You dont have javascript enabled! Please enable it! যুক্তফ্রন্ট গঠন - সংগ্রামের নোটবুক
যুক্তফ্রন্ট গঠন
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটানাের উদ্দেশে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামী মিলে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামক একটি নির্বাচনী আঁতাত গড়ে তােলেন। ইতিপূর্বে ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম লীগ সরকার বিরােধী একটা রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তােলর উদ্দেশে ‘যুবলীগ’ সকল বিরােধীদলের ঐক্য গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরুতেই ‘গণতান্ত্রিক দল’ ও ‘আওয়ামী লীগ ঐ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। পূর্ব পাকিস্ত নি ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দও মুসলিম লীগ বিরােধী জোট গঠন করতে প্রচারাভিযান চালায়। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিশেন মুসলিম লীগ বিরােধী জোট গঠনের উদ্দেশে সমমনা দলসমূহ নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা জারির সঙ্গে সঙ্গে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি ঘটলে তিনি রাজনীতি থেকে নির্বাসন গ্রহণ করেন। নূরুল আমিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ফজলুল হককে পূর্ববাংলার এ্যাডভােকেট জেনারেল পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পুনরায় রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে তার ১৯৩০ এর দশকের নিজস্ব দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং এর নামকরণ করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি (KSP) আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তিনি যুক্তফ্রন্টে যােগ দেয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। যুক্তফ্রন্টের আরেক শরিকদল- নিজামে এছলাম এর পূর্ব নাম ‘জমিয়তে ওলামায়ে এছলাম’।
১৯৫৩ সালের ২৬ নভেম্বর পূর্বপাক জমিয়তে ওলামায়ে এছলামের দুদিন ব্যাপী অধিবেশন শেষে তাদের ধর্মীয় সংগঠনটিকে রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করে এর নাম নিজামে এছলাম’ রাখা হয় এবং আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিবেশনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, যে-সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিজামে এছলাম ও উহার কার্যক্রম স্বীকার করিয়া নিজামে এছলাম। দলের সহিত সহযােগিতা করিতে প্রস্তুত আছেন, তাহাদের সহিত নিজামে এছলাম দল’ যুক্তফ্রন্ট গঠন করিতে রাজি আছেন। | এ ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার দলের সভাপতি মওলানা আতাহার আলীর ওপর অর্পিত হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বুঝতে পেরে নিজামে এছলাম যুক্তফ্রন্টে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি এবং নিজামে এছলামীর সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। 
যদিও যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, গণতন্ত্রী দল ও যুবলীগ, কিন্তু ফ্রন্টের কৃষক-শ্রমিক পাটি ও নিজামে এছলামীর নেতৃবৃন্দের। বিরােধিতায় এই দলগুলিকে ফ্রন্টভুক্ত করা হয়নি। তবে গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য আওয়ামী মুসলিম লীগের নামে নমিনেশন লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে কিথ ক্যালার্ড উল্লেখ করেছেন যে, The Ganatantri Dal had aligned itself with the United front during the campaign and some of its members had secured United Front nominations for Muslim seats. It seems probable that a few members of the communist party also secured United front nominations although this was not publicy announced. এ প্রসঙ্গে রঙ্গলাল সেন উল্লেখ করেছেন যে, ১৫ জন যুবলীগ সদস্য, ১০ জন। গণতন্ত্রী দলের সদস্য এবং ১০ জন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য আওয়ামী লীগের পরিচয়ে যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন লাভে সমর্থ হয়। নাজমা চৌধুরী উল্লেখ করেছেন যে, অনেক বামপন্থী-নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। | নির্বাচনে খেলাফতে রব্বানী পার্টিরও ইচ্ছে ছিল ‘যুক্তফ্রন্ট’-এর শরিক দল হওয়ার । এই উদ্দেশে ১৯৫৩ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার গােপীবাগ থার্ড লেনে পার্টির সভাপতি জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রেসিডিয়ামের এক সভায় লীগ-বিরােধী। সম্মিলিত যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। কিন্তু খেলাফতে রব্বানী পার্টিকে ‘যুক্তফ্রন্টভুক্ত করা হয়নি। অগত্যা এই পার্টি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, তারা মাত্র ১০টি মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, এবং বাকি ২২৬টি আসনের জন্য রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের সমর্থন করবেন।
নির্বাচনে ছাত্রসংগঠন সমূহের ভূমিকা
যুক্তফ্রন্ট গঠনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। নির্বাচনী কর্মকা শুরু হলে এই দুই সংগঠন ‘যুক্তফ্রন্ট কর্মী শিবির’ গঠন করে এবং গ্রামপর্যায় পর্যন্ত এর শাখা বিস্তৃত হয়। সংগঠকদ্বয়ের সমর্থক ছাত্রকর্মীরা সারাদেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করার পিছনে মূল কারণ ছিল এই যে, যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার ৯, ১০ এবং ১১নং দফায় উল্লেখিত দাবিসমূহ ছিল ছাত্রদের স্বার্থ-সম্পর্কিত। তাছাড়া ১৯৫২ সালে বাংলাভাষার দাবিতে ছাত্রবৃন্দ যে আত্মত্যাগ করেছিল, ২১-দফার ১ম দফাটি ছিল সে-বিষয় সম্পর্কিত। সুতরাং ছাত্রদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের স্বার্থেই তারা যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন জ্ঞাপন করে। অপরপক্ষে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনটি (All East Pakistan Muslim Students League) মুসলিম লীগকে সমর্থন করে।
 
নির্বাচনে ইসলামী দলসমূহের ভূমিকা
কিছু ইসলামী দল বা সংগঠন এবং ইসলামী ব্যক্তিত্ব নিজেরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও মুসলিম লীগকে সমর্থন করার কথা ঘােষণা করেন। নিচে সে বিষয়ে আলােকপাত করা হল :
 
জমিয়তে হেজবুল্লাহ
এটি ছিল একটি ধর্মীয় সংগঠন। নির্বাচন সম্পর্কে এ দলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল। নিমরূপ : জমিয়তে হেজবুল্লাহ আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র পার্টি হিসেবে প্রার্থী খাড়া করাইবে না বলে দল বিশেষকে সমর্থন করিবে না । দ্বিজাতিতত্ত্ব ও নেজামে এছলাম সমর্থক কোনাে নির্বাচন প্রার্থী জমিয়তে হেজবুল্লাহর একরার নামায়’ দস্তখত করিলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় উক্ত ব্যক্তির জনসমর্থন ও তাহার নিজস্ব যােগ্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করিয়া জমিয়ত তাহাকে সমর্থন করিবে। কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া পুরােদমে শুরু হলে তারা প্রকাশ্যে মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন ঘােষণা করে। পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে হেজবুল্লাহর সম্পাদক মওলানা আজিজুর রহমান ঘােষণা করেন : পাকিস্তানে আদর্শ এছলামী শাসন কায়েম, জাতীয় সংহতি রক্ষা ও পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য দীনদার মুসলমানদের পক্ষে মােছলেম লীগকে সমর্থন করা ছাড়া বর্তমানে শরীয়তসম্মত অন্য কোনাে পথ নেই। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে জমিয়তে হেজবুল্লাহ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবেই জাতীয় প্রতিষ্ঠান মােছলেম লীগকেই সমর্থন করিবে। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পূর্বে এই দল ঘােষণা করে যে, ‘লীগকে সমর্থন করা ওয়াজেব।
 
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র-হেজবুল্লাহ
এটি জমিয়তে হেজবুল্লাহর ছাত্রফ্রন্ট। নির্বাচনে এই দলের ভূমিকা সম্পর্কে দলের প্রচার সম্পাদক মওলানা ছাহেব আলী ঘােষণা করেন :  মুসলমানদের একমাত্র খালেছ প্রতিষ্ঠান হিসাবে মুসলিম লীগের স্থান বিরােধী খিচুড়ি দলের অনেক উর্ধে। মরহুম ফুরাফুরা ও শর্ষীনার পীর ছাহেবদ্বয় ও হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব প্রমুখ অলী আল্লাহগণ ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে মুসলিম লীগকে সমর্থন করিয়া গিয়াছেন। জাতীয় বর্তমান সংকট মুহূর্তে মাদরাসা ও স্কুলকলেজের দীনদার ছাত্রদের নীরব থাকিলে বা কংগ্রেসী ওলামাদের এশারায় ভুলপথে চলিলে দেশ ও জাতির পক্ষে তাহা মারাত্মক হইবে, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই । তাই আজ আমি খােলাখুলিভাবে দীনদার ছাত্রদের প্রতি আবেদন করি যে, পাকিস্তানে নেজামে এছলাম কায়েম, জাতির সংহতি রক্ষা ও পাকিস্তানকে গুপ্ত-শত্রুদের হস্ত হইতে রক্ষা করার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগকে সমর্থন করা ছাড়া গত্যন্তর নাই । জমইয়াতে তােলাবায়ে আরাবিয়া। এটিও একটি ধর্মীয় সংগঠন। নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও পূর্ববাংলার | ওলামায়ে কেরামের উদ্দেশে এক আবেদনে এই দলের সম্পাদক মাওলানা মােস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তানে নেজামে ইছলাম কায়েম করার উদ্দেশে নিজেদের মধ্যকার খুটিনাটি মতানৈক্য ভুলিয়া এক কর্মপন্থা অবলম্বন করুন। জামায়াতে এছলামী। এই দলটি ইসলামী রাজনৈতিক দল হয়েও পাকিস্তানের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ‘অনৈছলামিক’ বলে অভিহিত করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে এছলামীর আমীর চৌধুরী আলী আহমদ খান নির্বাচন পদ্ধতির সমালােচনা করে বলেন যে, ইহা দেশে অসাধুতার বিষ ছড়াইতে সাহায্য করিবে । ধর্মনিরপেক্ষতা বর্তমান বিশ্বের সকল অনর্থের মূল। বিভিন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্বের মনােভাব শর্ষীনার পীর সাহেব তার অনুসারীদেরকে মুসলিম লীগকে সমর্থনের আহ্বান জানান।
 
মহামান্য আপা খান তাঁর পাকিস্তানস্থিত বিভিন্ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও সদস্যবর্গ এবং জামাতের সদস্যগণের নিকট প্রেরিত বাণীতে পূর্ববাংলার নির্বাচনে মুসলিম লীগকে সহায়তা করার জন্য অনুরােধ জানান। তিনি মন্তব্য করেন, ‘লীগ জয়ী না হলে পাকিস্তানে ইসলাম দুর্বল হবে। পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে আহলে হাদিসের সভাপতি মওলানা মােহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফি তার অনুসারীদেরকে আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ মনােনীত প্রার্থীদেরকেই । জয়যুক্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণের জন্য আবেদন জানান। এইভাবে আমরা দেখি বিভিন্ন ইসলামী দল ও ব্যক্তিত্ব প্রকারান্তরে মুসলিম লীগকে। সমর্থন জানান। তবে এককালের অনেক বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা যে এই নির্বাচনে নিশ্ৰুপ । থাকেন তার প্রমাণ খাজা নাজিমউদ্দীন। নির্বাচনে কোনাে দলকেই সমর্থন না জানিয়ে। তিনি নিন্দুপ থাকেন এবং একসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ‘আমি রাজনীতি হইতে বিদায় লইয়াছি।
 
নির্বাচনে হিন্দু দল ও জোট
তৎকালীন পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদে অমুসলমান আসনের সংখ্যা ছিল ৭২। এর মধ্যে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদের জন্য নির্দিষ্ট আসন সংখ্যা যথাক্রমে ২ ও ১। নির্বাচনে মুসলমান আসনগুলাে মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত হলে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য হিন্দু-আসনের নির্বাচিত সদস্যদের সমর্থন প্রয়ােজন হবে- এই বিবেচনায় যুক্তফ্রন্টের ইঙ্গিতে ‘সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়। সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলাে ছিল ‘গণসমিতি’, কুমিল্লার অভয় আশ্রম’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্ত নি সমাজতন্ত্রী দল। গণসমিতির নেতৃবৃন্দই এই ফ্রন্টকে নেতৃত্ব দেন। গণসমিতি’ হচ্ছে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা নেতা-কর্মীদের সংগঠন। ১৯৪৭এর পর পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ গঠনের সময় কিছু নেতা কংগ্রেস বাদে অন্য নামে দলগঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হলে তারা ১৯৪৮-এর জুলাই মাসে ‘গণসমিতি’ গঠন করেন। এই দলে শুধু কংগ্রেস সদস্যরাই যােগ দেননি, ‘সমাজতন্ত্রী দল’, ‘বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল’, ফরওয়ার্ড ব্লক’ এবং অন্যান্য সংগঠনের কিছু হিন্দু নেতাকর্মীও যােগ দেন। ১৯৪৭-এর পর কংগ্রেস ও গণসমিতি প্রধানত বর্ণ-হিন্দুদের সংগঠন ছিল। সে-সময় তফশিলি হিন্দুদের সংগঠন ছিল ‘তফশিলি জাতি ফেডারেশন’। ১৯৪৭-এর পূর্বে এবং পরে এই সংগঠনের নীতি ছিল মুসলিম লীগকে সহযােগিতা করা। ফলস্বরূপ ১৯৫০ সালে পূর্ববাংলা সরকারের কেবিনেটে এই দল থেকে দলের প্রেসিডেন্ট মি.ডি.এন, বারুই মন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা হবে, না যৌথ নির্বাচনব্যবস্থা হবে- এই ইস্যুতে ১৯৫৪-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে দল বিভক্ত হয়। ডি.এন.বারুই পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। তার বিরুদ্ধ অংশের নেতৃত্ব দেন মি. রসরাজ মণ্ডল। অবশেষে ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লায় বিরােধী অংশের সম্মেলন হয়। হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী উক্ত সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে রসরাজ মণ্ডলের অংশ এবং ডি.এন, বারুইয়ের অংশ পৃথক প্রার্থী মনােনয়ন দেন।  
 
সদস্যের মধ্যে ৪২ জন মুসলিম লীগের নমিনেশন পান। ৯ জন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হন। এদের মধ্যে খয়রাত হােসেন (আওয়ামী লীগে যােগ দেন) এবং ইউসুফ আলী চৌধুরীর (কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে যােগ দেন) নাম উল্লেখযােগ্য। ৮ জন স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচন করেন। এরা মুসলিম লীগ কিংবা যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন লাভে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। ৩৯ জন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। বিভিন্ন দল ও জোটের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ও প্রচারাভিযান মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের অন্যতম বক্তব্য ছিল পাকিস্তানের অখ তা ও সংহতি বজায় রাখা, কেন্দ্রীয় সরকারকে অধিক শক্তিশালী করা, পাকিস্তানের জন্য ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী ঢাকার এক নির্বাচনী সভায় বলেন যে, মুসলিম লীগই একমাত্র দল যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন অটুট রাখতে সক্ষম। খােদা না করুন, সামনের নির্বাচন যদি অন্য কোনাে দল নির্বাচিত হয় তাহলে পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন হবে।
পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেন যে, ‘যারা স্বাধীন পাকিস্তানে বিশ্বাস করে না, যারা অখ ভারতের স্বপ্ন দেখে তারা যদি নির্বাচিত হয় তাহলে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগ চতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী এক। জনসভায় বলেন যে, যদি পূর্ববাংলা প্রদেশের জনগণের এই ইচ্ছে হয় যে, বাংলাকে। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে তাহলে তিনি গণপরিষদে তা সমর্থন করবেন। পূর্ববাংলার ধর্মপ্রাণ নিরীহ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য মুসলিম লীগ ধর্মীয় বন্ধনে পাকিস্ত েিনর ঐক্য অটুট রাখার আহবান জানান। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহের ভগ্নী মিস ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনী প্রচারাভিযানে মুসলিম লীগের পক্ষ নেন। তিনি ভােটারদের উদ্দেশে ভিন্ন জনসভায় বলেন যে, মুসলমান ভােটারদের উচিত কম্যুনিস্ট ও হিন্দু ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করার জন্য মুসলিম লীগের মনােনীত প্রার্থীদের ভােট দেয়া।’ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম দিবস উপলক্ষে এক বেতার বক্তৃতায় পূর্ব বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে মিস জিন্নাহ বলেন: আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আপনাদিগকে এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে হইবে। নির্বাচনের ফলাফলের ওপরই পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। ভবিষ্যৎ চিন্তা করুন এবং অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেন যে, এই নির্বাচন অনেকটা গণভােটের মতাে। নির্বাচনের ফলাফলে নির্ধারণ হবে যে, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে, না ভারতভুক্ত হবে। নির্বাচন উপলক্ষে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ‘আজাদ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ নির্বাচনী ইশতেহার প্রচারিত হয়। উক্ত ইশতেহারের বক্তব্য বিষয় থেকে এই দলের মনােভাব অবলােকন করা সম্ভব।
যুক্তফ্রন্ট
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে। নিমে ২১ দফার দাবিগুলাে উল্লেখ করা হল : যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা। নীতি : কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোনাে আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামর সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে। ১, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে। ২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চহারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সাটিফিকেটযােগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে। ৩. পাট ব্যবসায়কে জাতীয়করণ করার উদ্দেশে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ, পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারি তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।  ৪. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্প উন্নতি সাধন করা হইবে। পূর্ববঙ্গকে লবণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমস্ত উপকূলে কুটিরশিল্প ও বৃহৎশিল্পে লবণ তৈয়ারির কারখানা স্থাপন করা হইবে এবং মুসলিমীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হইবে। | ৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর গরিব মােহাজেরদের কাজে আশু ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হইবে। ৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে। পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগােপযােগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকলপ্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে। দেশের সর্বত্র একযােগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা। হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
 
১০, শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয়সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। ১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে শস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয় সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে। ১২. শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হইবে এবং তদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভােগীদের। বেতন কমাইয়া নিম বেতনভােগীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুষ্ঠু সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের কোনাে মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ করিবেন না। দুনীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হইবে এবং এতদুদ্দেশে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাবনিকাশ লওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারিলে তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে। ১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করত বিনাবিচারে আটক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য-আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে। ১৫. বিচার বিভাগকে শাসন-বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে। ১৬. যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলাভাষা গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে। ১৭, বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হইয়াছেন তাহাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হইবে।
এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে। ১৮. ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘােষণা করিয়া উহাকে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করা হইবে। ১৯. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে। এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত সমস্ত বিষয় (অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তান অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করত পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে । আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।
২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোনাে অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে। ২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন। (সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৭৩-৩৭৪) ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিমলীগ বিরােধী যুক্তফ্রন্টের প্রেরণাশক্তি ছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন। তাই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ২১ ফিগারটিকে চিরস্মরণীয় করার অতিরিক্ত উপায় হিসেবে ২১ দফার কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। আবুল মনসুর আহমেদ ২১-দফার খসড়া প্রণয়ন করেন। ২১-দফা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, প্রদেশের জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনে বাঙালির অধিকসংখ্যক নিয়ােগ প্রভৃতি দিক অন্যতম।  তবে ২১-দফার বিশ্লেষণে কিছু বিষয়ের অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫০ সালের পূর্ববাংলায় জমিদারি স্বত্ব বিলােপ করে ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমি মালিকানার উচ্চতর সিলিং নির্ধারণ করলেও মুসলিম লীগ সরকার এই সিলিং বাস্তবায়িত করতে পারেননি। কারণ, মুসলিম লীগ জোতদার শ্রেণীর সংগঠন ছিল। যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতা জোতদার। শ্রেণীর ছিলেন। স্বভাবতই যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় সিলিং-এর কথা উল্লেখ করা হয়নি, তবে ভূমিহীন ভােটারদেরকে আকৃষ্ট কার জন্য বলা হয় যে, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ‘উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে যুক্তফ্রন্ট শরিকদলের মতের ভিন্নতা ছিল ।
ডানপন্থীগণ পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ভালাে করার নীতিতে বিশ্বাসী হলেও বামপন্থী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। ফল পররাষ্ট্র ব্যাপারে ২১ দফা নিচুপ থাকে। এতদসত্ত্বেও ২১-দফার দাবিগুলি ভােটারদের মন জয় করে। খেলাফতে রব্বানী পার্টি এই দলের নির্বাচনী-মানিফেস্টোর সারাংশ নিমরূপ: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি ইসলামের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও তামুদ্দনিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ত্যাগ, ইঙ্গ-মার্কিন ও রাশিয়া এই ‘জড়বাদী’ ব্লকের দম্ভে পাকিস্তানের নিরপেক্ষতা রক্ষা, আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিনাবিচারে আটক রাখার নীতি বাতিল। শাসন বিভাগ হইতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, বিনাবিচারে আটক রাজবন্দিদের মুক্তি, পাট সই কল একচেটিয়া ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রায়াত্তকরণে, বিনা খেসারতে সমস্ত কর আদায় ভূমিস্বত্বের বিলােপ সাধন, ভূমিনির্ভর ভূস্বত্বচ্যুত নাগরিকদের জীবিকার ব্যবস্থা করা, সর্বোচ্চ উৎপাদন ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রকৃত চাষীদের মধ্যে জমি বন্টন; লবণ, তামাক, সুপারিশ প্রভৃতি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য ও খাদ্যশস্যের কর বাতিল, অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গ্রহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাধীনতা এবং শিক্ষা ও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী শাসনবিভাগীয় সমস্ত বাধানিষেধ প্রত্যাহার এবং ঘুষ-দুর্নীতি ও অন্যান্য সমাজবিরােধী কার্যকলাপের প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ইত্যাদি।
গণতন্ত্রী দল নির্বাচন উপলক্ষে গণতন্ত্রী দল দশ দফা’ ম্যানিফেস্টো ঘােষণা করে। ১, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ত্যাগ ও পাকিস্তানকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘােষণা। পাকিস্তানে বাণিজ্য ও শিল্পে নিয়ােজিত বিদেশী মূলধন ও সুদ বাজেয়াপ্ত করণ। বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার বিলােপ সাধন। জমিদারদের দখলি অতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে উহার পুনর্বন্টন। ৪.. পাটের রফতানি ব্যবসা জাতীয়করণ, উহার বাজার সম্প্রসারণ ও পাটের সর্বনিম ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দান। দেশের শিল্পায়নে বেসরকারি জাতীয় মূলধন নিয়ােগে সক্রিয় উৎসাহ দান। দেশবাসীর ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিদান, অন্ত রীণাদেশ ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার, সকল কালাকানুন ও অর্ডিন্যান্স রদকরণ এবং ধর্মচর্চা, সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান। বেকারত্ব ও ব্যয়বহুল জীবন যাত্রার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশবাসীর বাঁচার অধিকার কায়েম করা। জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়ন, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন। ১০. পাকিস্তান-ভারত সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। অন্যান্য কংগ্রেস নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচনী বাের্ডের সেক্রেটারি মি. মনােরঞ্জন ধর বলেন যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্মান রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান এবং সমান নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পূর্ববঙ্গ তফশিলি জাতি ফেডারেশন (রসরাজ মণ্ডল গ্রুপ) এই দলের লক্ষ্য ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন এবং তফশিলিদের জন্য আসন সংরক্ষণসহ পৃথক নির্বাচনের দাবি বাস্তবায়ন প্রভৃতি।
নির্বাচনের প্রস্তুতি
আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ২৪ ডিসেম্বর (১৯৫৩) চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশিত হয় এবং জনগণের অবগতির জন্য তা রেজিস্ট্রি অফিসে, রিটার্নিং অফিসারদের অফিসে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেক মৌজার সরদারের অফিসে, সিলেট জেলায় সার্কেল সাব-ডেপুটি কালেক্টরের অফিসে, ইউনিয়ন বাের্ড অফিসে, মহকুমা হাকিমের অফিসে, জেলা জজের, সাব জজের ও মুন্সেফের অফিসে, মিউনিসিপ্যাল এলাকায় মিউনিসিপ্যালিটির অফিসে এবং মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্ডের সুবিধাজনক স্থানে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয়। | ছাপানাে, কিংবা টাইপ-করা কিংবা হাতেলেখা ফরমে মনােনয়ন জমা দেওয়ার নিয়ম করা হয়। তফশিলি নির্বাচনী এলাকা ছাড়া প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীগণকে ২৫০ টাকা জামানত দাখেল করতে হত। তফশিলি নির্বাচন এলাকার প্রার্থীগণকে ১০০ টাকা জামানত দাখেল করতে হত। রেভিনিউ ডিপােজিট’ খাতে টাকা জমা দিতে হত ।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের ব্যালটবাক্সে ব্যবহারের জন্য সরকার চূড়ান্তরূপে মােট ২৪টি প্রতীক নির্দিষ্ট করেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ‘হারিকেন প্রতীক এবং যুক্তফ্রন্ট ‘নৌকা প্রতীক গ্রহণ করে। পূর্ববাংলায় প্রায় ৫ হাজার ১০টি ভােটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়। ভােটগ্রহণের জন্য। রিজার্ভসহ ৭ হাজার ৪ শত ৮৩ জন প্রিসাইডিং অফিসার ও আনুমানিক ২৪ হাজার পােলিং অফিসার নিয়ােগ করা হয়। গেজেটেড অফিসার, কলেজের প্রফেসর, হাইস্কুল ও হাই মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের প্রিজাইডিং অফিসার নিযুক্ত করা। হয়। কোনাে ভােটার যাতে একবারের বেশি ভােট দিতে না পারে সেজন্য ভােটদান কালে তার আঙুলে অমােচনীয় (যা সহজে ওঠে না) কালির ছাপ দেওয়ার বিধান করা হয় এবং ভােটগ্রহণ কেন্দ্রে হিন্দু ও মুসলমান পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা স্থান নির্দিষ্ট করা হয়। ভােট দেওয়ার জন্য ভােটারকে যাতে পাঁচ মাইলের বেশি হাঁটতে না হয় তৎপ্রতি লক্ষ্য রেখে বুথ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভােটগ্রহণের জন্য দেড় লক্ষাধিক ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয় এবং প্রায় দুই কোটি ব্যালটপেপার ছাপানাে হয়। নিয়ম করা হয় যে, ভােটগ্রহণ ৫ দিনে (৮ মার্চ থেকে ১২ মার্চ) সমাপ্ত হবে। ভােটগ্রহণ কার্য সকাল ৯.৩০ মিনিটে শুরু হয়ে বিকেল ৪.৩০ মিনিট পর্যন্ত চলবে; মাঝখানে ১২.৩০ মিনিট থেকে ১.৩০ মিনিট-এই এক ঘন্টাকাল ভােটগ্রহণ বন্ধ থাকবে। বিকেল ৫.৩০ মিনিটে ভােটগ্রহণ কেন্দ্রের আবেষ্টনী বন্ধ করা হবে ।
ঐ সময়ের পর আর কোনাে নতুন লােকে আবেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আবেষ্টনীর মধ্যে যারা থাকবেন ৪.৩০ মিনিটের পরও তাদের ভােট নেওয়া হবে। এই নির্বাচনে অনুপস্থিত ভােটারদের জন্য ডাকযােগে ভােট দেয়ার সুবিধা দেয়া হয়। সরকারি প্রেসনােটে বলা হয়: যে-সকল ভােটার কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক সরকারের কাজে নিজ এলাকা হইতে দূরে আছেন, অথবা যাহারা নিবর্তনমূলক আইনে আটক আছেন, তাহারা ডাকযােগে ভােট প্রদান করিতে পারিবেন। উল্লেখিত ব্যবস্থাসমূহ নির্বাচন সম্পন্ন করার সুষ্ঠু পদ্ধতি- এই বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নাই। কিন্তু নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয় সেজন্য বিরােধী দলসমূহের মনে যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিরােধী দল বিভিন্ন রকমের দাবি উত্থাপন করে। জনাব ফজলুল হক প্রদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী কমিশনারের নিকট নিমলিখিত দাবিগুলাে পেশ করেন। ১. মনােনয়ন পত্র বাছাইয়ের ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করিতে এবং নির্বাচনের পূর্বে মনােনয়ন পত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিলের ব্যবস্থা রাখিতে হইবে। | কোনাে লােক যাহাতে দুইবার ভােটদান করিতে না পারে, তাহার জন্য ভােটারদের হাতের নখে যে কালির দাগ শীঘ্র মুছিয়া না যায় সেইরূপ কালির চিহ্ন দিতে হইবে। 
দলসমূহ যাহাতে গু মির আশ্রয় লইতে না পারে, তাহার জন্য ভােটগ্রহণ কেন্দ্রের সিকি মাইলের মধ্যে স্-েগান উচ্চারণ এবং অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা বহন নিষিদ্ধ করিতে হইবে। ৪, ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে ভােটগ্রহণ কেন্দ্র স্থাপন করিতে এবং ভােটদাতাদের
যাতায়াতের এবং স্থান সংকুলানের যাহাতে অসুবিধা না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। পুলিশ কর্মচারীসহ সকল সরকারি অফিসার যাহাতে পক্ষপাতমূলক তৎপরতা শুরু করেন, তজ্জন্য এখনই তাহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতে হইবে। নির্বাচন কমিশনার জনাব আজফার ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাণপণ প্রয়াস পাইবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেন। মওলানা ভাসানী ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে পূর্ববাংলার গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গভর্নর মওলানা সাহেবকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, নির্বাচনী প্রচারকার্য চালাইবার জন্য মােছলেম লীগ ও বিরােধী দলগুলােকে সমান সুযােগ দেওয়া হইবে এবং কোনাে সরকারি কর্মচারী মােছলেম লীগের প্রচারকার্যে সহায়তা করিতেছে এরূপ সংবাদ পাইলে তাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। গভর্নর আরও বলেন যে নির্বাচন যাহাতে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠুতার সহিত সম্পন্ন হয় সেদিকে। সতর্ক দৃষ্টি রাখা হইবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে নিজামে এছলাম তার কাউন্সিল অধিবেশন শেষে নিমলিখিত প্রস্তাব পাস করে: সরকারি খরচে শাসন কর্তৃপক্ষের নির্বাচনী প্রচারণা চালানাে সম্পর্কে গভীর উদ্বেপ প্রকাশ করা হয় এবং অবিলম্বে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভাঙ্গিয়া দেওয়ার দাবি জানাইয়া দলমত নির্বিশেষে সকলকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালাইবার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে মাইক ইত্যাদি ব্যবহারের অবাধ সুযােগ প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও গভর্নরের নিকট দাবি জানানাে হয়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আজাদ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয় যে, ‘নির্বাচন দিবসের পূর্বে নানাজনে নানা প্রকার আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন।
কিন্তু গতকল্য ঢাকা শহরের ভােটারগণ এবং নির্বাচনের সহিত সংশ্লিষ্ট সকল দল ও ব্যক্তি বিস্ময়কর শৃঙ্খলাবােধের পরিচয় দিয়া সকলকেই স্তব্ধ করিয়া দিয়াছেন….পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রের প্রথম পরীক্ষায় সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ হইয়াছে। আঙুলে অমােচনীয় কালি (indelible ink) লাগানাের বিধান করায় এবং East Bengal Electoral offences Ordinance জারি করায় নির্বাচনে জাল ভোট দেয়ার চেষ্টা হয়নি, কিংবা জাল ভােট হয়নি।
নির্বাচনী ফলাফল
নির্বাচনে মুসলমান আসনে ৩৭.৬০% ভােট পড়ে। তখনকার যােগাযােগ ব্যবস্থার দুরবস্থা, মহিলাদের ভােটকেন্দ্রে আসতে অনীহা। প্রভৃতি কারণে ভােটদানের হার কম ছিল। নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণা শুরু হয় ১৫ মার্চ (১৯৫৪) থেকে। সরকারি ফলাফল | ঘােষিত হয় ২ এপ্রিল। 
 
মুসলমান আসনের স্বতন্ত্র সদস্যদের ৮ জন যুজফ্রন্টে যােগ দেন, ফলে যুক্তফ্রন্টের সদস্যাসংখ্যা ২২৩-এ উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত একজন স্বতন্ত্র সদস্য মুসলিম লীগে যােগদান করলে ঐ দলের সদস্য সংখ্যা ১০ হয় । সারণী-৩-এ মুসলমান আসনের জেলাভিত্তিক ফলাফল দেয়া হল। এতে দেখা যায় যে, ৮টি জেলায় যুক্তফ্রন্ট একচেটিয়াভাবে সবগুলি আসন লাভ করে। মুসলিম লীগ কেবলমাত্র রংপুর, যশাের, সিলেট ও ত্রিপুরা জেলায় আসন পায় । খেলাফতে রানী 
 
নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন এবং আরাে চারজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং কমপক্ষে ৫০ জন মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। নূরুল আমিন নিজ আসনে খালেক নেওয়াজ খান নামক ২৫ বৎসর। বয়সী এক আইনের ছাত্রের নিকট প্রায় ৭,০০০ ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র জনাব তাজউদ্দীন আহমদের নিকট প্রায় ১৩ হাজার ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হন। মুসলিম লীগ সমর্থিত তফশিলি জাতি ফেডারেশন। (বারুরী গ্রুপ)-এর ভরাডুবি ঘটে।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ
নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে শাসনক্ষমতা হাতে পেয়ে দলের নেতৃবর্গ নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা জনগণের সঙ্গে যােগাযােগ বজায় রাখতে অবহেলা দেখান। ফলে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দলের অনেক পুরাতন এবং জনপ্রিয় নেতা ও সদস্য বিভিন্ন কারণে দলত্যাগ করেন এবং নতুন দল (যেমন আওয়ামী মুসলিম লীগ) গঠন। করেন। ফলে দলের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া মুসলিম লীগ পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে বহুমুখী বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগকেই দায়ী করে এবং নির্বাচনে তার প্রভাব পড়ে। মুসলিম লীগের পূর্ব বাংলা শাখা এবং পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকার এই প্রদেশের অর্থনৈতিক অবনতি রােধ করতে ব্যর্থ হয়। লবণ, কোরােসিন ও সরিষার তেল প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহবধূরাও মুসলিম লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভােট দেয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির প্রতি চরম বিরােধিতা করে ১৯৫২ সালের হত্যাকা ঘটিয়ে দলের বিরুদ্ধে বাংলার আপামর জনসাধারণকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। দীর্ঘ ৭ বৎসর সংবিধান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রদেশবাসীর নিকট দলের গ্রহণযােগ্যতা কমে যায়। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের কোনাে বক্তব্যই জনগণকে খুশি করতে পারেনি। অপরপক্ষে, ফজলুল হক, ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দী-এই তিনজনের নির্বাচনী প্রচারণার ফলে দেশময় যে প্রাণচাঞ্চল্যের বন্যা আসিল, তাতে মুসলিম লীগের মতাে ক্ষমতাসীন দল ভাসিয়া গেল। 
মুসলিম লীগের মুখপত্র আজাদ পত্রিকা এই দলের পরাজয়ের জন্য নিমলিখিত কারণগুলাে চিহ্নিত করে: সাধারণভাবে লীগের পরাজয়ের যেসব কারণ সর্বত্র আজকাল আলােচিত হইতেছে সেসবের ভিতর রহিয়াছে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষের এবং লীগের কতিপয় নীতি ও কার্যের প্রতিবাদ… লীগের পরাজয়ের কারণগুলি হইতেছেঃ (১) বাংলাভাষার দাবির প্রতি অবিচার, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নূরুল আমিন সরকারের দমন-নীতি; (২) পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের নীতি, সমদর্শিতার অভাব; অবিচার ও শােষণ নীতি; (৩) লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলাকে স্বায়ত্তশাসন না- দেওয়ার প্রস্তাব ও মনােভাব (৪) পূর্ববাংলার জনগণের আর্থিক দুর্দশা; (৫) শাসনতন্ত্র রচনার বিলম্ব; (৬) লীগের গণসংযােগের অভাব; (৭) লীগ ও মন্ত্রিত্বের একীকরণ; (৮) লীগের ভিতর বিপুল। ব্যক্তিত্বশালী নেতৃত্বের অভাব; (১০) দুর্নীতি দমনে সরকারি ব্যর্থতা এবং এইভাবে তালিকায় আরাে কারণ যােগ করা যাইতে পারে। নির্বাচনে বিজয়ী পরিষদ সদস্যবৃন্দের সামাজিক পটভূমি। ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে পরিষদ সদস্যদের সামাজিক পটভূমি নির্ণয় বর্তমানে দুঃসাধ্য। নির্বাচিত সদস্যদের অনেকেই এখন জীবিত নেই। তাদের অধিকাংশের কোনাে জীবনীগ্রন্থ লিখিত হয় নাই । অধ্যাপক নাজমা চৌধুরীর গবেষণাগ্রন্থ থেকে আমরা কিছু তথ্য পাই। তিনি ১৯৬৭-৬৯ সময়ে তার পি.এইচ.ডি গবেষণাকর্মের অংশ হিসেবে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট তাদের জীবনীর বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়ে একটি প্রশ্নমালা প্রেরণ করেন। ৩২২ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট প্রশ্নমালা প্রেরিত হলেও মাত্র ১২৩ জন (৩৮.২%) প্রশ্নমালা পূরণ করে ফেরত পাঠান। উক্ত ১২৩ জনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অধ্যাপক চৌধুরী তাদের যে সামাজিক পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন তা সংক্ষেপে নিমরূপ: নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ অধিকাংশই ছিলেন বেশ বয়স্ক । ৬০-এর বেশি বয়স্ক সদস্যের সংখ্যা যেখানে ছিল ১৭%, ৩০-এর কম বয়স্ক সদস্য সংখ্যা সেখানে মাত্র ৭% ।
৪৫ এর অধিক বয়স্ক সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১% । নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ অধিকাংশই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত । আইন পাস সদস্য সংখ্যা। ছিল লক্ষণীয় (৪৫%)। ডাক্তারি পাস ছিলেন ৫% । স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ১৫%। ম্যাট্রিক পাস করেননি এমন সদস্যসংখ্যা ৬%, ম্যাট্রিক পাস ৬% এবং ইন্টারমিডিয়েট পাস ৮%। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নন-গ্রাজুয়েট সদস্য সংখ্যা ২০% (২৪ জন)। এদের মধ্যে ২ জন ধনী জমিদার পরিবারের সদস্য, ২ জন বড় জোতদার, ২ জন এমন। পরিবারের সদস্য যে পরিবার থেকে ইতােপূর্বে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, ৫ জন মােক্তার, ৩ জন ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় পড়াশুনা করতে পারেননি, ১ জন বড় ব্যবসায়ী, ১ জন দীর্ঘদিন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, ১ জন বিপ-বী কর্মী । এরা সকলেই নিজ নিজ এলাকায় সুপরিচিত হওয়ায় কম লেখাপড়া তাদের নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি। নির্বাচিত সদস্যদের ৬% (৭ জন) ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত । লক্ষণীয় যে, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা যে সকলেই কোনাে ধর্মীয় সংগঠনের বা দলের সদস্য ছিলেন এমন নয়। উক্ত ৭ জনের ১ জন নিবাচিত হয়েছিলেন নিজামে এছলামী থেকে, ৩ জন মুসলিম লীগ থেকে এবং ২ জন আওয়ামী লীগ থেকে । ১ জনের দলীয় পরিচয় জানা যায়নি। আওয়ামী লীগের সদস্যদ্বয় ১৯৪৭-এর পূর্বে মুসলিম লীগ দলের সদস্য ছিলেন। নির্বাচিত সদস্যদের পেশার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখানাে হয়েছে যে, আইন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক- ৫১%। জমিদার ভূস্বামী ১১%, | শিক্ষাবিদ ৯%, সাংবাদিক ৩%, ডাক্তার ৬%, অন্যান্য ৯%।
কেউই শিল্পপতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেননি। অন্যান্য বলতে ধর্মপ্রচার করা, সার্বক্ষণিক রাজনীতি করা, সার্বক্ষণিক জনসেবা করা প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন। | ১৮৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের মাত্র ১৪%-এর ইতােপূর্বে কোনাে না কোনাে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। এই তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৫৪ সালে গঠিত ব্যবস্থাপক পরিষদ পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা অনভিজ্ঞদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। তবে অন্তত ২৫% সদস্যের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে (ইউনিয়ন বাের্ড, লােকাল বাের্ড, ডিস্ট্রিক্ট বোের্ড) সংশ্লিষ্ট থাকার পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল।  পর্যালােচনা ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব অত্যাধিক। পূর্ববাংলায় এটি ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষভােটে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচন ছিল অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনে সরকারি দলের এমন শােচনীয়। পরাজয় ছিল বিরল ঘটনা। পূর্ববাংলার তৎকালীন সরকার নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা এড়ানাের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেন, কিন্তু নির্বাচনে কারচুপির প্রচেষ্টা করেননি। এই নির্বাচনে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যালটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের সুযােগ লাভ করেছিল এবং তারা উক্ত সুযােগের সদ্ব্যবহার করেছে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার দাবির সপক্ষে ভােট দিয়ে জনগণ পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিল। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের ফলে পাকিস্তান গণপরিষদে উক্ত দলের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পায়, ফলে পাকিস্তানের কোয়ালিশন সরকার গঠন অপরিহার্য। হয়ে পড়ে।
পূর্ববাংলায় সেই-যে মুসলিম লীগের পতন ঘটল, এরপর আর কখনাে এখানে মুসলিম লীগ শক্তিশালী হতে পারেনি। খ. যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামল যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন নির্বাচনে মওলানা ভাসানী এবং সােহরাওয়ার্দী প্রার্থী হননি। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছেন। অপরদিকে সােহরাওয়ার্দী জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি করবেন বলে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেননি। নির্বাচনে ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দীর অংশ না-নেয়ায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল নির্বাচনে জয়লাভ করলে এ. কে. ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি বাের্ডের নেতা নির্বাচিত হবেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি পূর্ববাংলায় সরকার গঠনের আমন্ত্রণ পান এবং তার নেতৃত্ব ৩ এপ্রিল (১৯৫৪) চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির সৈয়দ আজিজুল হক ও আবু হােসেন সরকার এবং নেজামে এছলামীর মৌলভী আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী। প্রাদেশিক আইন পরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন যথাক্রমে কৃষক শ্রমিক-পার্টির আবদুল হাকিম এবং আওয়ামী লীগের শাহেদ আলী। নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় কেন্দ্রীয় সরকার সুনজরে দেখেনি। স্বভাবতই তারা যুক্তফ্রন্টের ভাঙন চেয়েছে। এমতাবস্থায় যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলির সাবধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না হয়ে শুরুতেই মন্ত্রিপরিষদ গঠন নিয়ে মনমালিন্য শুরু হয়। ৩ এপ্রিল ফজলুল হক যে ৩ জনকে মন্ত্রি পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন তাদের ২ জন তার দলের এবং ১ জন নেজামে এছলামীর। এ সময় আওয়ামী লীগ বাদ পড়ে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ দলীয় দিস্য নির্বাচন নিয়ে ফজলুল হকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতানৈক্য ঘটে। আওয়ামী লীগের মনােনীত সদস্যদের মধ্যে শেখ। মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমানের নাম ছিল ।
ফজলুল হক এই দুজনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি ছিলেন না। ১৫ মে পর্যন্ত এ বিষয়ে আপােষ হয়নি। ইতােমধ্যে ফজলুল হকের কলিকাতা ভ্রমণকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন অভিযােগ উত্থাপন করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ফজলুল হক ৩০ এপ্রিল সরকারি সফরে কলিকাতা যান এবং সেখানে বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় যেসব ভাষণ দেন তার মূল কথা ছিল: রাজনৈতিক কারণে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে থাকলেও বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বাঙালিত্বের যে একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে তা দুটি বাঙলায়ই বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও বর্তমান থাকবে। ফজলুল হকের এসব মন্তব্যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তথা পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার। তাকে অপসারণের উপায় খুঁজে পেলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হলাে যে তিনি ভারতের কাছে পূর্ববাংলাকে বিক্রি করে দিতে চান।
এমতাবস্থায় ফজলুল হক আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন। ১৫ মে (১৯৫৪) আওয়ামী লীগ দলীয় কিছু সদস্যকে, এমনকি তার অপছন্দনীয় শেখ মুজিব। ও আতাউর রহমান খানকে তিনি তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু চক্রান্তকারীর এই নতুন মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাের জন্য নানান ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা অত্যন্ত সূচতুরভাবে পূর্ববাংলার শিল্প-এলাকাগুলােতে বাঙালি-অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে অভিযােগ উত্থাপন করে যে, প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তফ্রন্ট সরকার ব্যর্থ । এ সময় একজন সাংবাদিক পরিস্থিতি ঘােলাটে করতে সাহায্য করে। এ. কে. ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে উপস্থিত হতে করাচি গেলে নিউইয়র্ক টাইমস’-এর সংবাদদাতা জনপি কালাহান তার এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এবং ২৩ মে সাক্ষাৎকারটি বিকৃত করে প্রকাশ করেন। উক্ত সাক্ষাৎকারে ফজলুল হক পূর্ববাংলার অধিক স্বায়ত্তশাসন পাওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু কালাহান লেখেন যে, ফজলুল হক পূর্ববাংলার স্বাধীনতা চান। রিপাের্টটি প্রকাশিত হলে হক সাহেব এর বিরােধিতা করেন। কিন্তু পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী মি, কালাহানের রিপাের্টটিই বিশ্বাস করে এবং ফজলুল হককে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করে।
আসলে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সাফল্য মুসলিম লীগ ও কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী সুনজরে দেখেনি। তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার নানান উপায় খুঁজতে থাকে এবং তারই প্রেক্ষিতে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযােগ উত্থাপন করতে থাকে। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার ২৯ মে (১৯৫৪) পূর্ব বাংলায় ফজলুল হক মন্ত্রিসভা বাতিল করে প্রদেশের ওপর গভর্নরের শাসন জারি করে। পূর্ববাংলায় গভর্নরের শাসন। ১৯৫৫ সালেই জুন পর্যন্ত বহাল থাকে। ইতােমধ্যে ১৭ মে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার। মীর্জাকে পূর্ববাংলার গভর্নর নিয়ােগ করা হয়েছিল। এক্ষণেই তিনিই গভর্নর হিসেবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়। তিনি পূর্ব বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। গভর্নরের শাসনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তফ্রন্টের ৬৫৯ জন সক্রিয় কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ১ জন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী (শেখ মুজিবুর রহমান) এবং ১৩ জন নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকেও গ্রেফতার করা হয়। জুনের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় এক হাজার বাঙালিকে বন্দি করা হয়। ফজলুল হককে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কম্যুনিস্ট পার্টিকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় ।
এই দলের অনেক নেতা ও কর্মীকে বন্দি করা হয়। গভর্নরের শাসন জারির সময় মওলানা ভাসানী ও সােহরাওয়াদী বিদেশে অবস্থান করছিলেন। ফলে নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে গভর্নরের শাসন জারি করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব বাংলায় কোনাে প্রতিবাদ কিংবা মিছিল-মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি। এইভাবে সন্দেহজনক সকল বামপন্থী নেতা ও কর্মীকে বন্দি করার পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যে ফজলুল হককে দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়া হয়েছিল তাকেই পদচ্যুত করার ২ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। ফজলুল হক কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আঁতাত করার সুযােগ পেয়ে পূর্ববাংলায় তার দলের (কৃষক-শ্রমিক পার্টি) সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার তদবির করতে থাকেন। যদিও যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তথাপি আবু হােসেন সরকারকে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী করার চেষ্টা করতে থাকেন। এর ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (বগুড়ার মােহাম্মদ আলী) সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযােগ দানের পক্ষে যুক্তি পেশ করেন। মােহাম্মদ আলী স্বীকার করেন যে, প্রাদেশিক পরিষদে বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রিত্ব দাবি করতে পারেন, কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি কীভাবে একজন কম্যুনিস্টকে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সুপারিশ করবেন? আতাউর রহমান খানকে কম্যুনিস্ট বলার কারণ এই যে, তিনি ১৯৫২ সালে পিকিঙে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যােগদান করেছিলেন। উক্ত সম্মেলনে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য নেতা যােগদান করেও কম্যুনিস্ট আখ্যা পাননি, কিন্তু আতাউর রহমান খানকে কম্যুনিস্ট বলা হল । উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিয়ে ফজলুর হকের দলকে ক্ষমতা দেয়া এবং এইভাবে যুক্তফ্রন্টকে খণ্ডিত করা। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ভাঙন ধরানাের কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা অচিরেই সফল হয়। আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় এ. কে. ফজলুল হককে পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেই সুবাদে তিনি যুক্তফ্রন্টে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু তিনিই যখন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে পূর্ববাংলা সরকার গঠনের জন্য চেষ্টা শুরু করেন তখন স্বভাবতই যুক্তফ্রন্টের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্দ ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি নেতা হিসেবে ফজলুল হকের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগের জন্য হিতে বিপরীত হয় । ৩২ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য পাটি পরিবর্তন করে কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যােগদান করে। এই ধারা অব্যাহত থাকে, ফলে ২ এপ্রিল (১৯৫৫)এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যসংখ্যা ১৪০ থেকে ৯৮-এ নেমে আসে। তখন কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য সংখ্যা ৩৪ থেকে বেড়ে ৬৯ হয় এবং নেজামে এছলামী। সদস্য সংখ্যাও বেড়ে ১২ থেকে ১৯ হয়। তাছাড়া আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেবার কারণে ২০ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলবদ্ধ হয় এবং তারা কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে এছলামীকে সরকার গঠনের ব্যাপারে সমর্থন হয়। এইভাবে যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে এছলামী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ। গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দলের সদস্যবৃন্দ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, অন্য দিকে খিলাফতে রব্বানী পার্টি ও কিছু হিন্দু-সদস্য ফজলুল হকের জোটকে সমর্থন দেন। এইভাবে পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্টভুক্ত মুসলমান সদস্যবৃন্দ দুই ধারায় বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগের ধারাটি ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গ্রহণ করে, অপরপক্ষে ফজলুল হকের জোট রক্ষণশীল ধারার রাজনীতি গ্রহণ করে মুসলিম লীগের নিকট নিজেদেরকে গ্রহণযােগ্য করে তােলে।
কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার কেবল যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয় না, তার সােহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করে পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগকে বামপন্থীদের সমালােচনার সম্মুখীন করে। ফজলুল হক এবং সােহরাওয়ার্দী-উভয়েই কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, অথচ পূর্ববাংলায় মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমােদন দেয়। আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রি পরিষদের যােগদান করে কৃষকশ্রমিক পার্টি, নেজামে এছলামী, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস নবনিযুক্ত কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার প্রতি প্রাদেশিক আইনপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা ও সমর্থন আছে কিনা তা প্রমাণ করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষদের অধিবেশন আহবানের দাবি করা হলেও সরকার পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে অস্বীকার করেন। এমনকি পরবর্তী আট মাসের আইনপরিষদের কোনাে সভা আহ্বান করা হয়নি। উপরন্তু আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব রক্ষার্থে ১৯৫৬ সালে ৫ মার্চ ফজলুল হক পূর্ববাংলার গভর্নর পদ লাভে সক্ষম হন। গভর্নর পদে। যােগদান করে ফজলুল হক ২২-৫-৫৬ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহবান করেন। কিন্তু বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলে মন্ত্রিসভার পতন হবে-এই আশঙ্কায় গভর্নর ২৪ মে (১৯৫৬) আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখেন। পূর্ববাংলায় মন্ত্রিসভা সংবিধান অনুসারে চালানাে যাচ্ছে না এই কারণ দেখিয়ে জরুরি ক্ষমতা বলে এখানে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। সাত দিন পর কেন্দ্রের শাসন। প্রত্যাহার করে আবু হােসেন সরকারের পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা পুনর্বহাল করা হয়। যদিও তখন আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানাে এবং সংসদে তার। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদানের সুযােগ দেয়াই সংসদীয় রীতি ছিল, কিন্তু তা উপেক্ষিত হয়।  ফজলুল হকের গভর্নর পদ লাভ ও তার দলের মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমতি লাভের পিছনে মুসলিম লীগকে দেয়া তাদের ২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল।
প্রথমত পাকিস্তান মন্ত্রী পরিষদে পাস করার জন্য যে খসড়া সংবিধান পেশ করা হবে তা তার দল সমর্থন করবে। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি সমর্থন করবে না। | পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদসহ মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সুযােগ লাভের বিনিময়ে ফজলুল হক দল উপরিউক্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল। তারা পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া-সংবিধান সমর্থন করে। অপরদিকে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানে পাকিস্তানকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ রূপে ঘােষণা করাকে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বিরােধিতা করে। আওয়ামী লীগ সংবিধানে যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা ও পূর্ববাংলার জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি করে। কিন্তু গণপরিষদে কৃষক-শ্রমিক পাটি মুসলিম লীগকে সমর্থন করায় কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার সংবিধান পাস করিয়ে নিতে সমর্থ হন। আওয়ামী লীগ গণপরিষদ থেকে ওয়াকআউট করে এবং সংবিধানে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। তবে সােহরাওয়াদী ব্যক্তিগতভাবে সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টি যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা বিরােধিতা করায় পূর্ববাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যালঘু সদস্যবৃন্দ কৃষক-শ্রমিক পার্টির সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এ সময় পূর্ববাংলায় আবু হােসেন সরকারের কৃষক-শ্রমিক পার্টির প্রতি কেবলমাত্র নেজামে এছলামী সমর্থন অব্যাহত রাখে।
এমনি অবস্থায় ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে প্রাদেশিক আইনপরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। কিন্তু আইনপরিষদে আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা আস্থা ভােটের সম্মুখীন হলে সুনিশ্চিত পরাজিত হবে বুঝতে পেরে মুখমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে গভর্নর এ. কে. ফজলুল হক উক্ত পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। এভাবে পুনরায় আবু হােসেন সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। কিন্তু তারা প্রাদেশিক সরকারের পতন ঠেকাতে পারেনি। ইতােমধ্যে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোয়ালিশন সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সেই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে। শেষ পর্যন্ত ৩০ আগস্ট (১৯৫৬) আবু হােসেন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটার পর ৬ সেপ্টেম্বর (১৯৫৬) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই কোয়ালিশন সরকার গণতন্ত্রী দল, রফিক হােসাইন-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অংশ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু দল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কোয়ািলিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৯ জন সদস্যের। মধ্যে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের প্রতি ২০০ জন সদস্যের সমর্থন ছিল। এই ২০০ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা  ছিল ৯৮ জন, গণতন্ত্রী দলের ১২ জন, সংখ্যালঘু ৭২ জন এবং ১৮ জন আওয়ামী মুসলিম লীগের । পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ৫ দিন পর কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে মুসলিম লীগ থেকে কিছু সদস্য বেরিয়ে যেয়ে রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেছিলেন।
তখন পাকিস্তান গণপরিষদের ৮০ জন সদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩ এবং রিপাবলিকান পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০ জন। তাছাড়া গণপরিষদের ১ জন গণতন্ত্রী দলীয় সদস্য ও ৭ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য আওয়ামী লগ রিপাবলিকান কোয়ালিশন সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞান করেন। ফলে গণপরিষদে কোয়ালিশনের পক্ষে সদস্য সংখ্যা হয় ৫১ জন। একই সঙ্গে কেন্দ্রে এবং প্রদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে পূর্ববাংলায় অনেক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়। পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের। ক্ষমতার ভিত্তি ছিল জোতদারশ্রেণী এবং উঠতি বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণী। এই শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার্থে ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে জুট ট্রেডিং করপােরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। পূর্ববাংলা প্রদেশ পাওয়ার-স্টেশন নির্মাণ, শিল্পের বিকাশ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সাধনের উদ্দেশে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। পূর্ববাংলার ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আমদানি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এখানকার ধনী কৃষক ও জোতদারশ্রেণী এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তাদের পুঁজি যাতে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় নিয়ােগ করতে পারে সে জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পূর্ব বাংলায় ২ বৎসরের শাসনামলে (মাঝে মধ্যে বিরতিসহ) আওয়ামী লীগ সরকার ফেঞ্চুগঞ্জে গ্যাস কারখানা স্থাপন করে; সাভারে ডেয়ারি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন, ঢাকা-আরিচা, নগরবাড়ি-রাজশাহী এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম যােগাযােগ সড়ক নির্মাণ করে; ঢাকা শহরে রমনা পার্ক গড়ে তােলে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধার জন্য ওয়াটার এ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বাের্ড (ওয়াপদা) প্রতিষ্ঠা করে, ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র স্টুডিও এফ.ডি.সি (ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠা। করে। সরকার ভাষা শহীদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘােষণা করে।
বাংলা একাডেমী বাংলায় পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বল্পকালীন শাসনামলে আরাে যে-সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: প্যানিং বোের্ড গঠন, তিন বছর উন্নয়ন পরিকল্পনা (১৯৫৭-৬০) প্রণয়ন, শিক্ষা। সংস্কার কমিটি গঠন, আলিয়া মাদরাসার ভবন নির্মাণের জন্য প্রথমবারের মতাে চল্লিশ হাজার টাকা অনুমােদন, ময়মনসিংহে পশু চিকিৎসা কলেজ স্থাপন, কৃষিঋণ সার্টিফিকেট ঋণ বাতিল, বন উন্নয়ন, স্থায়ী শিল্প ট্রাইবুনাল গঠন, ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা এবং গ্রেটার ঢাকা সিটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ইত্যাদি। অতএব বলা যায় যে, আওয়ামী লীগ সরকার তার স্বল্পকালীন শাসনামলে | পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামল শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে পার্টির অভ্যন্তরে কোন্দল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় থেকেই অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী এই পার্টিতে ঢুকে পড়ে। পার্টির এই অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি এবং পূর্ববাংলার সরকারের লাইসেন্স পারমিট বিতরণ নীতির কঠোর সমালােচনা শুরু করেন। মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে সমালােচনা করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে তা পার্টির মেনিফেস্টো বিরােধী। এভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্নমতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মনােমালিন্য এবং আওয়ামী লীগে অবস্থানরত বামশক্তির প্ররােচনায় শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে ইস্তাফা দেন (১৯৫৭ সালে ২৪ জুলাই) এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি ন্যাপ) গঠন করেন। তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ন্যাপ গঠনের ফলে প্রাদেশিক পরিষদের ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নবগঠিত ন্যাপ-এ যােগ দেন। এই সুযােগে কৃষক-শ্রমিক পাটি ও মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানাের চক্রান্ত শুরু করে। এই চক্রান্ত ফলপ্রসূ হয়। ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য এবং রসরাজ মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু সদস্যবৃন্দ আওয়ামী লীগ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। এমতাবস্থায় সরকার আসন্ন আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন কিছুদিন স্থগিত রাখার অনুরােধ করেন। কিন্তু গভর্নর পদে তখন ফজলুল হক অধিষ্ঠিত আছেন। তিনি উল্টো মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন (৩১-৩-৫৮) ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান (৩১-৩-৫৮)। এ সময় কেন্দ্রে ফিরােজ খান নূনের মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে ছিল। স্বভাবতই পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলার গভর্নরকে (এ. কে. ফজলুল হক) বরখাস্ত করেন (১-৪-৫৮)।
পূর্ববাংলার চিফ সেক্রেটারিকে অস্থায়ী গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়। নতুন অস্থায়ী গভর্নর আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বহাল করেন (১-৪-৫৮)। সরকার আইনপরিষদে আস্থা ভােট দেন এবং ১৮-২১১৭ ভােটে জয়লাভ করেন। কিন্তু এর দেড় মাস পরেই (১৮ জুন ১৯৫৮) পরিষদে খাদ্য পরিস্থিতির ওপর ভােটাভুটিতে আওয়ামী লীগ সরকার (১২৬-১৩৮) ভােটে হেরে যায়, তখন ন্যাপ ভােটদানে বিরত থাকে। ফলে ১৯ জুন (১৯৫৮) মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে এবং ২০ জুন তদস্থলে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকার একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু ইতােমধ্যে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ন্যাপের সমর্থন আদায় করে । ন্যাপের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগে আইন পরিষদে (২৩-৬-৫৮ তারিখে) আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভাকে অনাস্থা ভােটে (১৫৮-১৪২) পরাজিত করে। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিয়ে পূর্ববাংলায় কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয় (২৫-৬-৫৮)। দুইমাস পর কেন্দ্রের শাসন প্রত্যাহার করা হয় এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয় (২৫-৮-৫৮)। এইভাবে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাস থেকে ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে প্রদেশে সাতটি মন্ত্রিসভা ও তিনবার গভর্নরের শাসন চালু হয়। ১৯৫৮ সালের বাজেটের ব্যাপারে চারটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত বাজেট পাস সম্ভব হয় না। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে আইনপরিষদে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয় এবং অক্টোবরে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে আইনপরিষদের অবসান ঘটে।
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, আইন পরিষদের স্পিকার (জনাব আবদুল হাকিম) ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির এবং ডেপুটি স্পিকার (জনাব শাহেদ আলী) ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় । যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর থেকে কখনাে কৃষক-শ্রমিক পাটির সরকার আবার কখনাে আওয়ামী লীগের সরকার দেশ পরিচালনা করে। ১৯৫৮ সালের আওয়ামী লীগ স্পষ্টত অভিযােগ উত্থাপন করে যে, স্পিকার আবদুল হাকিম নিরপেক্ষ নন। এরই প্রেক্ষিতে ২০ সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে দেওয়ান মাহবুব আলী এম. পি. অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্পিকার এক রুলিং দিয়ে তা বাতিল করেন। ফলে পরিষদ ভবনের মধ্যে গােলযােগ হয়। স্পিকার পরিষদ-কক্ষ ত্যাগ করেন। তখন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় দেওয়ান মাহবুব আলী স্পিকারের বিরুদ্ধে তার অনাস্থা প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করলে। ১৭০ জন সদস্য তা সমর্থন করেন। ডেপুটি স্পিকার প্রস্তাবটি ভােটে দিলে তা গৃহীত হয়। অতঃপর পিটার পল গােমেজ নামক একজন এম.পি, স্পিকার আবদুল হাকিমের মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তাও গৃহীত হয়। এরপর স্বভাবতই স্পিকার আবদুল হাকিম আর স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। কিন্তু কৃষকশ্রমিক পার্টির সদস্যবৃন্দ এই পরিবর্তন মানেনি। পরবর্তী ২ দিন চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য সৈয়দ আজিজুল হকের সভাপতিত্বে স্বল্প সময়ের জন্য অধিবেশন চলে। কিন্তু তার পরদিন (২৩ সেপ্টেম্বর) ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী স্পিকারের চেয়ারে বসামাত্র কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও তার সমর্থক দলের সদস্যবৃন্দ জনাব শাহেদ আলীকে। উক্ত চেয়ারে আসন গ্রহণ না করার দাবি করে। কিন্তু শাহেদ আলী আসন গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষেপ হতে থাকে। এ বিষয়ে কৃষক-শ্রমিক পার্টির সমর্থক পত্রিকা ‘আজাদ’ রিপাের্ট করে: ঐ সময় একটি বস্তু ডেপুটি স্পিকারের উপর নিক্ষিপ্ত হওয়ায় তিনি মুখে আঘাত পান এবং আহত স্থান হইতে রক্তপাত হইতে থাকে।
নিক্ষিপ্ত বস্তুটি সম্ভবত সদস্যদের ডেস্কের সহিত সংযুক্ত লেখার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের ভগ্নাংশ । আহত অবস্থায় শাহেদ আলীকে হাসপাতালে নেয়া হয় সেখানে তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) বেলা ১:২০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। এই ঘটনা পূর্ববাংলা জাতীয় পরিষদের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এরপর ৭ অক্টোবর (১৯৫৮) পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হলে পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অবসান ঘটে। যুক্তফ্রন্ট শাসনকাল পর্যালােচনা ১৯৫৪ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে এই প্রদেশে একটি সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ। আসে। কিন্তু মুসলিম লীগ দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে এবং সর্বোপরি যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলাের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংখ্যালঘু সংসদ-সদস্যদের ঘন ঘন সমর্থন বদলের কারণে ঘন ঘন সরকার বদল হতে থাকে। মাত্র চার বৎসরে সাতটি মন্ত্রিসভার । পতন ঘটে এবং তিনবার গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। ফলে বহু প্রত্যাশিত ২১ দফার দাবিগুলাে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি এবং দেশের উন্নয়ন সাধনের যে সুযােগ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ পেয়েছিলেন তা তারা নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেননি। উপরন্তু যুক্তফ্রন্ট ভুক্ত একটি দলের (কৃষক-শ্রমিক পার্টির) এম.পিদের দ্বারা অন্য দলের (আওয়ামী লীগের) সমর্থিত স্পিকারকে পিটিয়ে হত্যা করা চুয়ান্নোর নির্বাচনে গঠিত আইন পরিষদের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
সহায়ক গ্রন্থ
সিরাজুল ইসলাম (প্রধান সম্পাদক), বাংলাদেশের ইতিহাস, (১৭০৪-১৯৭১) প্রথম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৯০ আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ঢাকা, ১৯৯৬ হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিরপত্র, প্রথম খণ্ড, ঢাকা ১৯৮২ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, তিন খণ্ড, ঢাকা, ২০১১ বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ঢাকা, ১৯৮৫। জয়ন্ত কুমার রায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, ঢাকা, ২০০৯। মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায়, বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ঢাকা, ২০১৩।
 

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান