You dont have javascript enabled! Please enable it!
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
এরপর ১৯৫২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে ভাষা আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় খাজা নাজিমউদ্দীনের এক উক্তিতে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ববাংলা সফর করতে এসে (২৭-১-১৯৫২) এক জনসভায় তিনি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরূপ ঘােষণা দেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই ঘােষণায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। খাজা নাজিমউদ্দীনের উক্তির প্রতিবাদে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জানুয়ারি (১৯৫২) ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ৩০ জানুয়ারির সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে ব্যাপক করার উদ্দেশ্যে ৩১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমুদ্দন মজলিশ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ, যুব সংঘ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ২৮ মতান্তরে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উক্ত পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচী সমর্থন করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও সভার কর্মসূচী ঘােষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল।
‘২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল ঐ অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরফ হতে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচীর প্রতি প্রাদেশিক সরকার কঠোর মনােভাব প্রদর্শন করে। ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য সমস্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার অর্থ একসঙ্গে ৪ জনের বেশি লােকের সমাগম, মিছিল, শশাভাযাত্রা, সভা ও সমাবেশ করা আইনবিরােধী। সরকারি ঘােষণায় বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং তারা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত করেন। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় (২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত) ভােটাভুটিতে ১১ জন ১৪৪ ধারা না-ভাঙার পক্ষে ও ৪ জন ভাঙার পক্ষে ভােট দেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে ১৪৪ ধারা না-ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নেতা অলি আহাদের আনীত একটি প্রস্তাব গৃহীত ও সংযােজিত হয়। এ প্রস্তাবটি ছিল : ‘যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পথে নেমে পড়ে, তাহলে উক্ত কমিটির সিদ্ধান্ত বাতিল বলে গণ্য হবে এবং এই কমিটিও বাতিল বলে ধরে নেয়া হবে। এই সিদ্ধান্তগুলাে লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। যদিও পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৮ কিংবা ৪০ ছিল কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, মাত্র ১৫ জন ভােটাভুটিতে অংশগ্রহণ করে। বাকিরা সভায় অনুপস্থিত ছিলেন, না উপস্থিত থেকেও ভােটে অংশ নেননি তা জানা যায় না। যাহােক, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দলের দলীয় সিদ্ধান্ত কী ছিল তা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। যাহােক, ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ছাত্ররা, যুবলীগের নেতা ও কর্মীগণ এবং ছাত্রনেতাদের কয়েকজন পৃথকভাবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি
১৪৪ ধারা ভাঙা, না-ভাঙার আলােচনা হয় ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত পর্যন্ত, ফলে সভার সিদ্ধান্ত প্রচারিত হওয়ার সময় ছিল না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার, ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, ২৪ জমাদিয়ুল আউয়াল ১৩৭১ হিজরি। পূর্ব ঘােষণানুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা জমায়েত হতে থাকে। রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা দুজন দুজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে আসে। বেলা ১১টায় ছাত্রসভা শুরু হয়। সভায় সর্বদলীয় কর্মী পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে কর্মপরিষদকে লুপ্ত ঘােষণা করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৪৪ ধারা ভাঙার পন্থা হিসেবে দশজন দশজন করে ছাত্র রাস্তায় মিছিল বের করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ পূর্বরাত্রে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত দিলেও ছত্রিসভার সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখিয়ে তা মেনে নেয় এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এদের অনেকেই এদিন গ্রেফতার হন। “জনাব শামসুল হকও পরবর্তীকালে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন।
খণ্ড মিছিলগুলাে যখন ১৪৪ ধারা ভাঙতে পথে নামছিল তখন রাস্তায় অপেক্ষমান পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু কতজনকে পুলিশ আটক করবে? অবশেষে পুলিশ মিছিলকারীদের উপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। এতেও মিছিলকারীদের ঠেকাতে না পেরে নিক্ষেপ করে শত শত কাঁদুনে গ্যাস। পুলিশী হামলার মুখে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানের অনুচ্চ প্রাচীর টপকে মেডিকেল হােস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে আবার জমায়েত হন। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববাংলা আইন পরিষদে যােগদানকারী সদস্যদের কাছে বাংলাভাষার দাবির কথা পৌছে দেয়া। তখন জগন্নাথ হলের অডিটোরিয়ামে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সভা বসত। আইন পরিষদের সদস্যবৃন্দ যেন অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সুপারিশ গ্রহণ করেন সে জন্য তাদেরকে অনুরােধ করাও ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীর অংশ ছিল। প্রায় বেলা ২টা পর্যন্ত মিছিল নিয়ে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতার বরণ করতে থাকে।
তখন ধীরে ধীরে ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে জমায়েত হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে বের হতেই উদ্ধত পুলিশবাহিনী এসে তাড়া করে। বেলা প্রায় সােয়া তিনটার সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদে আসতে থাকেন। ছাত্ররা যতই স্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় ততই পুলিশ হানা দেয়। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস ছেড়ে তাড়া করতে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের ভিতর ঢুকে পড়ে। হােস্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয় ইট-পাটকেল ছুঁড়তে। একদিকে ইট-পাটকেল, আর অন্যদিকে থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ। ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন। আর ১৭ জনের মতাে গুরুতর আহত হন। তাদের হাসপাতালে সরানাে হয়। তাদের মধ্যে রাত আটটার সময় আবুল বরকত শহীদ হন। গুলি চালানাের সাথে সাথেই পরিস্থিতির অচিন্তনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। তখন ছাত্রছাত্রীদের চোখেমুখে যেন ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুন ঝরে। মেডিকেল হােস্টেলের মাইক দিয়ে তখন পুলিশি হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। আইন পরিষদের সদস্যদের প্রতি ছাত্রদের উপর গুলি চালাবার প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জন করার দাবি জানানাে হয় । ১৪৪ ধারার নাম-নিশানাও তখন আর পরিলক্ষিত হয় না। গুলি চালানাের সংবাদ। দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্তে প্রান্তে। তখনই অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট, বেতারকেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসে।
একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ
২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় শহীদদের সংখ্যা ও পরিচয় নিয়ে যথেস্ট মতভেদ লক্ষ্য। করা যায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরপরই নেতৃবৃন্দের আত্মগােপন করার কারণে। লাশের পরিচয় ও সংখ্যা সম্পর্কে তারা অনেকেই অজ্ঞাত থাকেন, উপরন্তু রাতে পুলিশ কর্তৃক হাসপাতাল থেকে অধিকাংশ লাশ সরিয়ে ফেলার ফলেও পরবর্তীতে নানান প্রশ্নের অবতারণা হয়। সকলেই যে ২১ ফেব্রুয়ারিতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা নয়, আহতদের কেউ কেউ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন সালাম মৃত্যুবরণ করেন ৭ এপ্রিল (১৯৫২)। আবার ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি যে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েও কেউ কেউ শহীদ হন। যাহােক, ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় উক্ত দিন ও পরে কমপক্ষে ৬ জন যে শহীদ হয়েছিলেন। সে বিষয়ে সরকারি বিবরণী অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়া যায়। দুঃখজনক যে, আন্দোলনের সংগঠকরা সরকার প্রদত্ত নামের বাইরে শহীদদের আর কারাে নাম উদ্ধার করতে পারেনি। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম শহীদ হচ্ছেন রফিকউদ্দিন আহমদ। তখন তার বয়স ছিল উনিশ বা বিশ । তিনি মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে আই.কম, দ্বিতীয় বর্ষে। পড়তেন। তিনি কেন ঢাকায় এসেছিলেন তা জানা যায় না। ‘শহীদ রফিককে দাফন করা হয়েছিল আজিমপুর গােরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায়। পরেও তার কবর। সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি বলে সেখানে নতুন কবর পড়েছে।
শহীদ আবুল বরকতের জন্ম ১৬ জুন ১৯২৭ মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলাতলে। পিতার নাম শামসুজ্জোহা। স্থানীয় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ববাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় তার মামা (এসএনজি বিভাগের এ্যাসিস্টেন্ট একাউন্ট অফিসার) মালেক সাহেবের বাসায় পুরানা পল্টন লাইনের ‘বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে’ উঠে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত থাকেন। ১৯৪৮ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। তিনি অত্যন্ত মনােযােগী ছাত্র, ভদ্র, নম্র, বিনয়ী, চরিত্রবান ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত লম্বা ছিলেন ।
১৯৫১ সালে তিনি অনার্স পরীক্ষায় ২য় শ্রেণীতে ৪র্থ স্থান পান। মালেক সাহেবের। প্রচেষ্টায় রাত ১০টার দিকে বরকতের লাশ হাসপাতাল থেকে কড়া পাহারায় বের করে আজিমপুর গােরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। বরকতের মামা মালেক সাহেব পরিবারের পক্ষ থেকে কবরের জায়গা কেনার টাকা এবং কাফনের খরচ দেন। পরে বরকতের পরিবার থেকেই তার কবর পাকা করে দেয়া হয়। তার সমাধি এখনাে আজিমপুর গােরস্থানে আছে। শহীদ শফিউর হাইকোর্টের একজন কর্মচারী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত কোনগর গ্রামে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি তার জন্ম। কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই.কম, পাস করার পর তিনি চাকুরি নেন। দেশ বিভাগের পর তিনি স্ত্রী আকিলা বেগম ও পরিবারের অন্য সদস্যসহ ঢাকায় আসেন এবং হাইকোর্টে চাকুরি পান। তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি অফিসে যাওয়ার পথে নবাবপুর রােডে গুলিবিদ্ধ হন। অনেক ধরাধরির পর শফিউরের পরিবার লাশের কাফন পরিয়ে দেয়ার অনুমতি পায়। রাত তিনটায় আজিমপুরে তাকে দাফন করা হয়। তার সমাধি আজিমপুর গােরস্থানে রক্ষিত আছে। শহীদ আবদুল জব্বার ছিলেন একজন দর্জি। গফরগাঁওয়ের পাঁচাইয়া গ্রামের আবদুল কাদেরের পুত্র। শহীদ অহিউল্লাহর বয়স ছিল মাত্র ৮/৯ বছর। রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে (অহিউল্লাহ) ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রােডে খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে নিহত হয় এবং তার লাশ অপসারিত হয়। শহীদ আবদুস সালাম ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হন। তবে শাহাদত বরণ করে এপ্রিল, ১৯৫২ তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজে (ইডন বিল্ডিংয়ে) পিয়নের কাজ করতেন। ঢাকায় ৩৬ বি, নীলক্ষেত ব্যরাকে বাস করতেন। তিনি নােয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার লক্ষণপুর গ্রামের মােহাম্মদ ফাজিল মিয়ার পুত্র। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
২১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ঘটনাবলী
২১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকারে প্রতিবাদস্বরূপ ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ মিছিলে। গুলিবর্ষণ করে এবং কমপক্ষে ২ মৃত্যুবরণ করে। ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি চারদিন ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্রে’ পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। ফলে কেবল সংবাদ বুলেটিন ছাড়া অন্য কোনাে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়নি। একুশের ঘটনার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে। গভর্ণর ও স্পিকারের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি লেখেন: | বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি । যে নুরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক- এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে লজ্জাবােধ করিতেছি।’ মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুসারে ড. সাঈদ হায়দার নকশার পরিকল্পনা করেন। মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ইট, বালি, রড, সিমেন্ট মজুদ ছিল । ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মিনার নির্মাণে সেই রসদগুলি ব্যবহৃত হয়। অজ্ঞাতনামা দুই রাজমিস্ত্রি মিনার নির্মাণ করে। তাদেরকে সাহায্য করেন দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা ২৪ তারিখে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ উক্ত মিনারটি ভেঙে ফেলে। 
২৫ মার্চ (১৯৫২) শহীদ আবুল বরকতের ছােট ভাই আবুল হাসনাত ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মহকুমা হাকিমের এজলাশে। মামলা দায়ের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৩৭ ও ১৩২ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনাে সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ গ্রহণ করা যায় না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু আবেদনকারী অনুরূপ কোনাে অনুমতিপত্র দাখিল করতে পারেনি তাই অভিযােগটি খারিজ করে দেয়া। হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির পুলিশী ও মিলিটারি কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লঙ্ঘন করার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন। শিক্ষার মাধ্যমরূপে বাংলা প্রবর্তনের জন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করেন। যে সব রাজনীতিবিদ এতদিন ভাষা আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন তাঁরা (যেমন এ.কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ) ২৩ ফেব্রুয়ারি সিভিল লিবার্টি কমিটি’ বা ব্যক্তিস্বাধীনতা কমিটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা ঘােষণা করেন। ইতােমধ্যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে এক সভা অনুষ্ঠিত করে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারকে বাংলাভাষার দাবি পূরণের জন্য ৫ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয় এবং ঐ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে নতুন আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। সরকারও জেল-জুলুমের নীতি অবলম্বন করে। পুলিশ এমনকি চারজন গণপরিষদ সদস্যকে (আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, মনােরঞ্জন ধর ও গােবিন্দলাল। ব্যানার্জী) জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষককেও (প্রক্টর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড, বি.সি চক্রবর্তী, অজিত কুমার গুহ প্রমুখ) গ্রেফতার করে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক নেতা। গ্রেফতার জেল-জুলুম এড়ানাের জন্য অনেক রাজনৈতিক নেতা আত্মগােপন করেন। সরকার দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য সারাদেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ প্রচারপত্র বিলি করে। আন্দোলনকারীদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি সুপারিশ পাকিস্তান গণপরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। তাছাড়া প্রদেশবাসীর কাছে তাকে এবং সরকারকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তিনি। ১৯৫২ প্রদেশবাসীর উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি প্রমাণ করতে চান যে।
‘রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়, ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নিহিত আছে। পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার। জন্য কেন্দ্রীয় গণপরিষদের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করলেও গণপরিষদের অধিবেশনে সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধার সম্মুখীন হয়। পূর্ববাংলা থেকে নির্বাচিত মুসলিম লীগ —গণপরিষদ সদস্য নূর মােহাম্মদ বাংলাভাষা সংক্রান্ত পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সুপারিশের বিষয়টি গণপরিষদের অধিবেশনে উত্থাপন করলেও পূর্ববাংলার জন্য কোন মুসলিম লীগ সদস্য তা সমর্থন করেননি। কেবল কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও প্রফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী উক্ত প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য পেশ । করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য সরদার শওকাত হায়াত খান। (পাঞ্জাব), সরদার আসাদুল্লাহ জান খান (উপ-সী.) এবং শেঠ শুকদেব (সিন্ধু) বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি দেন। অবশেষে নূর মােহাম্মদ আনীত প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এরপর প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তান সংবিধানের মূলনীতি কমিটির যে চূড়ান্ত রিপাের্ট গণপরিষদে উত্থাপন করেন তাতেও ভাষা প্রশ্নটি অনুল্লেখ থাকে। এরফলে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ আরাে বেড়ে যায়।
পরবর্তী ২ বৎসর ভাষার প্রশ্নে আর কোনাে অগ্রগতি হয়নি। ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে পূর্ববাংলার জনগণ ভাষা, স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন দাবির প্রশ্নে তাদের মতামত প্রকাশের সুযােগ লাভ করে। উক্ত নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামক একটি নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। উক্ত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী মেনিফেস্টো হিসেবে যে ২১ দফা নির্বাচনী ওয়াদা ঘােষণা করে তার অন্যতম ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অঙ্গীকার, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘােষণা, ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদদের জন্য একটি শহীদ মিনার নির্মাণ ও শহীদদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান। এই নির্বাচনে পূর্ববাংলার যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে । মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। ফলে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং সে অনুসারে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বাের্ডের মিটিংয়ে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের আলােকে ৯ মে ১৯৫৪ তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হবে উর্দু ও বাংলা এবং অন্য আর কোনাে প্রাদেশিক পরিষদে। সুপারিশ করা হবে।
পার্লামেন্টের সদস্যগণ ইংরেজি ছাড়া উর্দু ও বাংলাতে বক্তব্য। রাখতে পারবেন। গণপরিষদের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এইভাবে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী আইয়ুব খানকে ভাষার প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করে কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু আইয়ুব খান তাতে কর্ণপাত করেননি। বরং ১৯৬২ সালে ঘােষিত তার সংবিধানে তিনি বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বহাল রাখেন। (আর্টিকেল-২১৫)। ১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাঙলা। ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নও জড়িয়ে পড়ে। যেমন কেন্দ্রীয় গণপরিষদে পূর্ববাংলার জনসংখ্যানুপাতিক আসন সংখ্যা দাবি করা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙালিদেরকে অধিক সংখ্যক নিয়ােগের দাবি করা হয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানাের দাবি করা হয়। বাংলা ভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের বৈরী মনােভাবের কারণে এই দল থেকে গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি নতুন নতুন দলের সৃষ্টি হওয়ায় পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের প্রাধান্য খর্ব হয়।
ফলে ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এই দলের চরম পরাজয় ঘটে। ভাষা আন্দোলন প্রথম পর্যায়ে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। কিন্তু কালক্রমে এটি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। অনেক রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফলে পূর্ববাংলায় স্বাধিকারের চিন্তাচেতনা শুরু হয়। পরবর্তী আন্দোলনসমূহে ভাষা আন্দোলন প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ভাষা আন্দোলন এক ধরনের প্রাদেশিকতাবাদের জন্ম দেয়। এরপর যখনই পূর্ববাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনাে দাবি উচ্চারণ করা হয়েছে তখনই পূর্ববাংলাবাসীর সমর্থন অর্জন করেছে। ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজকে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের মাত্র দুই মাসের মধ্যেই। (এপ্রিলে) পূর্ববাংলায় ছাত্র ইউনিয়ন নামে ছাত্রসংগঠন জন্মলাভ করে। পরবর্তী আন্দোলনসমূহে তাই দেখা যায় ছাত্রসমাজই ছিল মূল শক্তি। যে কোনাে সরকারের যে কোনাে অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারণ করে ছাত্রসমাজ। ভাষা আন্দোলন ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কর্মচারী প্রভৃতি সকল পেশার লােকদের মধ্যে ঐক্যের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে, পরবর্তী আন্দোলনসমূহে আমরা তার পুনরাবৃত্তি দেখি। ভাষা আন্দোলনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এর সঙ্গে জড়িত নেতৃবৃন্দ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তন করেন। পার্লামেন্টের মধ্যে কংগ্রেসদলীয় হিন্দু নেতৃবৃন্দ ভাষার দাবিতে কথা বলেছেন, আর রাজপথে অকংগ্রেসীয়রা ধর্মীয় ভাঁওতাবাজির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। ফলে পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বৃদ্ধি। পেয়েছে। আওয়ামী-মুসলিম লীগ নামের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি ধর্মীয় ভাওতাবাজির রাজনীতি ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করে এবং ১৯৫৫ সালে পার্টির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে পার্টিকে সকল ধর্মের লােকদের নিকট গ্রহণযােগ্য করে তােলে। ফলে পরবর্তী আন্দোলনসমূহে নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতেই চলে যায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ছাত্রীদের বােরখা পড়ার অভ্যেস কমে যায়। পরবর্তীতে সভা-সমিতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণের ধারা সৃষ্টি হয় । রাজনীতিতেও মেয়েরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল। হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট, ১৯৫৪সালের নির্বাচন ও পরিণতি ক. ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন। অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এ ঘােষিত Provincial Legislative Assembly Order. 1947 অনুসারে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যগণ ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যে পরিণত হয়। সুতরাং পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ১৯৫২ সালে। কিন্তু উক্ত পরিষদের প্রথম অধিবেশন ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই যুক্তিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৬১(২) নং ধারা সংশােধন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ১৯৪৯ সালে পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পরাজিত হওয়ায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার আর কোনাে নির্বাচন মােকাবিলা করতে ভয় পান। ফলশ্রুতিতে নূরুল আমিন সরকারের অনুরােধক্রমে পাকিস্তান গণপরিষদ The East Bengal Legislative Assembly (Continuation) Act, 1953′ পাস করার মাধ্যমে পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের মেয়াদ আরও এক বৎসর বৃদ্ধি করেন। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 
লক্ষ ৪০ হাজার অধিবাসীর জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করা হয়। সারণী ১-এর জনসংখ্যা, ভােটার সংখ্যা ও সম্প্রদায় ভিত্তিক আসন বন্টন দেখানাে হল। সমস্ত পূর্ববাংলা যেখানে মুসলমানদের জন্য ২২৮টি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়, সেখানে বর্ণ-হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৩০টি এলাকায় ও তফশিলি হিন্দুদের জন্য ৩৬টি এলাকায় বিভক্ত হয়। স্বভাবতই বর্ণ-হিন্দু বা তফশিলি হিন্দুদের নির্বাচনী এলাকা মুসলমানদের নির্বাচনী এলাকার চেয়ে অনেক বড় ছিল। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যতিরেকে অন্য আসনেও মহিলাপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। মহিলাদের জন্য যে ১২টি আসন সংরক্ষিত ছিল সে আসনসমূহের নির্বাচনে কেবলমাত্র মিউনিসিপ্যাল এলাকায় মহিলাদেরই ভােটদানের অধিকার ছিল। সুতরাং মিউনিসিপ্যাল এলাকায় বসবাসরত মহিলা ভােটারদের প্রত্যেকের ভােট ছিল ২টি করে- ১টি নিজ সম্প্রদায়ের মহিলা (সংরক্ষিত) প্রার্থীর জন্য, অন্যটি নিজ সম্প্রদায়ের পুরুষ/মহিলা প্রার্থীর জন্য। মফস্বল এলাকায় (মিউনিসিপ্যালিটির বাইরে) বসবাসরত মহিলা ভােটারের ভোেট ছিল একটি নিজ সম্প্রদায়ের পুরুষ/মহিলা প্রার্থীর জন্য ।
১৯৫৩ সালের ১ জানুয়ারি যাদের বয়স ২১ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল তারা ভােটার হওয়ার যােগ্য ছিলেন। ভােটার তালিকায় অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ছিল। অনেকের নামই ভােটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এমনকি ঢাকা সিটি মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব সৈয়দ আহমদ রাজা-এর নাম ভােটার তালিকাভুক্ত হয়েছিল না বলে তিনি অভিযােগ করেছিলেন। ভােটার তালিকা সম্পর্কে আপত্তি পেশের শেষ তারিখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবির মুখে ১০ দিন বাড়ানাে হলেও আপত্তি পেশের মােট সংখ্যা শতকরা এক ভাগেরও কম ছিল। চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশিত হয় ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩। মােট ভােটার সংখ্যা ছিল ১,৯৭,৩৯,০৮৬ এর মধ্যে মহিলা ভােটার ১,০৫,৭১,৯৪৯ জন। ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি মনােনয়নপত্র গ্রহণ শুরু হয়। মনােনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিল ১৪ জানুয়ারি ১৯৫৪। মনােনয়ন পত্র বাছাই ১৬,১৭ ও ১৮ জানুয়ারি (১৯৫৪) এবং মনােনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ২১ জানুয়ারি (১৯৫৪)।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও জোট
১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে মােট ১৬টি দল অংশগ্রহণ করে । মুসলমান আসনে যে-সকল দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেগুলাে হচ্ছে-মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী, যুব লীগ, গণতন্ত্রী দল, খেলাফতে রব্বানী পাটি প্রভৃতি। অমুসলমান আসনে যে দলগুলাে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, তফশিলি ফেডারেশন, গণসমিতি, অভয় আশ্রম (কুমিল্লা), পূর্ব পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দল প্রভৃতি। কম্যুনিস্ট পার্টির মুসলমান সদস্যগণ মুসলমান আসনে এবং হিন্দু সদস্যগণ হিন্দু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মুসলমান আসনে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি এবং নেজামে ইসলামী ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। হিন্দু আসনের নির্বাচনে গণসমিতি, অভয় আশ্রম ও পূর্ব পাকিস্তান সমাজতান্ত্রিক দল সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে।
 

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!