You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966 | ছয়দফা সম্পর্কে মুজিবের ব্যাখা - সংগ্রামের নোটবুক
ছয়দফা সম্পর্কে মুজিবের ব্যাখা
লাহাের থেকে ঢাকায় ফিরে ১১-২-৬৬ তারিখে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব তার দলের ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাখা করেন। তিনি বলেন যে, পাক ভারত যুদ্ধের পর এটা পরিষ্কার হয়েছে পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা রক্ষা করতে হলে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এর উভয় অংশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে সকল বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। একটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে শক্তিশালী করলেই যে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হবে- এমনটি ঠিক নয়। বরং একটি যুক্তরাষ্ট্রের সকল ফেডারেটিং ইউনিটগুলােকে শক্তিশালী করতে পারলেই উক্ত রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হবে। সুতরাং পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে এবং এর উভয় অংশের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি করতে হলে ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে হবে। স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে অন্য দলের নেতাদের মনোভাব আওয়ামী লীগ যে সময় ছয় দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের কিছু দল ও নেতাও সংসদীয় গণতন্ত্র কিংবা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করছিলেন। যদিও এসব দল কিংবা নেতা শেখ মুজিব-বিরােধী ছিলেন কিন্তু শেখ মুজিবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তারা উপেক্ষা করতে পারেননি। 
জাতীয় পরিষদের বিরােধীদলীয় নেতা নূরুল আমিন, যিনি এক সময় পূর্ব পাকিস্ত গনের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং যার মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয় সেই নূরুল আমিনও বলতে শুরু করেন যে, দেশের অখন্ডতা ও সংহতি নির্ভর করে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের আলােকে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে। তিনি মন্তব্য করেন যে আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট-শাসিত সরকার দিয়ে দেশের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। পূর্ব পাকিস্তানের আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বলেন যে, ভৌগােলিক অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার একমাত্র উপায় হল দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। তার মতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে বাকি ক্ষমতা প্রদেশসমূহকে প্রদান করতে হবে। তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ডেপুটি নেতা (১৯৬৫-৬৯) শাহ আজিজুর রহমান ১৯৬৫-৬৬ সালের জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় বলেন যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার মাধ্যমেই পাকিস্তানকে শক্তিশালী করা সম্ভব।  উপরের আলােচনা থেকে লক্ষ্য করা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি একটি সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়। কিন্তু এই দাবিকে সাংগঠনিকস্বরূপ দেয়া ও দাবি বাস্তবায়নের জন্য একটি গণআন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ।
ছয়দফার প্রচারণা
শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সারাদেশ জুড়ে ছয়দফার প্রচার শুরু করেন। ছয়দফা অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এতে করে আইয়ুবমােনেম চক্র আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় জেল-জুলুম । শেখ মুজিব যেখানেই জনসভা করতে যান সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। একটা মামলা দায়ের করা হয়, আবার জামিনও দেয়া হয়। ৬ দফার প্রচারণার এক পর্যায়ে ৮ মে ১৯৬৬ শেখ মুজিব দেশরক্ষা। আইনে গ্রেফতার হন। এই গ্রেফতারের পূর্বে ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫০ দিনে তিনি। ৩২টি জনসভায় ভাষণ দেন। এই সময়সীমার মধ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ৬ দফার। পক্ষে যে অভাবনীয় জনমত সৃষ্টি করেন, তা সত্যিই এক অকল্পনীয় ব্যাপার। শেখ মুজিবই নন, ১০ মে ১৯৬৬ সালের মধ্যে দলের প্রায় ৩৫০০ নেতা-কর্মী। গ্রেফতার হন। কিন্তু শেখ মুজিব তার আগেই সব কিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে কর্মী বাহিনী যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তার সংগঠনকে। ইতােমধ্যে ছাত্রলীগও ছয়দফার প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ে। সে-সময় আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র ইউনিয়নের সহায়তায় আবদুর রাজ্জাকাক ৬ দফার ৫০,০০০ হাজার লিফলেট ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে বিলি। করেছিলেন। ন্যাপের যে-অংশ ৬ দফার সমর্থক ছিলেন তারা সংবাদ থেকে ৬ দফার। লিফলেট ছাপিয়ে দিতেন। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ৭ জুন ১৯৬৬ গােটা প্রদেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশের শ্রমিকশ্রেণী প্রথমবারের মতাে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এতদিন শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে আওয়ামী লীগের তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না।
কিন্তু ৭ জুনের হরতালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকরা জড়িয়ে পড়ে। হরতালের খবর সংবাদপত্রে ছাপানাে নিষিদ্ধ ছিল, তাই ৭ জুনের হরতালের বিবরণ কোনাে সংবাদপত্রে পাওয়া যায় না। আবু আল সাঈদ তার গ্রন্থে কোনাে রেফারেন্স ছাড়াই ৭ জুনের নিমলিখিত বিবরণ দিয়েছেন : ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সকাল থেকেই হরতাল শুরু হল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে। সকাল নয়টার দিকে তেজগাঁও শ্রমিক এলাকায় প্রচ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি চালালে বেঙ্গল বেভারেজে চাকরিরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যায়। মনু মিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শ্রমিক সমাজ। তাদের সাথে যােগ দেয় ছাত্র জনতা। তারা তেজগাঁয় সকল ট্রেন থামিয়ে দেয়। তেজগাঁ। স্টেশনের কাছে নােয়াখালীর শ্রমিক আবুল হােসেন (আজাদ এনামেল এ্যান্ড এ্যালুমিনিয়াম কারখানা) ই,পি,আর,-এর রাইফেলের সামনে বুক পেতে দেন। ইপিআর বাহিনী তার বুকেও গুলি চালায়। অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত এলাকায় শ্রমিক এবং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢাকা শহর উত্তাল করে তােলে। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন ঘটনাস্থলেই। ফলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে সর্বস্তরের শত শত মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের উস্কানির মুখে জনগণ থানার মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের ছিনিয়ে নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পরপরই ঢাকার শ্রমিক এলাকাগুলােতে কারফিউ জারি করা হয়। গ্রেফতারের সংখ্যাও সন্ধ্যার মধ্যে দেড় হাজার ছাড়িয়ে যায়। ৮ জুনের সংবাদপত্রে কেবল সরকারি প্রেসনােট ছাপা হয়। পাকিস্তান অবজারভার চতুরতার সঙ্গে উক্ত প্রেসনােট ছাপে। অবজারভার নিমলিখিত মন্তব্যসহ প্রেসনােটটি পত্রিকায় ছাপে :
“We are not publishing our staff. correspondents’ reports on the incidents owing to some unavoidable circumstances-Editor উক্ত প্রেসনােটে ৭ জুনের হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত হয়েছে। বলে উল্লেখ করা হয়। প্রেসনােটে যদিও ঘটনার সত্য বিবরণ কম থাকে, তথাপি ৭ জুনের হরতাল বিষয়ে দেয়া সরকারি প্রেসনােটটি থেকে হরতালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের চিত্র পাওয়া যায়। প্রেসনােটটি নিমরূপ : ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত (সরকারি প্রেসনােট) ঢাকা ৭ই জুন, আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহূত হরতাল ৭-৬-১৯৬৬ তারিখে অতি  প্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনের ব্যাপক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছােকরা ও গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেয়া হয় । ইপিআরটিসি বাসগুলিতে ইট-পাটকেল ছোড়া হয় এবং টায়ারের পাম্প ছেড়ে দিয়ে। সর্বপ্রকার যানবাহনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। নিরীহ জনসাধারণ ও অফিস যাত্রীদের অপমান ও হয়রানি করা হয়। হাইকোর্টের সম্মুখে তিনটি গাড়ি পােড়াইয়া দেওয়া হয় । পুলিশ কার্জন হল, বাহাদুর শাহ পার্ক ও কাওরান বাজারের নিকট গুণ্ডাদের বাধা দান করে এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করিয়া তাহাদেরকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয় ।  তেজগাঁও দুই-ডাউন চট্টগ্রাম মেইল তেজগাঁও রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালে আটক করিয়া লাইনচ্যুত করা হয়। ট্রেনখানা প্রহরা দানের জন্য একদল পুলিশ দ্রুত তথায় গমন করে। জনতা তাদের ঘিরিয়া ফেলে এবং তুমুলভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, ফলে বহু পুলিশ কর্মচারী আহত হয়। যখন পুলিশ জনতার কবলে পড়িয়া যাবার উপক্রম হয় তখন আত্মরক্ষার জন্য তাহারা গুলিবর্ষণ করে। ফলে ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। 
নারায়ণগঞ্জের এক উদ্ধৃঙ্খল জনতা সকাল ৬-৩০ মিনিটের সময় গলাচিপা রেলওয়ে ক্রসিং-এর নিকট ঢাকাগামী ট্রেন আটক করে। পরে জনতা নারায়ণগঞ্জগামী ৩৪নং ডাউন ট্রেন আটকাইয়া উহার বিপুল ক্ষতিসাধন ও ড্রাইভারকে প্রহার করে । জনতা জোর করিয়া যাত্রীদের নামাইয়া দেয়। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য আগত একটি পুলিশ দল আক্রান্ত এবং বহুসংখ্যক পুলিশ-কর্মচারী আহত হয়। পুলিশ দল লাঠিচার্জের সাহায্যে জনতা ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। অতঃপর বন্দুকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করিয়া দারুণ ক্ষতিসাধন এবং বন্দুকের গুলিতে পুলিশ অফিসারদের জখম করে। উচ্ছল জনতা থানা ভবনে প্রবেশ করার পর পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করার ফলে ৬ ব্যক্তি নিহত হয় ও আরও ১৩ ব্যক্তি আহত হয় ৪৫ জন পুলিশ আহত হন এবং তাহাদের মধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর । টঙ্গীতে বিভিন্ন মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে এবং একটি মিছিল বের করে ।…ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর ছাত্র পিকেটিং করে এবং সেখানে আংশিক ধর্মঘট পালিত হয়। দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগণ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করিয়া শশাভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ই.পি.আর বাহিনীর একটি দল শােভাযাত্রার গতিরােধ করে। অপরাকে এক জনতা গেণ্ডারিয়ার নিকট একখানি ট্রেন আটক করে। চট্টগ্রামগামী গ্রীন-এ্যারাে ও ঢাকা অভিমুখী ৩৩-আপ ট্রেনখানিকে অপরাহ্বের দিকে তেজগাঁও স্টেশনে আটক করা হয় । ….সন্ধ্যার পর একটি উচ্চুঙ্খল জনতা কালেক্টরেট ও পরে স্টেট ব্যাংক আক্রমণ করে। রক্ষীগণ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষণ করে। বেলা ১১টায় ৫ বা ততােধিক ব্যক্তির একত্র সমাবেশ ও শােভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়া ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিল।
সূত্র : স্বাধীনতার দলিলপত্র, ২য় খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭০। ৭ জুনের পরবর্তী ঘটনাবলি
৭ জুনের হরতালের সময় পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ৮ জুন ন্যাপ-দলীয় নেতৃবৃন্দ যৌথভাবে এক প্রচারপত্র প্রচার করেন (ইস্ট পাকিস্তান প্রস, ২৬৩ বংশাল রােড, ঢাকা থেকে)। দীর্ঘ এই প্রচারপত্রে নেতৃবৃন্দের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এখানে অংশবিশেষ উল্লেখিত হল।  জালিমশাহীর গুলিতে আবার জনতার রক্ত ঝরিয়াছে। গত ৭ জুন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ তেজগায় পুলিশের গুলিতে এদেশের শান্তিকামী মানুষকে আবার জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছে। সরকারি হিসাবমতেই গুলিবর্ষণে নিহতদের সংখ্যা এগারাে। জন। অগণিত মানুষ আহত হইয়াছেন। দেড় হাজার ব্যক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা। হইয়াছে । ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে। জনতাকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে সামরিক ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হইয়াছে । দমননীতির প্রয়ােগে। দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হইয়াছে। রাজবন্দিদের মুক্তি ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের আহ্বানে গত ৭ই জুন তারিখে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। হরতালের সাফল্য শাসকচক্রকে হতচকিত করিয়া তােলে এবং ইহাকে বানচাল করার। জন্য সরকার নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর পুলিশ বাহিনী লেলাইয়া দেয় ও পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।
রুটি, রুজি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত জনতার উপর গুলিবর্ষণ ইহাই প্রথম নয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের মাদ্রাসায় কৃষকদের উপর; ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্রদের উপর; টংগী, খুলনা ও চট্টগ্রামে কালুরঘাট শ্রমিকদের উপর; সুশং, সানেশ্বর, নাচোল, মাগুরা ও বালিশিয়ার কৃষকদের উপর এবং ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে দেশপ্রেমিক রাজবন্দীদের উপর গুলি চালাইয়া ইতােপূর্বে শত শত ব্যক্তিকে হত্যা করা হইয়াছে। | পেশােয়ারের চারসাদ্দার জনসভার উপর গুলিবর্ষণ এবং বেলুচিস্তানের ঈদের জামাতে বােমা বর্ষণ করা হইয়াছে। পাঞ্জাব ও করাচীতে ছাত্র হত্যা করা হইয়াছে। বেলুচিস্তান ও সরহাদের ন্যাপ-নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানাে হইয়াছে। ৭ই জুনের দমননীতি এই নির্মম দমননীতিরই অন্যতম বীভৎস নজির। গত ১৯ বৎসর যাবত পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর চরিত্রের স্বরূপ সাময়িক ব্যতিক্রম বাদে মােটামুটি একইরূপ হইলেও নৃশংসতায় বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরীদের অনেক পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছে । গদি রক্ষার তাগিদে ঈদের জামাত অথবা রাজপথের শাস্তি পুর্ণ জনতার উপর পাশবিক হত্যালীলা চালাইতেও এই সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নাই।
সূত্র : স্বাধীনতার দলিলপত্র, ২য় খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭১।
৮ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বিরােধীদল কর্তৃক উত্থাপিত পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের গুলিবর্ষণ সংক্রান্ত তিনটি মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার বাতিল করেন। প্রতিবাদে বিরােধীদলীয় সদস্যগণ পরিষদকক্ষ বর্জন করেন। একই দিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনেও মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে বিরােধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যগণ পরিষদকক্ষ বর্জন করেন। ৭ জুন পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ৮ জুন সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি। ৯ জুনের সংবাদে এ প্রসঙ্গে নিমলিখিত ব্যাখা দেয়া হয় : | যে মর্মান্তিক বেদনাকে ভাষা দেয়া যায় না সেখানে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। তাই গতকল্য সংবাদ প্রকাশিত হইতে পারে নাই। আমাদের এই নীরব প্রতিবাদ একক হইলেও ইহাতে আমাদের পাঠকরাও শরিক হইলেন, ইহা আমরা ধরিয়া লইতেছি ।
সরকারি দমন নীতি
৭ জুনের ঘটনার পর সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ১৩ জুনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতারাও গ্রেফতার হয়ে গেলেন। ১৫ জুন ‘ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হল। ১৬ জুন ‘ইত্তেফাক’ নিষিদ্ধ ঘােষণা করে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হল। আওয়ামী লীগ কর্মী গ্রেফতার করা অব্যাহত থাকে। ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ৯,৩৩০ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।  ছয় দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি ঘােষণার মাধ্যমে । ছয়দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের পর্যায় শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি যে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে তার বিরুদ্ধে। বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারিত হয় ছয় দফা দাবি ঘােষণার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবিকে ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ছয়দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব অর্থনৈতিক সম্পদ, আভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক আয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করা হয়। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার ক্ষমতাও দাবী করা হয়। ১৯৬৬ সালে ঘােষিত ছয় দফা দাবির সঙ্গে ১৯৪৭-৬৫ সময়ে ঘােষিত দাবির মধ্যে পার্থক্য এই যে, পূর্বে যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকার সুযােগ-সুবিধাদানের দাবি জানান হয়, ছয় দফায় সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যেন নিজে নিজেই আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারে কেন্দ্রের কাছে সে অধিকার চাওয়া হয়। অর্থাৎ ছয়দফা। দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী হওয়ার আকাক্ষা ব্যক্ত করা হয়। ছয়দফা দাবিকে বাঙালির মুক্তিসনদ বলা হয়। ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসক গােষ্ঠীর শােষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। ইতােপূর্বে ভাষার দাবিতে ভাষা আন্দোলন, ছাত্রদের দাবি ভিত্তিক শিক্ষা আন্দোলন হলেও ছয়দফার আন্দোলন ছিল সর্বস্তর ও পেশার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন। পূর্বের আন্দোলনগুলির ছাত্ররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু ছয়দফার আন্দোলন ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত সুসংগঠিত আন্দোলন। এ আন্দোলনে মুখ্যভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনসমূহ। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সারাদেশে জনসভা করে এ আন্দোলনকে প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে দেন। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতার পরিণত হন। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায় । পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদেরকে ধরপাকড় ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে। সাময়িকভাবে আন্দোলনকে স্তিমিত করতে পারলেও ছয়দফা দাবিগুলােকে বাঙালির মন। থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। এর প্রমাণ হচ্ছে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় ছাত্রদের যে এগারদফা দাবি ঘঘাষিত হয় তার মধ্যে ছয়দফার মূল বিষয়গুলাে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছয়দফাকে দাবিসমূহে সন্নিবেশিত করা হয়। ছয়দফা এতােটাই জনসমর্থন লাভ করেছিল যে, বঙ্গবন্ধু ছয়দফাকেই নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসেবে ঘােষণা করেন। ছয়দফা ও এগার দফার আন্দোলনের সময় বাঙালির মধ্য যে সচেতনতা ও ঐক্য গড়ে ওঠে তার ফল পাওয়া যায় সত্তরের নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারণায় বলা হয় যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করা সম্ভব ছয়দফার বাস্তবায়নের মাধ্যমে। পূর্ব পাকিস্তানবাসী তা বিশ্বাস করে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়ে জয়ী করে। আর ছয়দফার বিরােধীদের অপমানজনক পরাজয় ঘটে। নির্বাচনের মাধ্যমে ছয়দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের রায় পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তা আর অগ্রাহ্য করার উপায় ছিল না। কিন্তু নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে শাসন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। সেকারণে বলা যেতে পারে যে, ছয়দফা আন্দোলনে স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।
২. আগরতলা মামলা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আগরতলা মামলাটি একটি মাইলফলক। পাকস্তিান সরকার ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ঘােষণা করে, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য একটি ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা, সিভিল সার্ভিসের দুইজন কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি ঘােষণা করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে জড়িত এবং তাকে এক নম্বর আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এর জন্য একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এই মামলার সরকারি নাম রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। লােকমুখে এই মামলা পরিচিতি লাভ করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে। বঙ্গবন্ধু এই মামলার নামকরণ করেছিলেন ইসলামাবাদ যড়যন্ত্র মামলা’ নামে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য ছিল এই প্রচেষ্টা, তাই এটি ষড়যন্ত্র হতে পারে না। সে জন্যই একে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু আগরতলা মামলা নামে।
এই মামলায় অভিযােগ করা হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় সেনা। অফিসারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিব ভারতের সহযােগিতায় সশস্ত্র উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য ১৯৬২ সালে তিনি গােপনে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা যান। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গেও যােগাযােগ হয়। সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের ভূমিকা ছিল বেশি। | এখন এটি প্রমাণিত যে, এই মামলার ভিত্তি ছিল। তবে বিভিন্ন তথ্য দেখে, স্মৃতিচারণ পড়ে মনে হয়, পাকিস্তান সরকার বা কুশীলবরা যেভাবে বিষয়টি সাজিয়েছিল আসলে সেটি তেমন কিছু ছিল না।
তবে, অভিযুক্তরা দেশকে মুক্ত করার জন্য ভেবেছিলেন, একটি পরিকল্পনা করেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তারা অবশ্যই জাতীয় বীর। আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত তৎকালীন ক্যাপ্টেন শওকত আলীর স্মৃতিকাহিনী পড়ে। এ ধারণা হয় যে, তিনটি বিষয়কে একত্রিত করে পাকিস্তান সরকার মামলা সাজিয়েছিল। লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন প্রধানত নৌ সদস্যদের নিয়ে আলােচনা করছিলেন ১৯৬২-৬৩ থেকে এবং অধিকাংশই ছিলেন নিম্ন পর্যায়ের অফিসার। ক্যাপ্টেন শওকতরা প্রধানত একই উদ্দেশ্যে আলাপ করছিলেন মূল বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে। সিভিল সার্ভিসের রুহুল কুদুস, আহমেদ ফজলুর রহমান ও খান শামসুর রহমান অন্যান্যরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গেও হয়তাে তাদের আলাপ হয়েছিল; কারণ এরা সবাই ছিলেন বাঙালি প্রেমী । কিন্তু ঐক্যবদ্ধ কোনাে পরিকল্পনা তাঁরা নিতে পারেননি। শওকত আলীদের কাছে মনে হয়েছে মােয়াজ্জেম হােসেন তাড়াহুড়া করছেন এবং গােপনীয়তা সম্পর্কেও তিনি সজাগ নন। ফলে সেনা সদস্যরা ধরা পড়েন। বঙ্গবন্ধু এই প্রয়াসের সঙ্গে হয়তাে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। প্রশ্রয় হয়তাে ছিল। কিন্তু তিনি যে মুক্তির প্রচেষ্টায় আগরতলা গিয়েছিলেন তা তাে সত্য; স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন তাও তাে সত্য। গােয়েন্দা দফতর তা জানত। পাকিস্তান সরকার তাঁকে হেনস্থা করার জন্য এ মামলা করেছিল। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে তারা প্রচার করতে চেয়েছিল- শেখ মুজিব ভারত বা হিন্দুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙতে চাচ্ছেন।
এই মামলার ফল হয়েছিল উল্টো। বাঙালির মনে এই ধারণা হল যে শেখ মুজিব যেহেতু বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফা আদায় করার জন্য লড়ছেন সে কারণেই তাকে ফাঁসানাে হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু তাে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে। এই সময় আইয়ুব খানবিরােধী আন্দোলন দানা বাঁধছিল। এখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি প্রধান হয়ে উঠল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে গঠন করে ‘ড্যাক’। ইতােমধ্যে মামলার শুনানি শুরু হলে পত্রিকাগুলি ফলাও করে প্রচার করতে থাকে অভিযুক্তদের প্রতি কী অত্যাচার করা হচ্ছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও আগরতলা মামলা। প্রত্যাহারের দাবি জোরদার হতে থাকে। পাকিস্তান সরকারও আন্দোলন দমনে গুলির পথ। বেছে নেয়। ইতােমধ্যে ছাত্রসহ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের নিপীড়নে আহত হয়েছেন অনেকে। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট মােহাম্মদ ফজলুল হককে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। হাসপাতালে জহুরুল হক মারা গেলে ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকাবাসী রাস্তায় নেমে আসে। আইয়ুব খান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি এক গােলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন ও প্যারােলে শেখ মুজিবকে যােগ দেওয়ার আমন্ত্রণ। জানান। শেখ মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলন আরাে জোরদার হয়ে উঠলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা মামলা শুধু প্রত্যাহার নয়, বিনা শর্তে সকল অভিযুক্তকেও মুক্তি দেয়।
এই মামলার ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ। এলএফসিডিআই নুর মােহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরাল আবদুস সামাদ, অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্স সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাে. ফজলুল হক, বিভূতিভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, অবসরপ্রাপ্ত ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট মাে. আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, এবি খুরশীদ, খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি, একেএম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মাে. আবদুল মােতালেব, ক্যাপ্টেন শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট এম রহমান, অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার তাজুল ইসলাম, আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ ও লেফটেন্যান্ট আব্দুর রউফ।
আগরতলা মামলার বিচারকার্য পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বেলা এগারটায় কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের একটি বিশেষ কক্ষে মামলার শুনানি শুরু হয় পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২-ক এবং ১৩১ ধারা অনুসারে। মামলার চার্জশিটে ছিল ১০০ অনুচ্ছেদ। সাক্ষীর সংখ্যা ছিল সরকার পক্ষে ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মােট ২২৭ জন। প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের নিয়ে একটি আত্মপক্ষ সমর্থকদের দল গঠন করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা ব্রিটেনের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে  বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে প্রেরণ করেন।  তাকে সহযােগিতা করেন আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রধান কৌসুলী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের ও অ্যাডভােকেট জেনারেল টি, এইচ খান। ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস এ রহমান। অপর দুই বিচারপতি ছিলেন এম আর খান ও মকসুমুল হাকিম। ২৯ জুলাই ১৯৬৮ মামলার শুনানি শুরু হয়। এ সময় স্যার টমাস উইলিয়াম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ৫ জুলাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে গেলে ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলার আর কিছু ছিলনা।
সহায়ক গ্রন্থ
মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ : বাঙালি মানুষ, রাষ্ট্র গঠন ও আধুনিকতা, ঢাকা ২০০৭ হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ২য় খণ্ড।

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান