You dont have javascript enabled! Please enable it! গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক
গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে সিলেট
বাঙালির ইতিহাস সংগ্রাম ও বিদ্রোহের ইতিহাস। সুদূর অতীত থেকে এ জাতি আন্দোলন ও সংগ্রাম করে আসছে কখনাে বিজাতীয় শাসকের বিরুদ্ধে, কখনাে দেশীয় শােষকদের বিরুদ্ধে বাঙালির এ আন্দোলন সংগ্রামে সিলেটের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সিলেটের অধিবাসীরা বরাবরই প্রতিবাদী ও স্বাধীনচেতা ইংরেজ কর্তৃক সিলেট দখলের মাত্র ১৭ বছরের মাথায় সিলেটে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সিলেটের তখনকার কালেক্টর ছিলেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি সিলেটকে অশান্ত অঞ্চল বলে উল্লেখ করেন। এ অশান্ত সিলেটের মাটিতেই ১৭৮২ সালে মহররমের দিনে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহীরা সারিবদ্ধভাবে একটি টিলায় সমবেত হয়। তারপর ‘ফিরিঙ্গিদের হুকুম মানি না’ বলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লিন্ডসে বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে অস্ত্রসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু বিদ্রোহীদের নেতা তখন উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, “এখন সময় হত্যার, না হয় মৃত্যুর; খতম হয়ে এল ইংরেজ শাসন।” শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই  বুলেটবিদ্ধ হলেন বিদ্রোহী বাহিনীর নেতা; সিলেটে ইংরেজবিরােধী সংগ্রামে প্রথম শহিদ হলেন তিনি। এ বিদ্রোহে শহিদ হন তাঁর ২ ভাই সৈয়দ হাদী ও সৈয়দ মাহদি। তারা ২জন হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া নামে জনগণের কাছে পরিচিত ছিলেন।  বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তার ঢেউ সিলেটে এসেও লেগেছিল। সিলেটে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আগা মােহাম্মদ রেজা বেগ। তিনি ছিলেন মােগলদের বংশধর এবং শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁর ছিল হাজার হাজার শিষ্য।
তিনি ব্রিটিশ শাসনকে মেনে নিতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে তিনি শয়তানের রাজত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ১৮০০ সালের মধ্যে ইংরেজ শাসন শেষ হয়ে যাবে। তিনি চলে যান কাছাড়ে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন হাজার হাজার ফকির ও কৃষক। কাছাড়ের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন। ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি কৃষকদের খাজনা পরিশােধ না করার পরামর্শ দেন। তারপর ১৭৯৯ সালের ১৪ জুলাই ১,২০০ সৈন্য নিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেন। বিন্দাশালে ব্রিটিশ সৈন্যরা তার মােকাবিলা করে পরাজিত হয়। তারপর ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর এক বিরাট দল প্রেরিত হয়। এবার পরাজিত হন আগা মােহাম্মদ। ১৯৩০ সালে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনকালে সিলেটের কংগ্রেসীরা। নােয়াখালীতে গিয়ে লবণ তৈরি করে সে আন্দোলনে সক্রিয় অবদান রাখেন। সেখানে তারা পুলিশি বাধার মুখােমুখি হন। তারপর স্থান পরিবর্তন করে গিয়েছেন চৌমুহনী। এখানেও পুলিশ দ্বারা আহত হন অনেকেই। এ সংবাদ সিলেটে আসার পর এখান থেকে আরও কংগ্রেসকর্মী গিয়ে যােগ দেন তাদের। সাথে, তৈরি করেন লবণ। আর তা বিক্রি করে আন্দোলনের ফান্ডে টাকা জমা দিতেন তারা লবণ তৈরির মাধ্যমে আইন অমান্য করার দায়ে জওহরলাল নেহেরুকে গ্রেপ্তার করা হলে এর প্রতিবাদে ১৫ এপ্রিল সিলেটে হরতাল পালন করা হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের প্রায় সাথে সাথেই শুরু হয় ভাষা-বিতর্ক তা থেকে জন্ম নেয় দুর্বার আন্দোলন। আর এ আন্দোলনে সিলেটবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের ভিতরে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম লেখা বের হয় সিলেটের সাহিত্যপত্র আল-আসলা হতে। লেখক মুসলিম চৌধুরী। প্রথম সমাবেশ হয় সিলেটে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর। ১৯৬৬ সালের ৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান সিলেটে আসেন এর আগে হয়েছে বন্যা জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়। ক্ষমতার বাইরে তাই ছাত্র-জনতা সিলেটকে দুর্গত এলাকা ঘােষণা এবং হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । ঐদিন বিকালে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে বসে ছাত্রসভা পরদিন থেকে ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। চলে বন্দি মুক্তির আন্দোলন ১৯৬৯ সালে পতন ঘটে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সিলেটের ছাত্রসমাজ যে আন্দোলনের ডাক। দিয়েছিল ১৯৬৬ সালে, ১৯৬৮-৬৯ সালে সে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে সমগ্র জাতি সৃষ্টি হয় গণ-অভ্যুত্থান; ক্ষমতাচ্যুত হয় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ১৯৬৯ সালের ২৯ জানুয়ারি স্বৈরশাহী আরােপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শােভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তারপর জনতা আসাদের রক্তমাখা লাশ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে মুখােমুখি লড়েছিল আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে। আসাদের শার্ট সে-দিন বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক হয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটায় উনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলােয় সমগ্র সিলেট গণঅভ্যুত্থানে প্রকম্পিত হয়েছিল। তারই তরঙ্গাভিঘাতে সিলেট অঞ্চলের সম্পূর্ণ প্রশাসন বিকল হয়ে যায়।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া। খান ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনা শেষে ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে ঘােষণা দেন। তিনি ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের। অধিবেশন বসবে বলেও ঘােষণা দেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো আওয়ামী লীগের ৬-দফা দাবি সংশােধন না করলে জাতীয় সংসদ বর্জন করার হুমকি দেন। এ হুমকির মুখে ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য। স্থগিত করেন। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন না পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়া যায়, ততদিনের জন্য অহিংস। অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ ঢাকা সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘােষণা প্রদান করে বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ১ মার্চ জাতীয়। পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সিলেটে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পৃথক পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ৩ মার্চ হরতাল চলাকালে সকালে সিলেটের নয়াসড়ক খাজাঞ্চি বাড়িতে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সেক্টর সদর দপ্তর থেকে ছাত্র-জনতার। একটি বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয় এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ১জন। নিহত হয়েছে। অমনি মুক্তিপাগল মানুষ দলে দলে ছুটে গিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে। 
সন্ধ্যা ৭টা থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে ১২ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্যআইন জারি করা। হয়। তা উপেক্ষা করে জনগণ রাজপথে নেমে এলে গ্রেফতার করা হয়। ৩৩জনকে। ৭ মার্চের ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৭ মার্চ রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিলেট বেতার থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ। সংবাদ বুলেটিন হিসেবে প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ ছাত্রলীগের নেতারা প্রথমে সিলেটের তত্ত্বালীন এমএনএ দেওয়ান ফরিদ গাজীর শেখঘাটস্থ বাসভবনে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এবং পরে ডিসি অফিসে পাকিস্তানি। পতাকা নামিয়ে শােয়েব আহম্মদ চৌধুরী ও অন্যরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় সিলেট জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসহযােগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির স্থানীয় শাখা, ছাত্র-জনতা তখন থেকেই ৬-দফার পরিবর্তে ১-দফার (স্বাধীনতা) আন্দোলনে মুখর হয়ে ওঠে। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর সিলেট জেলার জেলা সদর, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সর্বদলীয় প্রতিরােধ সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। স্থানীয় গণ-প্রতিনিধিসহ (এমএনএ এবং এমসিএ) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসব প্রতিরােধ কমিটির সদস্য হিসেবে একটি আসন্ন ক্র্যাকডাউন প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। | ২৫ মার্চ সকাল থেকেই সিলেটের রাজপথে লাঠি হাতে মিছিলের ঢল নামে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্র-জনতার বজ্রধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে আকাশ-বাতাস। বিকালে সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রেজিস্ট্রি মাঠে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড়াে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ বিকালে আওয়ামী লীগ দলীয় এমএনএ দেওয়ান ফরিদ গাজী চাবাগানের শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা-বাগানে। গমন করেন। ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের মাধ্যমে তিনি অবগত হন যে, ঐ দিন রাতেই ক্র্যাকডাউন হবে। তিনি তাড়াতাড়ি শহরে চলে আসেন এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করেন। অসহযােগ আন্দোলনের শুরুতে সিলেটের বিভিন্ন স্কুলকলেজে প্রতিরােধের প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরােধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা কার্যক্রম শুরু হলে সে বার্তা সিলেটে এসে পৌছে। এদিকে ২৫-২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সিলেটে হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালায়। এর প্রতিবাদে সেদিন আন্দোলন ও প্রতিরােধের যে ঢেউ উঠেছিল, তারই সফল পরিসমাপ্তি ঘটে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড