You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুসলিম লীগের অপশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলন : পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহ
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি দরকার-এই স্লোগানের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বভাবতই ধর্মই ছিল পাকিস্তান জাতীয়তার ভিত্তি । ১৯৫১ সালের আদমশুমারি রিপাের্ট অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ৯৭% এবং পূর্ববাংলার ৮০% ছিল মুসলমান। কিন্তু অধিকাংশ অধিবাসীর ধর্ম এক হলেও তাদের ভাষা ছিল ভিন্ন। ১৯৫১ সালে ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তান জনগণের 
বহু ভাষাভাষীর দেশ পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী তৎকালীন শাসকগােষ্ঠী। তাদের একগুঁয়েমি ও অবিবেচক সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ববাংলার জনগণের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, আর এই ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা সচেতনতা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত এ বিষয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করেন। ড. শহীদুল্লাহ ছাড়াও ১৯৪৭ সালের মধ্যেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রতি বহু প্রখ্যাত ও স্বল্পখ্যাত এবং অখ্যাত লেখক তাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছিলেন। এর ফলে পূর্ববাংলার শিক্ষিত সমাজ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে বাংলা রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে একটি প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলাভাষার দাবিকে জোরদার করা হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নবগঠিত ২/১টি রাজনৈতিক সংগঠনও বাংলা ভাষার প্রশ্নে বক্তব্য রাখে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবলীগের এক কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কে নিমলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় : পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে প্রস্তাব করিতেছি যে, বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।  আর একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাষার প্রশ্নে সােচ্চার হয়।
 
এই সংগঠনটির নাম ‘তমুদ্দন মজলিশ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটি বিভিন্ন সাহিত্য-বৈঠক আয়ােজন করে। এই সংগঠন ছাত্র-শিক্ষক মহলে বাংলাভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি বই মজলিশ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ভাষা বিতর্কের সূত্রপাত যদিও পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭% ভাগ লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু তথাপি উর্দুকেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার এক চেষ্টা চলছিল। পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফরম, রেলের টিকেট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দুভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়ােগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। এমনকি পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্বাচন করা হয়। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তার এই প্রস্তাবের ওপর আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, প্রাদেশিকতার মনােভাব নিয়ে তিনি এ প্রস্তাব করেননি। যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লােকের মাতৃভাষা বাংলা, সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
কিন্তু যেহেতু এই প্রস্তাবটি আসে একজন হিন্দু সদস্যের কাছ থেকে তাই মুসলিম নেতৃবৃন্দ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। তারা উক্ত প্রস্তাবকে দেশের সংহতি ও অখন্ডতা বিনষ্ট করার প্রয়াস বলে মন্তব্য করেন। গণপরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মন্তব্য করেন যে, একটি সাধারণ ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবন্ধনের যে প্রয়াস চালানাে হচ্ছে তা বানচাল করার জন্যই বাংলাভাষার প্রস্তাব করা হচ্ছে। তিনি বলেন যে, উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলমানদের ভাষা হওয়া উচিত। যেহেতু পাকিস্তানের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা উর্দু, অতএব উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা, অন্য কোনাে ভাষা নয়। বিতর্কের পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত প্রস্তাব ভােটে দেয়া হলে অগ্রাহ্য হয়। পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি মুসলমান সদস্যগণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট দেন। 
 
বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় পূর্ববাংলায় গণ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। গণপরিষদে দেয়া লিয়াকত আলী খানের ঘােষণার প্রতিবাদে পূর্ববাংলায় ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক নির্বিশেষে সকল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তােলেন।  উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ঢাকার ছাত্রবৃন্দ ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বাংলাভাষার সমর্থনে শ্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকায় মিছিল করে। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শেষ হলে সেখানে এক সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করে। তমুদ্দিন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেম। সভায় বক্তারা বলেন- পাকিস্তান। গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে প্রস্তাব করেছেন তা কোনাে সাম্প্রদায়িক চিন্তা নয়, বরং সমস্ত বাংলা ভাষাভাষীদের দাবি এই যে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করতে হবে। পাকিস্তানের মুদ্রায় টিকিটে, মানি অর্ডার ফরমে কেবল উর্দুভাষা উল্লেখ থাকার কড়া সমালােচনা করা হয় এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষা মুদ্রণ করারও জোর দাবি জানানাে হয়। বাংলাভাষার সংগ্রামকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি সংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে ২ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকার ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদে নিমলিখিত সংগঠনের প্রত্যেকটি থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যথা : তমুদ্দন মজলিশ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক, মুসলিম হলসহ অন্যান্য ছাত্রাবাস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ছাত্র ফেডারেশন কমিউনিস্ট দলের ছাত্র সংগঠনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন শামসুল আলম। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ (১৯৪৮) পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। উক্ত দিন ছাত্ররা বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার দাবিতে সেক্রেটারিয়েটের বাইরে সমবেত হলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে এবং ফলে কমপক্ষে ৫০ জন ছাত্র গুরুতর আহত হয়। উক্ত সমাবেশে ছাত্ররা প্রাদেশিক গভর্নর খাজা নাজিমউদ্দীনের ও তার মন্ত্রিপরিষদের কড়া সমালােচনা করে এবং গণপরিষদ থেকে পূর্ববাংলার সদস্যদের পদত্যাগের আহ্বান জানায়। এই প্রতিবাদসভাকে সরকার হিন্দু তথা পাকিস্তানের শত্রুদের দ্বারা আয়ােজিত এক গভীর চক্রান্ত বলে প্রচার করে। সরকার ঘােষণা করে যে, বাংলাভাষার আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র । কিন্তু ছাত্রদের এই আন্দোলন ১১ মার্চ বন্ধ হয়ে যায়নি, বরং পরের দিনগুলিতে এই আন্দোলন আরাে জোরদার হতে থাকে এবং সাধারণ জনসাধারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ১৫ মার্চ আলােচনায় বসতে বাধ্য হন। উক্ত আলোচনা সভায় ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তসমূহ ছিল নিমরূপ :
 
১. ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলাভাষা প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।  ২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোেগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন। ৩. ১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলােচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে। এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমেও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে। ৫. আন্দোলনে যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছে তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে । ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।’
 
খাজা নাজিমউদ্দীন আলােচনা সভায় স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কোনাে স্বদেশবিরােধী চক্রান্ত নয়। আন্দোলনকারীদের দাবি যথার্থ । তিনি উক্ত চুক্তিনামায় নিজ হাতে লেখেন যে, he was satisfied that the movement was not inspired by enemies of the state.’ ইতােমধ্যে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। উক্ত অধিবেশনে ভাষার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়। ফলে ছাত্ররা নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নাজিমউদ্দীন কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা জানার জন্য ছাত্ররা ১৭ মার্চ (১৯৪৮) প্রাদেশিক পরিষদের সভাকক্ষের দিকে মিছিল সহকারে অগ্রসর হলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও বন্দুকের ফাঁকা গুলি করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়।  ছাত্রদের এই আন্দোলনে নাজিমউদ্দীন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহকে যথাশীঘ্র সম্ভব পূর্ববাংলা সফরে আসার আহ্বান জানান। সে অনুসারে গভর্নর জেনারেল প্রথম এবং শেষবারের মতাে ১৯ মার্চ পূর্ববাংলা সফরে আসেন। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তিনি স্বৈরাচারী মনােভাব দেখান। ২১ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় তিনি দৃঢ়স্বরে ঘােষণা করেন যে, তিনি কোনাে শত্রুকে, এমনকি সে যদি মুসলমানও হয়, সহ্য করবেন না। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট করে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হবে উর্দু-অন্য কোনাে ভাষা নয়। জিন্নাহর এই ঘােষণায় সভার কোনাে-কোনাে অংশ থেকে মৃদু ‘ননা, নাে’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। উক্ত সভার তিন দিন পর (২৪ মার্চ, ১৯৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়ােজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেন যে পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন আসলে পাকিস্তানের শত্রুদের কারসাজি । তিনি আন্দোলনকারীদের ‘পঞ্চমবাহিনী’রূপে অভিহিত করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, বাঙালিরা তাদের প্রদেশের সরকারি ভাষারূপে যে-কোনাে ভাষা নির্বাচিত করতে পারে, কিন্তু পাকিস্তানের সরকারি ভাষা অবশ্যই হবে উর্দু। জিন্নাহর এ উক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উপস্থিত গ্রাজুয়েটবৃন্দ ‘না না’ ধ্বনি উচ্চারণ করে।
জিন্নাহর এই অবিবেচক, স্বৈরাচারী মনােভাব পূর্ববাংলায় বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি হয় । ভাষার আন্দোলন ক্রমাম্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাৎকারের সময় প্রতিনিধিদল জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপি থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তিগুলি জানা যায়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার স্বার্থ ইতিহাসের বিচারে এ-কথা স্বীকার করতে হবে যে পাকিস্তানের মতাে বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করতে হলে যে কোনাে একটি ভাষাকে Common Language হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, তৎকালীন পাক-শাসকগােষ্ঠী কেন উর্দুকে Common Language হিসেবে পাকজনগণের উপর চাপিয়ে দেয় এবং এর পিছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কী কারণ নিহিত ছিল? ভারতবর্ষে উর্দুর জন্ম মুঘল শাসনামলে মূলত সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দি, ফারসি ও আরবি ভাষার সংমিশ্রণে উদুর আবির্ভাব। উর্দু ভাষায় শব্দ বিন্যাসের ব্যাকরণগত পদ্ধতি নেয়া হয়েছে হিন্দি থেকে, আর শব্দ নেয়া হয়েছে আরবি ও ফারসি ভাষা থেকে। উর্দু লেখা হত ফারসি বর্ণমালায়। যেহেতু মুসলমান শাসকগােষ্ঠীর উদ্যোগে এই ভাষার জন্ম, তাই কালক্রমে উর্দু শাসকশ্রেণীর এবং মুসলমান অভিজাতশ্রেণীর ভাষায় পরিণত হয়। ব্রিটিশ আমলে সরকারিভাষা হিসেবে ফারসি পরিত্যক্ত হলে উর্দুর প্রচলন বেড়ে যায় । উচচস্তরের মুসলমানগণ উর্দুকে ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ভারতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা হিন্দিকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা  করার প্রস্তুতি নিলে মুসলিম লীগের মুসলমান নেতৃবৃন্দ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় আলােচনার অবতারণা করেছিলেন। এমনকি অনেক বাঙালি মুসলিম লীগ রাজনীতিবিদ উর্দু পছন্দ করতেন। তাই দেখা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরও বাঙালি মুসলমান রাজনীতিবিদগণ উর্দুকে বয়কটের কথা কখনাে বলেননি। তারা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি করেন।
পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭% জনগণের মাতৃভাষা উর্দু হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য ভাষাভাষীরা উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেখানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুর প্রচলন করা হয়। তাছাড়া পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের শাসনভার যে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের হাতে যায় তারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দু ভাষাভাষী লােক। নতুন রাষ্ট্রের ব্যবসা, ব্যাংকিং, কয়েকটি পরিবারের হাতে সীমাবদ্ধ হয়। তারাও ছিলেন উর্দু ভাষাভাষী। তাদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। স্বভাবতই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রাধান্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভাষার উপর প্রাধান্য বজায় রাখতে তাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল। কারণ উর্দু প্রশাসনিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা হলে উর্দু ভাষাভাষীদের জন্য তা যতটা সহজ হবে, অন্য ভাষাভাষীদের জন্য তত সহজ হবে না। প্রশাসনিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, যােগাযােগ প্রভৃতি সকল বিভাগের সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তীরা এমনিতেই অনেক সুযােগসুবিধা ভােগ করছিল, তার উপর উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করায় সেখানকার অউর্দুভাষীদের জন্য উর্দু কোনাে সমস্যা ছিল না।
ফলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করা হলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এটা মেনে নেয়, সেখানকার অউর্দুভাষীরা এর কোনাে প্রতিবাদই করেনি। প্রতিবাদ উচ্চারিত হল কেবল পূর্ববাংলায়। অপরপক্ষে পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী তথা পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ সদস্যগণ কর্তৃক বাংলার দাবি অগ্রাহ্য করার পিছনে আশঙ্কা ছিল যে বাংলা তাদের মতে হিন্দুদের ভাষা এবং বাংলাকে স্বীকৃতি দিলে পূর্ববাংলার বাঙালিগণ পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের সঙ্গে যােগসাজশ করে ভবিষ্যতে বৃহৎ বাংলার দাবি করতে পারে। সেজন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলাভাষা আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরােধী ও ইসলামবিরােধী চক্রান্ত বলে। অভিহিত করে। বাংলাভাষাকে ইসলামীকরণ করার উদ্দেশ্যে তারা বাংলাকে আরবি কিংবা রােমান অক্ষরে পরিবর্তিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। দুঃখজনক যে এই গর্হিত কাজের উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন (১৯৪৯) কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তার উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা পুনর্গঠন কমিটি গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তানে এর কড়া প্রতিবাদ হয়। ফলে এই কমিটির রিপাের্ট ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়ােজনীয়তা পূর্ববাংলা বাংলাভাষা আন্দোলনকারীদের বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পিছনে যুক্তি ছিল যথেষ্ট । বাংলা ছিল পাকিস্তানের ৫৬% লােকেরা মাতৃভাষা। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে অন্য আরেকটি ভাষা শিক্ষা করা ও সেই ভাষায় চাকুরির প্রতিযােগিতায় ভালাে করার সম্ভাবনা ছিল কম।
পাকিস্তানের প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে ও অর্থনৈতিক সেক্টরে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। তারপর যদি উর্দুকে সরকারি ভাষা করা হয় তাহলে ভাষা সমস্যার কারণে বাঙালিদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হত। ফলে সকল ক্ষেত্রে উর্দুভাষীরা অগ্রাধিকার পেয়ে আস্তে আস্তে বাঙালিদের গ্রাস করে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতাে। যার অর্থ হচ্ছে বাঙালি সত্তার সমাধি । সুতরাং বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায় উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন। তাদের এ প্রতিবাদ ক্রমাম্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ও অর্থনৈতিক শােষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বরূপ লাভ করে ভাষা-আন্দোলন : জিন্নাহর প্রত্যাবর্তনের পর জিন্নাহর পূর্ববাংলা সফর ভাষা-আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়  জিন্নাহ অনেককে বুঝাতে সক্ষম হন যে, ভাষা আন্দোলন ছিল কমিউনিস্টদের কারসাজি। দেশের সংহতি বিনষ্ট করাই উক্ত আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং তার প্রতি সাধারণ। মানুষের অগাধ শ্রদ্ধাবোেধ অনেক আন্দোলনকারীকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে ফেলে। এমনকি তমুদ্দন মজলিশও আন্দোলনের কর্মসূচী প্রত্যাহার করে। তবে ভাষাকে ঘিরে ছাত্রদের মনে ক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ছাত্ররা ১৯৪৮-এর পর থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ পালন করতেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাঙালি হয়েও বাংলা বর্ণমালাকে আরবিকরণের পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশ্যে ৯ মার্চ (১৯৪৯) মাওলানা আকরাম খাঁ-এর নেতৃত্বে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি গঠিত হয়। এর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। তারা এর তীব্র নিন্দা করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবাদলিপি পেশ করে । ৩১ ডিসেম্বর (১৯৪৮) ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উক্ত প্রয়াসের সমালােচনা করেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে এবং পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা বর্ণমালার আরবিকরণ প্রয়াস নিয়ে বিতর্ক হয়। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কমিটি ৭ ডিসেম্বর (১৯৫০) পেশকৃত রিপাের্টে বাংলা বর্ণমালা আরবিতে লেখার বিরােধিতা করলে সরকারের উক্ত প্রয়াস বাধাগ্রস্ত হয়। 

১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে ভাষার প্রশ্নে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত হয়। পাকিস্তান গণপরিষদের সাংবিধানিক মূলনীতি কমিটি ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে একটি অন্তর্বতী রিপাের্ট গণপরিষদে পেশ করে। উক্ত রিপাের্টে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব হয়। মূলনীতি কমিটির রিপাের্টের প্রতিবাদ ঢাকায় একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। উক্ত সংগ্রাম কমিটি ৪ ও ৫ নভেম্বর (১৯৫০) ঢাকায় জাতীয় মহাসম্মেলন করেন এবং পাকিস্তানের সাংবিধানিক মূলনীতি সম্পর্কে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাংলা হবে বলে দাবি করা হয়। সংগ্রাম কমিটি ১২ নভেম্বর পূর্ববাংলায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অবশেষে পাক প্রধানমন্ত্রী উক্ত রিপাের্ট প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ভাষার প্রশ্নটি আপাতত চাপা পড়ে। তবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে না যায় সে উদ্দেশ্যে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ‘উৎসাহী ও সংগ্রামী ছাত্র ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। আবদুল মতিন এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

 

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান

 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!