প্রতিরােধ যুদ্ধে সিলেট
সিলেটে প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনা হয় ২৫-২৬ মার্চ রাতে সিলেট শহরের টিলাগড়ে। অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এম এ মুত্তালিব গভীর রাতে টিলাগড় (এমসি কলেজের কাছে) খাদিমনগর থেকে আগত পাকিস্তানের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি জিপের ড্রাইভারকে রিভলবার দিয়ে গুলি করেন। গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে পড়ে যায়। গাড়ির নিহত সৈনিকদের কাছ থেকে ২টি অস্ত্র নিয়ে তিনি নিরাপদে চলে যান। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এরপর গােয়াইনঘাট হয়ে ভারতের ডাউকি সীমান্ত পার হয়ে শিলং যান এবং ভারত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সর্বপ্রথম যােগাযােগ করেন। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দ্বারা ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানার ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদর দপ্তর আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় সিলেটেও এসে পৌঁছে। অন্যদিকে, ২৫-২৬ মার্চে সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে হতাহতের ঘটনা ঘটে। শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। সাধারণ জনগণ সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকে।
সিলেটে অবস্থিত ইপিআর বাহিনীর ১টি সেক্টর সদর দপ্তরের অধীন ৩টি উইং (ব্যাটালিয়ন) ছিল যথাক্রমে কুমিল্লার কোটবাড়িতে ১ নম্বর উইং, সিলেট শহরে ৩ নম্বর উইং এবং ১২ নম্বর উইং। ১২ নম্বর উইংয়ের সদর দপ্তর ছিল সিলেটের খাদিমনগরে। ১২ নম্বর উইংয়ের ‘এ’ কোম্পানিকে রাখা হয়েছিল সিলেট শহরে আইএস। (ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি) ডিউটি এবং অন্যান্য বিশেষ কাজে। কোম্পানি অধিনায়ক ছিল একজন অবাঙালি। সুবেদার মজিবুর রহমানের কমান্ডে ‘বি’ কোম্পানিকে লালাখাল সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে কালাছাতক সীমান্ত ফাঁড়ি পর্যন্ত সীমান্ত রক্ষা ও চোরাচালান রােধের কাজে রাখা হয়েছিল। ‘সি’ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল লক্ষ্মীবাজার সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে লুবাছড়া সীমান্ত ফাঁড়ি পর্যন্ত। ‘এ’ কোম্পানি কমান্ড করছিলেন সুবেদার বি আর চৌধুরী। সােনালি চেলা সীমান্ত এলাকা থেকে বীরেন্দ্রনগর সীমান্ত পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার নছিবুর রহমান। লক্ষণীয় যে, সিলেট সেক্টরটিতে একমাত্র সেক্টর কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন ব্যতীত আর কোনাে বাঙালি অফিসার ছিলেন না। ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারায় ২৫ মার্চ রাতেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি এবং মর্মান্তিকভাবে শহিদ হন। অবশ্য সেক্টরের বাঙালি জেসিও কোম্পানি অধিনায়করা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কোম্পানিতে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআরদের বন্দি করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সিলেট শহরের শমসেরনগর, সালুটিকর, মৌলভীবাজার ইত্যাদি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৮ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী আখালিয়া ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এর আগে ২৫ মার্চের পর পরই অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা এখান থেকে পালিয়ে যায়। এখানকার ১জন সেনাসদস্য ছুটি শেষে যােগদান না করে আখালিয়ায় এসে বাঙালি ইপিআরদের সাথে যােগ দেন। তাঁর সাথে ১৫-১৬জন। আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যও যােগ দেন। এরপর তারা প্রতিরােধের পরিকল্পনা করতে থাকেন। ঠিক এ সময় শােনা যায় যে, সালুটিকর থেকে যেকোনাে মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী আখালিয়া ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে। ২৮ মার্চ বিকালে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প রেকি (পর্যবেক্ষণ) করে যায়। এর পর পরই ইপিআররাও সংগঠিত হতে থাকে এবং তাদের হাতে যে-সব হালকা অস্ত্র ছিল, তা নিয়েই প্রতিরােধে প্রস্তুত হতে থাকলে। তাদের প্রস্তুত হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে বসে। মুক্তিবাহিনীও অবস্থান নিয়ে মুহূর্তে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে। শুরু হয় প্রচণ্ড গুলিবিনিময়। একটানা ৬ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি আরও বৃদ্ধি করা হয়। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এসব সেনাসদস্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তাদের মােকাবিলা সম্ভব ছিল না।
তাই তারা কৌশলগত কারণে পিছন দিকে টুকেরবাজারে সরে গিয়ে রচনা করে প্রতিরক্ষাব্যুহ। ২৯ মার্চ ১২ নম্বর উইংয়ের ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার বজলুর রহমান চৌধুরী (বি আর চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত) তাঁর অধীন সমস্ত বিওপিতে (বর্ডার আউট পােস্ট) অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দি করার নির্দেশ দেন। বাঙালি ইপিআর সদস্যরাও মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। ফলে কোম্পানি অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ৩০ মার্চের মধ্যে সব অবাঙালি ইপিআর সদস্যকে বন্দি করে লক্ষ্মীবাজারে অন্যান্য বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে একত্র করেন। সুবেদার বি আর চৌধুরী তার কোম্পানির ৬০জন বাঙালি ইপিআর সদস্য নিয়ে ভারত সীমান্তে যান। সেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বিএসএফ) সঙ্গে সামরিক সাহায্যের প্রশ্নে আলােচনা শেষে সিলেটের পথে রওনা হন।
৩১ মার্চ রাত ১১টায় সুবেদার বি আর চৌধুরী জুরীতে এসে পৌঁছেন। জুরীতে ৩ নম্বর উইংয়ের সুবেদার আব্দুল মান্নান ও সুবেদার মজিবুর রহমান। অবস্থান করছিলেন। সে সময় সুবেদার আব্দুল মান্নান ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফের স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদান এবং তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটি নির্দেশনামা সুবেদার বি আর চৌধুরীকে দেখান। এদিকে ১২ উইংয়ের সুবেদার নছিবুর রহমান ও সুবেদার মজিবুর রহমান। নিজ নিজ কোম্পানির অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দি করে ফেলেন। উল্লেখ্য যে, সেক্টর সদর দপ্তর ও উইং সদর দপ্তরের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা ২৬ মার্চ থেকেই সীমান্ত এলাকায় পালিয়ে সীমান্তের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে মিলিত হতে থাকে। বর্তমান সিলেট জেলার তামাবিল অঞ্চলের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জাফলং চা-বাগান এলাকায়। এ এলাকার তামাবিল বিওপিতে তখন কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি ইপিআর বাহিনীর সদস্য কর্মরত ছিল। ইপিআর-এর বাঙালি সুবেদার মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আনুমানিক ৬০জন বাঙালি সৈনিক চা-বাগান এলাকায় একত্র হয়। ৩০ মার্চ সুবেদার মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং জাফলং চা-বাগানের ম্যানেজার নাজিম কায়েস চৌধুরীর সার্বিক সহযােগিতায় তাঁরা প্রথমে তামাবিল বিওপি দখল করে নেন।
তাদের সাথে আরও কিছু সংখ্যক ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সদস্য যােগ দেন, সুবেদার মজিবুরের বাহিনীটি পর্যায়ক্রমে ৪ এপ্রিল খাদিমনগর এলাকা পর্যন্ত নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠিত করে। এরই মধ্যে সীমান্তের অন্যান্য বিওপি থেকে আরও কিছুসংখ্যক ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সৈনিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য এসে সুবেদার মজিবুরের প্রতিরােধ বাহিনীতে যােগ দেন। এদিকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশে সুবেদার বি আর চৌধুরী সালুটিকর বিমানবন্দর আক্রমণের জন্য রওনা হয়ে যান। অপরদিকে একই নির্দেশে সুবেদার আব্দুল মান্নান ও সুবেদার মজিবুর রহমান তাদের নিয়ে তেলিয়াপাড়ার দিকে রওনা হন। মেজর খালেদ মােশাররফ ২৭ মার্চ সীমান্ত রক্ষায় নিয়ােজিত ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করেন। এ যােগাযােগের ফলে সিলেট সেক্টরের প্রায় সমস্ত ইপিআর-এর মধ্যে কিছু সংখ্যক মেজর খালেদ মােশাররফের কমান্ডে এবং কিছু সংখ্যক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের কমান্ডে যুদ্ধ করতে থাকেন।
মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ রেজিমেন্টে মেজর পদে দীর্ঘদিন ধরে কর্তব্যরত ছিলেন। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ৩ মাসের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে নিজ মহকুমা হবিগঞ্জে ছুটি ভােগ করছিলেন। ২৫ মার্চের পর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব (এমসিএ) ও এ কে এম লতিফুর রহমান চৌধুরী (এমএনএ, তিনি মানিক চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত) প্রমুখ আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকদের একত্র করে সামান্য যে কয়টি .৩০৩ রাইফেল সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, তা-ই দিয়ে সিলেট শহরকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মেজর দত্তকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কর্নেল রব ও মানিক চৌধুরী রসদপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা ইত্যাদির দায়িত্ব নিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর দত্ত আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ এবং কিছু ছাত্রের হাতে কেবল .৩০৩ রােল্ট অ্যাকশন রাইফেল তুলে দিয়ে সিলেট শহর শত্রুমুক্ত করার জন্য সিলেটের পথে অগ্রসর হলেন। সেক্টরের বিভিন্ন উইংয়ের ইপিআর সৈনিকেরা ক্রমশ মেজর দত্তের সঙ্গে একত্র হতে থাকে। ১ এপ্রিল মেজর দত্ত রশীদপুর থেকে সদর দপ্তর মৌলভীবাজারে স্থানান্ত রিত করার সিদ্ধান্ত নেন। মৌলভীবাজারে আসার পথে নয়নপুরে মেজর দত্তের বাহিনীর সঙ্গে আধুনিক অস্ত্র না থাকলেও মুক্তিযােদ্ধাদের হাজার হাজার লােকের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের সঠিক সৈন্যসংখ্যা নির্ণয় করতে না পেরে পিছু হটে যায়। ১ এপ্রিলেই মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত মৌলভীবাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ইপিআর বাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে পুনর্গঠিত করলেন সমগ্র বাহিনীকে। | ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি প্লাটুন শেরপুরে এবং ১ প্লাটুনের কিছু বেশি।
সৈন্য সাদিপুরে প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করে। সিলেট আক্রমণের জন্য সামরিক দিক থেকে শেরপুর ও সাদিপুর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পাকিস্তানি | সেনাদের কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং বেশকিছু চাইনিজ রাইফেল ছিল। শেরপুর ও সাদিপুর পারাপারের জন্য ফেরি নৌকা ২টিও পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত তার | বাহিনীকে ৩টি কলামে ভাগ করে ৪ এপ্রিল রাত ১০টা থেকে স্থানীয় জনগণের দেওয়া নৌকায় পার হয়ে শেরপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৫ এপ্রিল ভাের ৫টায় মেজর দত্তের বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মেশিনগান, ৩ ইঞ্চি ও ২ ইঞ্চি মর্টার, চাইনিজ স্টেনগান ইত্যাদি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের মর্টার শেলের আঘাতে বেশ কিছু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং গ্রামবাসী ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে গিয়ে প্রাণ হারায়। ভাের ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের ২টি প্লাটুনের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয়। অন্যরা পালাতে গিয়ে গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ৩জন শহিদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সেদিন সাদিপুর ও শেরপুর মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এদিকে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের অনুরােধে মেজর কে এম সফিউল্লাহ। ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি (চার্লি কোম্পানি) মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের সাহায্যার্থে পাঠিয়ে দেন। মেজর দত্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটিকে কুলাউড়া, শেওলা, সুতারকান্দি, গােলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর পাড়ে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বললেন।
ক্যাপ্টেন আজিজ তাঁর বাহিনী নিয়ে কদমতলীতে (সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩ মাইল দূরে) এলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অকস্মাৎ আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন আজিজ তার কোম্পানি নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনারা কদমতলী ছেড়ে সিলেট শহরে কেন্দ্রীভূত হয়। ক্যাপ্টেন আজিজ আরও অগ্রসর হয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলেন। এদিকে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং অন্যদের নিয়ে সাদিপুর হয়ে সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এ দলটি বিশ্বনাথে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন। মুক্তিযােদ্ধারা এখানে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর আঘাত হানেন। পাকিস্তানি সেনারা মরিয়া হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর সর্বাত্মক পাল্টা আক্রমণ চালায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২ এপ্রিল অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এম এ মুত্তালিব তামাবিল এলাকায় ১২ উইংয়ের ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে কমান্ড হাতে নেন। ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলা) তেলিয়াপাড়া চাবাগানে মুক্তিযােদ্ধা ও সামরিক অফিসার একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সভাতেই অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম। এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে মনােনীত করা হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত ছিলেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রব (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী ও মেজর শাফায়াত জামিল ৪ এপ্রিল সিলেট শহরের টিবি হাসপাতালে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর মুক্তিযােদ্ধারা একটি বড়াে রকমের আক্রমণ চালান।
বেশ কিছুক্ষণের সংঘর্ষে উভয়পক্ষ ব্যাপক ক্ষতি স্বীকার করলেও পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘাটি ছেড়ে সালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে এ আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার নুরুল হক, ইপিআর বাহিনীর নায়েব সুবেদার গােলাম হােসেন, নায়েব সুবেদার মােখলেসুর রহমান, হাবিলদার ওয়াহিদুল ইসলাম, হাবিলদার নুরুল ইসলাম, হাবিলদার হাফিজউল্লা চৌধুরী প্রমুখ। ৬ এপ্রিল খাদিমনগরে সুবেদার বি আর চৌধুরীর বাহিনী এবং লামাকাজীতে সুবেদার নছিবুর রহমানের বাহিনীর ওপর পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান একই সঙ্গে ব্যাপক হামলা চালায়। এ হামলায় মুক্তিযােদ্ধা ও নিরীহ মানুষ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন। ৭ এপ্রিল বিকালে নায়েব সুবেদার মােশাররফ হােসেন ইপিআর বাহিনীর প্রায় ১টি প্লাটুন নিয়ে খাদিমনগরে সুবেদার বি আর চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হন। ৮ এপ্রিল মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ভারতের শিলচর থেকে ফিরে আসার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী সালুটিকর বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা এলাকা থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর হামলা চালাতে থাকে। পরে জানা যায়, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রস্তুতির সুযােগ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিমানযােগে ঢাকা থেকে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে।
৭ এপ্রিলের মধ্যে সিলেট বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা-বাগানের নিকটবর্তী স্থান ছাড়া সমগ্র সিলেট জেলা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৮ এপ্রিল ভারতীয় বিএসএফ-এর উধ্বর্তন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিমাইয়া মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়পক্ষ সামরিক সাহায্যের প্রশ্নে একমত হলে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ঐদিনই লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিমাইয়ার সঙ্গে ভারতের শিলচর রওনা হয়ে যান। মেজর দত্ত ভারত থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ায় যথাসময় তিনি তার মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একত্র হতে পারেননি। এদিকে পাকিস্তানিরা সালুটিকর বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নিয়ে নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করে নেয়। বিমানে করে ঢাকা থেকেও এদের জন্য রি-ইনফোর্সমেন্ট (সাহায্য) পাঠানাে হয়। নিজেদের সুসংগঠিত করে ১০ এপ্রিল বিকাল ৫টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা খাদিমনগরে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর একই সঙ্গে স্থল ও বিমান হামলা চালায়। জঙ্গিবিমানগুলাে বােমা নিক্ষেপ করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপকভাবে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার করে। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে অস্ত্রের মধ্যে এলএমজি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাপ্টেন মুত্তালিবের নেতৃত্বে ঐ রাতেই পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা পিছনে সরে এসে হরিপুরে পুনরায় প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলে। অন্যদিকে, সুবেদার নছিবুর রহমান ও সুবেদার মজিবুর রহমানও তাদের ইপিআর বাহিনী নিয়ে সুবেদার বি আর চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হলেন। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্য করলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর যাবতীয় সামরিক সরবরাহ সালুটিকর বিমানবন্দরের মাধ্যমেই আসছে। সুতরাং তারা সালুটিকর বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯ এপ্রিল হাবিলদার আব্দুল ওয়াহিদ ১টি মেশিনগান প্লাটুন এবং নায়েক হাফিজউল্লাহ চৌধুরী ১টি মর্টার প্লাটুন নিয়ে গভীর রাতে বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হন এবং আক্রমণ শুরু করেন। প্রায় সারারাত ক্রমাগত বৃষ্টির মতাে। গােলাবর্ষণ অব্যাহত রেখে শেষ রাতে ইপিআর বাহিনীর প্লাটুন ২টি ফিরে আসে। রাতের অব্যাহত গােলাবর্ষণে সালুটিকর বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হলেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানিদের অব্যাহত আক্রমণে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজের কোম্পানি শেরপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বিমানবাহিনীর সাহায্যসহ শেরপুরের অবস্থানে আক্রমণ করে। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হন।২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি শেরপুর থেকে মৌলভীবাজারে পশ্চাদপসরণ করে। এদিকে হরিপুরে সুবেদার বি আর চৌধুরী, সুবেদার মজিবুর রহমান, সুবেদার নুরুল হক ও সুবেদার নজিবুর রহমান প্রমুখ সমগ্র বাহিনীকে পুনর্গঠন। করে সিলেটের পথে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং পাকিস্তানি বিমানগুলাে তাদের ভাবনার অবকাশ না দিয়ে ২০ এপ্রিল ভােরবেলা তিন দিক থেকে আর্টিলারি, মর্টার, মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে অকস্মাৎ আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অস্ত্র বলতে একমাত্র এলএমজি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে ব্যর্থ হন। তারা বিচ্ছিন্নভাবে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন। এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সংঘর্ষে ২০জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষতি স্বীকার করেও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পুনরায় তামাবিলে একত্র হতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মুত্তালিব, সুবেদার বি আর চৌধুরী, সুবেদার মজিবুর রহমান, সুবেদার নছিবুর রহমান প্রমুখ একত্র হয়ে বাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব ও সুবেদার বি আর চৌধুরী বাহিনীটিকে ৩টি কোম্পানিতে বিভক্ত করে ৩টি স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বলেন। সুবেদার নছিবুর রহমানকে ১টি কোম্পানি নিয়ে শ্রীপুর, সুবেদার মজিবুর রহমানকে ১টি। কোম্পানি নিয়ে প্রতাপপুর এবং নায়েব সুবেদার নূর মােহাম্মদকে জাফলং এলাকায় অবস্থান নিতে বলা হয়। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তামাবিল, গােয়াইনঘাট, জৈন্তা, ভােলাগঞ্জ ও কোম্পানগিঞ্জসহ পুরাে সীমান্তবর্তী এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলাের সন্ধান পেয়ে যায়। এবং মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধাদের সবকয়টি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা টিকতে ব্যর্থ। হয়ে ঘাটি ছেড়ে দিয়ে ভারতের সখাপুঞ্জীতে আশ্রয় নেন। এটিই ছিল সিলেট জেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের শেষ প্রতিরােধ যুদ্ধ।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড