মুজিবকে দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি কার?
তােফায়েলের ‘বঙ্গবন্ধু’ ঘােষণা নিয়ে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সামসুদ্দোহা বলেন: ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সারা রাত ধরে যে মিটিং হয়, সেই মিটিংয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেউ কোনাে প্রস্তাব দেননি যে শেখ মুজিবুর রহমানের গণসংবর্ধনায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা। হবে ।…বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানে কোনাে আপত্তি কারােরই ছিল না বা নাই। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাউকে না জানিয়ে যে পদ্ধতিতে তার মতাে নেতাকে এই উপাধি দেওয়া হয়, তা না করে উচিত ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকটের একটি নমুনা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে।…ওই সংকীর্ণতার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। ২৩ ফেব্রুয়ারির জনসভায় তােফায়েল আহমেদ ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির ঘােষক। তবে শেখ মুজিবের জন্য এই নাম তৈরি হয়েছিল আগেই ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ৩ নভেম্বর (১৯৬৮) ছাত্রলীগের প্যাডে ‘আজব দেশ’ শিরােনামে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সম্বন্ধে একটি লিফলেটের খসড়া লিখেছিলেন। মুশতাক ‘সারথি’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। লেখাটির শেষ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব সম্পর্কে তিনি লেখেন, পূর্ব বাংলার নয়নমণি—মুক্তি দিশারি—বঙ্গবন্ধু—সিংহ শার্দুল জনাব শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, আজব ও অভিনব পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি টিকে থাকতে পারে—নতুবা নয়।”২৬ ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত চার পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রতিধ্বনির শেষ পৃষ্ঠায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি প্রথমবারের মতাে ছাপা হয়। বুলেটিনটি সম্পাদনা করেছিলেন আমিনুর রহমান।(২৭) সিরাজুল আলম খান রেসকোর্স ময়দানে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঘােষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন এভাবে:
“রেজাউল হক মুশতাক আর শেখ কামাল একটা ওয়ালপেপার বের করেছে। আহসানউল্লাহ হলের (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ২১৪ নম্বর রুমে থাকতাম আমি। ওরা আমাকে আসতে বলল। গিয়ে দেখি যে বড় একটা পােস্টার, বঙ্গবন্ধু লেখা। এটি লাগাবে, পরামর্শটা চাচ্ছে। কাগজটা মুড়ি দিয়ে বললাম কাউকে কিছু বােলাে না। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে যাচ্ছি। গাড়িতে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমি আর তােফায়েল। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে লিডার কানের কাছে মুখ এনে বললেন যে কী বলবেন-টলবেন। বললাম, আমাদের সব ঠিক আছে। তােফায়েল বলল, ‘কী বলব?” আমি বললাম যে তুমি একটা টাইটেল দেবা। আমি বায়ে ঝুঁকলাম লিডারকে বলার জন্য। তােফায়েল একটা জিনিস দেবে আপনাকে। উনি এটি বুঝলেন, সেন্স করেছেন। জিজ্ঞেসও করলেন না। উনার ওপর আমার একটি বিরাট কনফিডেন্স হলাে। তােফায়েলকে বললাম, তােমার বক্তৃতা শর্ট হবে। এ জায়গায় এটি বলবা, রিসেপশনটা ভালাে হবে। এটি আমরা আনলাম ইঞ্জিনিয়ারিং করে। রাজনীতিতে শেখ মুজিবের একক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটি পরে তাঁর নামের অপরিহার্য অংশ করে তােলার চেষ্টা হয়। ফলে রাজনীতিতে ব্যক্তির ‘কাল্ট’ প্রতিষ্ঠার পথে আওয়ামী লীগ এক ধাপ এগিয়ে যায়।”
সূত্রঃ আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ