জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন
জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজম নিয়ে শুধু প্রবন্ধ নয়, অনেক বইও লেখা হয়েছে। এর সংজ্ঞা, স্বরূপ নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। আমরা এখানে বিতর্ক নয়, সাধারণ একটি আলােচনা করব। প্রতিটি দেশের মানুষেরই নিজ জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভৌগােলিক অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে একটি আবেগ আছে। একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়েও সে আবেগ থাকতে পারে। জাতীয়তাবাদ সে আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মার্কসবাদীরা মনে করেন, প্রধানতঃ পুঁজিবাদী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র প্রকাশক আদর্শ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। এর দুটি দিক আছে, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ যা প্রকাশ পায় অপর জাতিরাষ্ট্রকে আক্রমণ দখল বা জাতিগত নিপীড়নের মাধ্যমে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি জার্মানীর জাতীয়তাবাদ। অন্যটি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী/শােষক শাসক/রাষ্ট্রের থেকে মুক্তি যেমন ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বলীয়ান হয়ে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলার জাতীয়তাবাদের ধারা খুঁজতে গেলে আঞ্চলিকতার বিষয়টিও আলােচনায় আনতে হবে। আগে উল্লেখ করেছি বাংলার বিভিন্ন নরগােষ্ঠী বসবাস করতে যাদের পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল ক্ষীণ। সভ্যতার বিস্তৃতির ফলে, বিভিন্ন কৌমের পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৌমের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। বৃহত্তর কৌম, যেমন-বঙ্গ, রাঢ়, পুত্র প্রভৃতি। এই কৌমচেতনা প্রাচীন যুগে তাে বটেই, মধ্যযুগেও ছিল এবং এখনও বহমান।
কৌমচেতনার সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছিল আঞ্চলিক স্মৃতি এবং চেতনার। বঙ্গ, রাঢ়, পুণ্ড প্রভৃতি জনপদগুলি পাল (আনুমানিক ৭৫০ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) ও সেন রাজারা (আনুমানিক ১০৯৫-১২৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আঞ্চলিক চেতনা তবু লুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে, সর্বভারতের পটভূমিকায় জাতীয়, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক চেতনার কথা আলােচনা করা দরকার। জাতীয় চেতনার ক্রমবিকাশ হয়েছিল পশ্চিম ইউরােপে এবং এর পেছনে কাজ করেছিল পুঁজিবাদী শক্তি। এর কারণ, বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণী চেয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের বেড়াজাল ভেঙ্গে নতুন বাজারের সৃষ্টি করতে যা co-extensive with a definite culturally-politically unified or unifitable territory, could be brought into existence with popular support. ভাষা ছিল এ চেতনার একটি প্রধান মাধ্যম। বুর্জোয়ারা, নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে তখন সচেতন করে তুলেছিল জনগণকে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সত্তা সম্পর্কে এবং এ জন্যে প্রয়ােজনবােধে সৃষ্টি করা হয়েছিল বিভিন্ন ‘মিথ’। এটিই হল জাতীয়তাবাদ এবং তা সাহায্য করেছিল বুর্জোয়াদের জনগণকে সংগঠিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক শাসনাধীন রাষ্ট্রগুলিতে জাতীয় আন্দোলন ছিল প্রাথমিকভাবে উপনিবেশের বিরুদ্ধে, যাতে বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে এবং নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সমাজকে পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত করতে পারে। সুতরাং জাতীয়তাবাদের উৎস শুধু হৃদয়াবেগ বা দেশের প্রতি ভালবাসাই নয়, অন্য কিছুও।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে দেখা গেছে, নিজেদের স্বার্থেই ব্রিটিশরা যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি করে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল যার সঙ্গে যােগ ছিল মেট্রোপলিটনের। ঐ সময় বিভিন্ন অঞ্চলের অসংহত বুর্জোয়াদের উৎসাহিত করা হয়েছিল বিদেশী পুঁজি ও ব্যবসার সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্যে। উপ-আঞ্চলিক, আঞ্চলিক বা সর্বভারতীয় পর্যায়ে উঠতি ভারতীয় বাঙালি বুর্জোয়াদের স্থান ছিল অধস্তন। কিন্তু তারা চায়নি নিজেদের বাজারের ওপর বিদেশীদের আধিপত্য। নিজেদের বিকাশের জন্যে তাদের প্রয়ােজন ছিল ঐ বাজারের। কিন্তু এ বিরােধী ভূমিকা কখনও ছিল না বিপ্লবাত্মক বরং তা ছিল সমঝােতাপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে, ঐ সময়ে বুর্জোয়ারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছিল এবং গুরুত্ব আরােপ করেছিল এর বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের ঐক্যের। প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে ভারতে জাতীয় চেতনা বলে কিছু গড়ে ওঠেনি। ঔপনিবেশিক আমলে, আরাে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছিল এবং এর দুটি ধারা ছিল বহমান- একটি সর্বভারতীয়, অপরটি আঞ্চলিক। প্রথমটির ভিত্তি ছিল- সর্বভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য দ্বিতীয়টির ভিত্তি ছিল স্ব স্ব অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং নিজ অঞ্চলের লােক সমষ্টির ঐ অঞ্চলের বাজার ও সম্পদ ব্যবহারের সুযােগ। জাতীয় চেতনার মধ্যে আঞ্চলিক চেতনার এই অবস্থানের ভিত্তিতে আবার অনুপ্রবেশ করেছে প্রাচীন বাংলার অতীত এবং ঐতিহ্য।
প্রাচীন বাংলা সম্পর্কে নীহাররঞ্জন রায় লিখেছিলেন, “ভূমি নির্ভর কৃষি জীবনের কারণে কৌম ও আঞ্চলিক চেতনা কাজ করেছিল। আঞ্চলিক চেতনার মধ্যে ভূমি নির্ভরতার এই অনুপ্রবেশ ক্রিয়াশীল দেখতে পাই বিকাশমান মধ্য বা বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে। ঐ সময় একই সঙ্গে সর্বভারতীয়, আঞ্চলিক (বাংলা) ও উপ-আঞ্চলিক (পূর্ববঙ্গ)এই চেতনাত্ৰয় কাজ করেছিল। বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য সর্বভারতীয় পরিসরে সুবিধা ছিল বেশি। সে জন্যে সে চেয়েছিল সর্বভারতীয় চেতনার বিকাশ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আবার আঞ্চলিক চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল সে, যেমন বঙ্গভঙ্গের সময় কলকাতার বিরুদ্ধে আবার পূর্ববঙ্গের কাঠামােগত দুর্বল মধ্যশ্রেণীর উপ-আঞ্চলিক চেতনা কাজ করেছিল। ঐ মধ্যশ্রেণীর মতে, তাদের অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল চলে যাচ্ছিল কলকাতায়, কিন্তু পাচ্ছিল না ন্যায্যমূল্য। পূর্ববঙ্গের যােগাযােগ ব্যবস্থাও ছিল অবহেলিত। এ সব কিছুর পরিচয় পাব আমরা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মধ্যশ্রেণীর বাহন সংবাদ/সাময়িক পত্রগুলিতে। এই চেতনায় সহায়তা করেছিল আবার ভূমিনির্ভর জীবন, শিল্পের অভাব। এই উপ-আঞ্চলিক চেতনা পূর্ববঙ্গবাসীর মন থেকে একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি কখনও। সে চেতনা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে (১৯৭১) সহায়তা করেছিল ভাষা এবং জাতি হিসেবে বাঙালির একত্বতা গড়ে উঠলেও পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের এমন কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে যা দুটি অঞ্চলকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। প্রকৃতিগত দিক থেকেও পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পার্থক্য আছে। কারণ, পূর্ববঙ্গ নদীমাতৃক অঞ্চল।
এছাড়া সংস্কৃতিগতভাবেও যে প্রাচীনকালে দুটি অঞ্চলের খুব মিল ছিল এমন কথা বলা যায় না। যেমন রাঢ় (বা পশ্চিমবঙ্গ)-এর ওপর প্রভাব পড়েছিল। বেশি উত্তর ভারতীয় কালচারাল ইডিওমস’-এর যার উদাহরণ ঐ অঞ্চলের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে, অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন এই বলে যে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব রাঢ় অঞ্চল থেকে কিছুটা কম ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক প্রশ্নে প্রায় এক এবং রাঢ় ও সংলগ্ন অঞ্চল ঐ প্রশ্নে স্বতন্ত্র। এর একটি কারণ বােধ হয় এই যে, পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের আগমন এবং তারপর তাদের সংগঠিত ধর্মজীবন ও কৃষি বাণিজ্যের প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল উত্তরাঞ্চলে। এক কথায় মুসলমানদের আগমন, মসজিদ নির্মাণ ও তাকে ঘিরে পতিত জমি উদ্ধার ও সংগঠন, বিশেষ করে সুফীদের প্রভাব গ্রাস করেছিল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে। এখনও ঐসব অঞ্চলে সুফীদের সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তী সেই স্মৃতিই বহন করে। এভাবে, একসময়, উত্তরাঞ্চল রাঢ়ের সংলগ্ন ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে থাকা সত্ত্বেও কালক্রমে ঐ প্রশ্নে তা পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিকতার বলয়ে লীন হয়ে গিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, ঐ ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে এই একক বা ভৌগােলিক সীমানা স্থান করে নিয়েছিল যা জেনারেশনের পর জেনারেশনের ভালােবাসায় সিক্ত হয়েছে। এই বােধ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে ১৯৭১ সালে যখন ঘােষণা করা হয়েছে এই একক নিয়েই গঠিত হবে বাংলাদেশ। ক. সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘােষণা করেছিলেন। এই একই সময় বাঙালির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও পরিচালিত হয়।
ছয়দফা আন্দোলন দমনের জন্য কেবল রাজনৈতিক নেতা কর্মীদেরকে গ্রেফতার কিংবা গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি। তারা পূর্ব পাকিস্তানীদের ভাষা ও সাংস্কৃতির ওপর নগ্ন হামলা চালায়। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলােকপাত করা হলাে:
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা
১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ইতিপূর্বে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরােধীদলীয় সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন যে, পাকিস্তানী আদর্শের সঙ্গে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে। খান এসবুর পহেলা বৈশাখ উদযাপন এবং রবীন্দ্র-সংগীতকে হিন্দু-সংস্কৃতির অংশ বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় পরিষদের এই বিতর্কের সংবাদ ঢাকার সংবাদপত্রে (দৈনিক পাকিস্তান ও অবজারভার, ২৩-২৮ জুন ১৯৬৭ দ্রষ্টব্য) প্রকাশিত হলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ২৫ জুন ১৯৬৭ আঠারাে জন বুদ্ধিজীবী সরকারি বক্তব্যের সমালােচনা করে এক বিবৃতি দেন: সরকারি মাধ্যম হতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হইয়াছে। এই সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলাভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও ভিন্নতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতি নির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য। এই বিবৃতির পাল্টা আরেকটি বিবৃতি দৈনিক পাকিস্তানে ২৯ জুন ছাপা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন শিক্ষক। তারা বলেন : .(১৮ জন বুদ্ধিজীবীর) বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানী ও বাংলাভাষী সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনাে পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সংস্কৃতির সম্পর্কে এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই বলে এই বিবৃতি দিচ্ছি। একই দিন (২৯-৬-৬৭) দ্বিতীয় আরেকটি বিবৃতি দৈনিক পাকিস্তানে ছাপা হয়। এতে স্বাক্ষরদাতা ছিলেন ৪০ জন। বিবৃতিতে তারা মন্তব্য করেন : রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি মারাত্মক। যে তমুদ্দনিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, উপরােক্ত বিবৃতি মেনে নিলে সে ভিত্তিই অস্বীকৃত হয়। এই কারণে উপরােক্ত বিবৃতিকে আমরা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, অত্যন্ত মারাত্মক এবং পাকিস্তানের মূলনীতি বিরােধী বলেও মনে করি। শেষােক্ত বিবৃতিদাতারা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সে এক সভা করে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তারা একটা বিবৃতিও প্রচার করেন। বিবৃতিতে তারা বলেন রবীন্দ্র সংগীতের ভাব, ভাষা ও সুরের কোনােটার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তৌহিদবাদী জনসাধারণের তিলমাত্র যােগ নাই। রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বর্য ও কৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানী, তমদ্দনের সম্পূর্ণ বিপরীত। এইভাবে কিছু বুদ্ধিজীবীর সমর্থন পেয়ে সরকার ১৩৭৪ সালের ২২ শ্রাবণের পূর্ব মুহূর্তে (আগস্ট ১৯৬৭) বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। এর দুবছর পর উনসত্তরের গণআন্দোলনের জোয়ারে উক্ত নিষেধাজ্ঞা ভেসে যায়।
রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা বিশেষত ‘ছায়ানট’, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’ ও ‘ঐক্যতান’ রবীন্দ্রসংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়ােজন করে সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এ সময় বদরুদ্দীন উমর লিখিত সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কিত দুটো বই ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ আন্দোলনকে খুবই অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিল।
বাংলা ভাষা সংস্কারের প্রয়াস
আইয়ুব-মােনেম চক্র কেবল রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাংলাভাষা সংস্কার করে একটি জাতীয় ভাষা প্রচারের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. ওসমান গণি বাংলা বিভাগের ড. কাজী দীন মুহাম্মদের নেতৃত্বে ভাষা ও বানান সংস্কারের জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করেন। ঐ কমিটির সুপারিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে গৃহীত হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠীও এর বিরােধিতা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। উনসত্তরের গণআন্দোলনে তা চাপা পড়ে যায়।
খ. শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা আন্দোলন ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমি স্বাধীন পাকিস্তানের শুরু থেকেই কেন্দ্রকে শক্তিশালী করা হয় এবং প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়। প্রদেশের গভর্নরের নিয়ােগদান করতেন গভর্নর জেনরেল। স্বভাবতই প্রাদেশিক গভর্নর সবসময় গভর্নর জেনরেলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। এমনকি প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের গঠন, দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যকাল বিষয়েও গভর্নরের ওপর গভর্নর জেনরেলের নিয়ন্ত্রণ ছিল । The Pakistan Provincial Constitution (Third Amendment) Order, 1948. এর মাধ্যমে প্রদেশের ওপর। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ আরাে বৃদ্ধি করা হয়। এতে বলা হয় গভর্নর জেনরেল যদি মনে করেন যে, পাকিস্তান কিংবা এর কোনাে অংশের শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, কিংবা এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যাতে প্রাদেশিক সরকার দায়িত্ব পালনে অপারগ, সেক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল উক্ত প্রদেশের সকল ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারবেন (তবে প্রদেশের হাইকোর্ট এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে)। ১৯৪৯ সালে। PRODA (Public and Representative Offices (Disqualification Act) Gifs মাধ্যমে প্রাদেশিক মন্ত্রীদেরকে পরােক্ষভাবে পরাধীন করা হয় । এই আইনে হাইকোর্টের বিচারককে দিয়ে যে কোনাে সময় যে কোনাে মন্ত্রীর কাজের তদন্ত করা যেত এবং উক্ত তদন্তে কোনাে অনিয়ম কিংবা দুনীতি চিহ্নিত হলে উক্ত মন্ত্রীকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সকল রকম সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য অযােগ্য ঘােষণা করা যেত।
এর ফলে প্রাদেশিক মন্ত্রীগণ সব সময় কেন্দ্রের অনুগত থাকতেন। প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার আরেকটি মাধ্যম ছিল কেন্দ্রীয় । সিভিল সার্ভিসের সদস্যবর্গ। প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তাদের চাকরি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তারা প্রাদেশিক সরকারের আদেশ-নিষেধ মানতেন না। ফলে প্রদেশে আমলাতন্ত্র খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই আমলাগােষ্ঠীতে বাংলাদেশের কোনাে প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এমনকি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা সচিবালয়ে একজন বাঙালি সচিবও ছিলেন না। অবাঙালি সচিবগণ পূর্ববাংলার স্বার্থকে কখনই বিবেচনায় আনতেন না, বাঙালি অফিসারদের সঙ্গেও তারা ভালাে ব্যবহার করতেন না, তারা ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অফিসগুলিতে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। পররাষ্ট্র দপ্তর ও কূটনৈতিক অফিসগুলিতে সাতজন সহকারী সেক্রেটারির মধ্যে একজনও পূর্ববঙ্গের লােক নেই। বায়ান্নজন সুপারিনটেনডেন্টের মধ্যে মাত্র তিনজন এবং দুশাে ষােলজন সহকারীর মধ্যে মাত্র পঁচিশজন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী । দেশের সামরিক বাহিনীতেও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। ১৯৫৬ সালের এক হিসেবে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল।
সকল বাহিনীর সদর দফতর ছিল পাকিস্তানে অর্থনৈতিক দিকেও প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। যদিও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে আয়ের মূল উৎসসমূহ কেন্দ্রের হাতে দেয়া হয়েছিল, তথাপি উক্ত আয় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে বন্টনের একটা বিধি ছিল। স্বাধীনতার পর আয়কর পুরােপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যায়। বিক্রয়-কর, যা ইতিপূর্বে প্রদেশের হাতে ছিল তা ১৯৪৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। ইতিপূর্বে Jute export duty এর কমপক্ষে ৫০% পাট-রফতানিকারী প্রদেশ লাভ করত। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ঐ নিয়ম বদলানাে হয় এবং প্রদেশ কতভাগ পাবে তা গভর্নর জেনারেলের ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনও গণপরিষদের ১৯৫১-৫২ সালে বাজেট অধিবেশনে পূর্ববাংলার অর্থনেতিক করুণ দশার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পূর্ববাংলার বাজেট ঘাটতি বছর প্রতি ৪/৫ কোটি টাকার, কিন্তু এই ঘাটতি প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য ছিল না, এটা ছিল প্রদেশের আয়ের উৎসসমূহ কেন্দ্রের হাতে নিয়ে নেয়ার কারণে। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৪-৫৫ সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করেছে ৪২ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়ের পরিমাণ ৭৯০ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা। এই সময়ে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৩৯ কোটি ১২ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল মাত্র ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা।
যার ফলে পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বাজেট বরাদ্দের বৈষম্যের আরেকটি নমুনা নিম্নরূপ : এবারের (১৯৫১) উদ্ধৃত্ত পাক বাজেটে শিক্ষাখাতে কোনাে প্রদেশের জন্য কত ব্যয় বরাদ্দ করা হইয়াছে, তাই দেখা যাক : করাচি ৪০ লক্ষ ১৪ হাজার, মাথাপিছু ৪ টাকা ৩ আনা ৩ পাই; সিন্ধু ১০ লক্ষ, মাথাপিছু ৩ আনা ৬ পাই; সীমান্ত প্রদেশ ১১ লক্ষ, মাথাপিছু ৩ আনা ৩ পাই; সীমান্তপ্রদেশ ১১ লক্ষ, মাথাপিছু ৩ আনা ৩ পাই; পূর্ববঙ্গ ৭১ হাজার, মাথাপিছু ১ পাইয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ। উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহের সঙ্গে বাংলাভাষার আন্দোলন পূর্ববাংলার মানুষের মনে মুসলিম লীগ ও সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করে। পূর্ববাংলায় অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পূর্ব। পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থা যে কতটা দুর্বল ছিল তা এই যুদ্ধের সময় স্পষ্ট হয়ে যায় । যুদ্ধের সতেরাে দিন প্রশাসনিক দিক দিয়েও এই প্রদেশ কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, যা দেশভাগের সময় থেকেই। উচ্চারিত হচ্ছিল, তা পাক-ভারত যুদ্ধের পর আরাে জোরদার হয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ‘কপ’ (Combined opposition party,) নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কপ’ এর পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য বিবৃতি দেওয়া হয় জাতীয় পরিষদের সভায়। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলাের, যেমন-ন্যাপ, নেজাম ইসলামী, মুসলিম লীগ, জামায়েত ইসলামী প্রভৃতির নেতৃত্বে ছিলেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা। এন.ডি.এফ-এর নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপরই স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তাদের অন্যতম শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানকে সর্ববিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। শুধু ঘােষণা দিয়েই শেখ মুজিব ক্ষান্ত হননি, তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধীদলসমূহের নেতৃবৃন্দের এক কনভেনশনে, যা আইয়ুব খান কর্তৃক তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের বিরােধিতা করার জন্য আয়ােজন করা হয়েছিল, সেখানে (৬-৬-১৯৬৬ তারিখে) শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। উক্ত কনভেনশন মূলত পাকিস্ত েিনর ডানপন্থী দলসমূহ নিয়ে গঠিত ছিল। কনভেনশনে উপস্থিত ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ছিলেন মাত্র ২১ জন। উক্ত ২১ জনের মধ্যে ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের অপর ৪ জন নেতা। ন্যাপ এবং এন.ডি.এফ উক্ত কনভেনশনে যােগদান করেনি। এই কনভেনশনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলে উপস্থিত ৭৩৫ জন প্রতিনিধি তা তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দেন। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব তার ছােট প্রতিনিধিদল নিয়ে সম্মেলনস্থান ত্যাগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। শেখ মুজিব ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সংবাদপত্রে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়।
এই দাবিগুলি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা অবগত ছিলেন না। বিষয়টি উপস্থাপনের পূর্বে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে অনুমােদন নেয়া তাে দূরের কথা- কমিটির সামনে তা পেশই করা হয়নি। ফলে অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ হন, এবং অনেকে হন বিভ্রান্ত। তবে “৬ দফার প্রতি আওয়ামী লীগের তরুণ-নেতৃবৃন্দের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া গেলাে।” প্রবীণ নেতাদের আপত্তি বা গড়িমসি সত্ত্বেও তরুণ কর্মীরা বাঙালির দাবি ৬ দফা’, ‘বাচার দাবি ৬ দফা, ‘৬ দফার ভিতরেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত’ ইত্যাদি শ্লোগান। সংবলিত পােস্টারে পােস্টারে দেয়াল ছেয়ে ফেলেন। কেবল তাই নয়, ওয়ার্কিং কমিটির কোনাে সভা অনুষ্ঠানের পূর্বেই ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ব্যানারে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা-কর্মসূচি” শীর্ষক এক পুস্তিকা বিলি করা হয়। উক্ত পুস্তিকায় ৬ দফার দাবিগুলাে বিস্তারিত ব্যাখা দেয়া হয়। ছয় দফার বিবরণ এক, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভােটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে। তিন, এই দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়। এর যে কোনাে একটি গ্রহণের প্রস্তাব রাখা হয় : (ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিয়ােগযােগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে ।
এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট ব্যাংক থাকিবে। (খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। | চার, সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাইবে । এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।’ পাঁচ, এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয় : ১. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। ২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
৩. ফেডারেশনের প্রয়ােজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে । ৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি চলিবে। ৫. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী-রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। ছয়, এই দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়। আওয়ামী লীগের সভায় ছয় দফার অনুমােদন। ১৩ মার্চ ১৯৬৬ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা কর্মসূচি অনুমােদন করা হয়। মওলানা তর্কবাগীশ এবং আরাে কিছু প্রবীণ নেতা ছয় দফার বিরােধিতা করেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে অনুমােদিত হলেও তা পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমােদনের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কাউন্সিল অধিবেশন বসে ১৮ ও ১৯ মার্চ ১৯৬৬। পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ৬ দফার বিরােধিতা করে সভাস্থল ত্যাগ করলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভার কাজ চালিয়ে যান। এই সভায় ছয় দফা। কর্মসূচি অনুমােদিত হয়। তাছাড়া নতুন ওয়ার্কিং কমিটিও গঠিত হয়।
সূত্রঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান