৈন্যরা নদী পার হয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলবে এবং বাকি সৈন্যেরা সম্মুখযুদ্ধে শত্রু সৈন্যদের ব্যস্ত রাখবে। যুদ্ধের বিবরণ ৪ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী মৌলভীবাজার থেকে শেরপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর হাতে তখনাে ভারী কোনাে অস্ত্র আসেনি। অস্ত্র বলতে শুধু .৩০৩ রাইফেল এবং সাথে ছিল কিছু গােলাবারুদ। মুক্তিযােদ্ধারা রাত ৮টার সময় শেরপুরের কাছাকাছি প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করেন। পরিকল্পনা করা হয় যে, ৫ এপ্রিল ভােরবেলা মুক্তিবাহিনী শেরপুর আক্রমণ করবে।
শেরপুর পৌছার আগেই মুক্তিবাহিনীর ১টি গ্রুপ নদী অতিক্রম করে। কুশিয়ারার উত্তর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। তিন দিকে ৩টি গ্রুপ অবস্থান গ্রহণ করে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানসহ প্রয়ােজনীয় সমস্ত পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত হয়। চূড়ান্ত প্রস্তুতি সমাপ্ত করে ভাের ৫টায় শুরু হয় আক্রমণ। ভাের ৫টায় শেরপুরে শত্রুর অবস্থানের সামনে আসতেই শত্রুরা গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। মুক্তিবাহিনী পাল্টা জবাব দেয়। মুক্তিবাহিনী তখন সাদিপুর নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী শক্রর অবস্থান সম্পর্কে এখন পুরােপুরি নিশ্চিত। আর এর পর পরই অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। রাতের শেষ প্রহরে স্বভাবতই তারা ছিল দ্রিামগ্ন। তাছাড়া এত কাছ থেকে এ আক্রমণ তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পাল্টা আক্রমণের আগেই হতাহত হয়ে যায় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। আধুনিক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুরা তাদের মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ করে। ফলে আশপাশের গ্রামগুলাের বহু নিরস্ত্র মানুষ তাদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। মারা যায় অনেক গ্রামবাসী। বাড়িঘরসহ বহু সহায়-সম্পদও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে শক্র শেরপুর অবস্থান ছেড়ে কুশিয়ারার উত্তর পাড়ে শেরপুর নতুন বাজারে চলে আসে। ৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে সব সময়ই মুক্তিবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তাই অতি সাধারণ অস্ত্র দ্বারা স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা লড়াই করে পুরাে এলাকার দখল নিতে সক্ষম হয়।
শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানি বাহিনীর ৩টি প্লাটুনের অনেক সৈন্যই মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। এ রকম ১জন। পাকিস্তানি সৈন্য ইলাশপুর গ্রামের জনৈক দালাল ছাওলা মিয়ার ধানের গােলায়। লুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামবাসী খুঁজে পেয়ে সেখান থেকেও তাকে বের করে এনে হত্যা করে। সাদিপুর থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছিল। তাদের পিছু ধাওয়া উচিত হবে না মনে করে মেজর দত্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করতে লাগলেন। মেজর দত্ত তার শক্তি বৃদ্ধির জন্য পূর্বেই মেজর সফিউল্লাহর কাছে ১ কোম্পানি সৈন্য পাঠানাের জন্য অনুরােধ করেন। মেজর সফিউল্লাহ ৪ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আজিজ তার দল নিয়ে কুলাউড়া-শেওলা-সুতারকান্দি-গােলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। ক্যাপ্টেন আজিজ তাঁর সৈন্যদের নিয়ে বিনা বাধায় গােলাপগঞ্জ পর্যন্ত পৌছে যান। কিন্তু সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩ মাইল দূরে যখন কদমতলীর কাছে পৌছেন, তখন পাকিস্তানিরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁর পাল্টা আক্রমণে টিকতে না পেরে শত্রু সৈন্যরা সিলেটের দিকে। পালিয়ে যায়। মেজর দত্ত সুবেদার ফজলুল হককে তার কোম্পানি নিয়ে সাদিপুরের প্রায় ২ মাইল আগে প্রতিরােধ অবস্থান গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। এদিকে মুক্তিবাহিনী খবর পায় যে, বিশ্বনাথ এলাকায় রাস্তার দুই পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে। মুক্তিবাহিনী বিশ্বনাথের ওপর আক্রমণ করে এবং বিশ্বনাথ দখল করে।
রাতের অন্ধকারে আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে বিশ্বনাথ ছেড়ে সিলেট শহরে পালিয়ে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্যদল পাকিস্তানি সৈন্যদের কদমতলী থেকে বিতাড়িত করে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করে। এভাবে ৭ এপ্রিল সমস্ত সিলেট শহর (সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দর ছাড়া) মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের ‘সি’ কোম্পানি ও স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা শেরপুর এলাকা মুক্ত রাখে। ২৩ এপ্রিল শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। একপর্যায়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীও আক্রমণে অংশ নেয়। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে প্রায় পিছনের দিক থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করে। ঐদিন ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হলে তাঁকে মৌলভীবাজার নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে। মুক্তিবাহিনী শেরপুরের অবস্থান ছেড়ে মৌলভীবাজারের দিকে চলে আসে। যুদ্ধের ফলাফল। এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধে। মুক্তিবাহিনীরও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিতান্ত কম ছিল না। এখানে শহিদ হন। ৩জন মুক্তিযােদ্ধা এবং আহত হন আরও অসংখ্য।
কিন্তু এ রক্তাক্ত আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হলাে। সমগ্র এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক সৈন্য অবশেষে সিলেট শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাে। যুদ্ধের সার্বিক মূল্যায়ন ১. পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ: পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ছিল স্থানীয় জনগণের অসহযােগিতা ও অপরিকল্পিত অবস্থান গ্রহণ। সাদিপুর-শেরপুরে পাকিস্তানি বাহিনী আগমনের পর আশপাশের এলাকায় প্রচণ্ড নির্যাতন চালায়, এর ফলে স্থানীয় জনগণ। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ও গতিবিধি সম্পর্কেও পাকিস্তানি বাহিনীর ভালাে ধারণা ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ: মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল সাহস, দেশপ্রেম ও স্থানীয় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। স্বাধীনতা ও স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত অসংগঠিত বা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রশিক্ষিত নিয়মিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করে।  এটি সম্ভব হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর একতা, নৈতিক মনােবল এবং মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের গতিশীল নেতৃত্বের জন্য।
উপসংহার
সাদিপুর-শেরপুর আক্রমণ ছিল সিলেট রণাঙ্গনে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রধান যুদ্ধ । শেরপুর বৃহত্তর সিলেটের চার জেলার সংযােগস্থল ও গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে কৃষক, প্রাক্তন সেনাসদস্য, শ্রমিক, ছাত্র, আনসার বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে বেশ বড়াে ১টি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। মেজর দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান শেরপুরের পতন হয় এবং সিলেটে সরে আসতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে স্বাধীনতাকামী অসংগঠিত মুক্তিবাহিনী নিয়ে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি নিয়মিত ইউনিটের বিরুদ্ধে সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ বিজয় ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার। মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট মাইলফলক। এটি জনগণ ও ইপিআর, প্রাক্তন সৈনিক, সেনাবাহিনী ও ছাত্র-জনতার প্রয়াস, যা সিলেটের জনগণকে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তী সময় লড়তে অনুপ্রেরণা দেয়।
(সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ বা যুদ্ধ কার্যক্রমের নকশাটি ৮৪৯ পাতায় দেখুন)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!