You dont have javascript enabled! Please enable it! জয় বাংলা স্লোগান, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং পশ্চিম বাংলা  - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা স্লোগান, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
এবং পশ্চিম বাংলা 

১৯৯৯-এর মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্র,
তাঁর নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে আমাকে বলেছিলেন, “এখানকার বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গান করেন ঠোঁট দিয়ে । বাংলা, বাংলার প্রকৃতি, বাঙালিত্ব, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি সম্পর্কে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছুমাত্র ধারণা নেই । হয়তো অন্যকিছু করার নেই, তাই টেগোর টেগোর করা । তাঁদের গানে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় না । যা পাওয়া যায় বাংলাদেশের শিল্পীদের কন্ঠে । কারণ তাঁরা গান করেন ঠোঁট দিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করে।”

সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর, ইদানিং পশ্চিম বাংলায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা কথা ইত্যাদিতে অশোক মিত্র-র উপরে উল্লেখিত কথাগুলো স্মরণে
এলো ।

মনে প্রশ্ন জাগছে, যে, ভোট বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতেই কি অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে তুলে আনা হয়েছে ? যদি এর দ্বারা কিছু ক্ষয় রোধ হয় । না-কি সত্যিই বাংলা ও বাঙালির শিক্ষা, অর্থনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির বর্তমান সংকটজনক অবস্থা থেকে উত্তরণে … ?

যদি সত্যিই বাংলা ও বাঙালি চিন্তা থেকে জয় বাংলা স্লোগান কন্ঠে ধারন করা হয়ে থাকে, তবে তো শুধু স্লোগানে নয়, চাই বাংলা ও বাঙালির পক্ষে ঘোষিত কর্মসূচি, কিন্তু কোথায় সেই কর্মসূচির ঘোষণা ?

প্রায় তিন দশকের অধিক সময় ধরে,‌ বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বিষয়ে নিজস্ব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে বুঝেছি, যে, এপারের সিংহভাগ মানুষের ধারণা, বাংলাদেশ থেকে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা কিছু নেওয়ার নেই । এমনকী কারো কারো (একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষিত হওয়ার আগে ) মন্তব্য ছিল,একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিষয় … । শুধু তাই নয়, নিজস্ব সম্পাদিত ‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকায় জয় বাংলা লেখার কারণে নানা তির্যক মন্তব্য বা কটাক্ষ হজম করতে হয়েছিল ।

ইদানিং তাঁদের অনেকেই দেখছি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বেশ মজেছেন । কর্মসূচিহীন শুধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মজতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, একি শুধু অন্তঃসারশূন্য ঠোঁটের উচ্চারণ, না …?

১৯৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলনের সূচনা, তা একটি বড় বাঁক নেয় ১৯৬৬ সালে লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমান-এর দেওয়া ছয় দফা ঘোষণা ।

পরবর্তীতে এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন এবং আইয়ুব স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার গণমানুষের আন্দোলন, যা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের মধ্য থেকে উঠে আসে সংগ্রামের প্রধানতম হাতিয়ার জয় বাংলা । যা নিছক একটি স্লোগান মাত্র নয়, ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের এগারো দফা কর্মসূচি রূপায়ণ করার অন্যতম হাতিয়ার ।

যদি পশ্চিম বাংলায় কর্মসূচিহীন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুধু কৌশলগত স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে, সামনে আনা হয়, তবে তা অন্তঃসারশূন্য হয়ে শুধু ব্যর্থ হবে তাই নয়, জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, তাও কিছু পরিমাণে বিনষ্ট হবে বলে আশঙ্কা হয় ।
কারণ বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে জয় বাংলা শুধু
একটি ধ্বনি বা স্লোগান মাত্র নয়, তা তাদের প্রাণের উচ্চারণ ।

অন্যদিকে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, সংক্রামক রোগের নাম পশ্চিম বাংলায় দেওয়া হয়েছিল
‘জয় বাংলা’।

এর পুনরাবৃত্তি আর যেন না ঘটে ।

লেখক – কেশব মুখার্জী